চীনে বাংলাদেশি নারী পাচার

স্টার অনলাইন গ্রাফিকস

দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে আসার আশায় চুয়াডাঙ্গার এক বিধবা নারী গত বছরের ১ জুলাই চুই পো ওয়েই নামে এক চীনা নাগরিকের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেন।

পরিবারটিকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে চীনা লোকটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, গাজীপুরের একটি কারখানায় কাজ করে এবং বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থাকবে।

তবে এ সবই ছিল পাচারকারীদের ফাঁদ।

চলতি বছরের ৩১ মার্চ ঢাকার একটি ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ওই মা। মামলায় বলা হয়, বিয়ের ছয় মাস পর তার মেয়ে লাভলীকে (ছদ্মনাম) চীনে নিয়ে গিয়ে যৌনকাজে বাধ্য করে ওই ব্যক্তি।

গত ১১ মার্চ একটি অ্যাপ ব্যবহার করে লাভলী তার মাকে ফোন করেছিলেন। জানান, নির্যাতনের কারণে গুরুতর অসুস্থ তিনি। বাংলাদেশি পাচারকারীরা তাকে চুই পো ওয়েই নামে ওই চীনা লোকের কাছে ১০ লাখ টাকায় তাকে বিক্রি করে দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

লাভলীর মা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, চীনা নাগরিকদের বিয়ে করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন আরও চার জন দরিদ্র নারীকে তিনি চেনেন। স্থানীয় যারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছিল সেই চক্রটিই ওইসব বিয়ের আয়োজনের সঙ্গেও জড়িত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর উত্তরার একজন বাসিন্দা, যিনি একটি চীনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, বলেন স্থানীয়দের দুটি দলকে তিনি চেনেন যারা সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশি নারীদের খুঁজে বেড়ায়, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর নারীদের খুঁজে বের করে এবং তাদেরকে চীনা নাগরিকদের বিয়ে করতে বাধ্য করে।

তিনি বলেন, 'আমি প্রায়ই উত্তরার রেস্টুরেন্টগুলোতে দেখি চীনা পুরুষরা পার্বত্য জেলাগুলোর নারীদের সঙ্গে দেখা করছেন। মাঝে মাঝে দেখি তারা বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র তৈরি করছেন। স্থানীয় কিছু লোক এই চক্রের সদস্য।'

তিনি শুনেছেন, চীনে যেতে রাজি হলে প্রত্যেক নারীর জন্য স্থানীয় 'ব্যবস্থাকারী'রা ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা করে পান।

লাভলীর মায়ের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্তরা হলেন চুই পো ওয়েই, জি ইজিয়ান (যিনি নিজেকে ওয়েইয়ের বোন হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন), বগুড়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন, চুয়াডাঙ্গার ফারুক ও আব্দুল মান্নান, কাশিমপুরের সোলায়মান এবং রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বিয়ের রেজিস্ট্রার হাফিজুর রহমান মোল্লা।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, আসামিরা সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী। যারা আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমার মেয়েকে যৌন নির্যাতন এবং জোরপূর্বক যৌনকাজে বাধ্য করার জন্য চীনে পাচার করেছে।

মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ তদন্ত করছে।

এদিকে, গত ১ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর থানায় চাকমা সম্প্রদায়ের এক নারী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় বলা হয়, একদল পাচারকারী তার বোনকে রাজধানীর একটি অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখেছে এবং শিগগিরই তাকে চীনে নিয়ে যেতে পারে।

অভিযোগে বলা হয়, চক্রটি ২১ বছর বয়সী ওই নারীকে একটি নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তির কথা বলে মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় নিয়ে যায়। চক্রটি ওই নারীর অশালীন ছবি তোলে এবং তাকে একজন চীনা লোককে বিয়ে করতে বাধ্য করে।

চক্রের নেতা হিসেবে রিকা চাকমা নামে এক নারীকে আসামি করা হয়। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাসিন্দা রিকা রাজধানীর উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে থাকেন। মামলায় সাত জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়।

এছাড়া গত ২৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ির ২১ বছর বয়সী এক মারমা নারী তাকে চীনে পাচারের চেষ্টার অভিযোগে লক্ষ্মীছড়ি থানায় পাঁচজন ও অজ্ঞাত আরও দুই-তিন জনকে আসামি করে মামলা করেন।

তাকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় নিয়ে গিয়ে এক চীনা যুবককে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। ভাগ্যক্রমে, ২৫ এপ্রিল যখন তার পাসপোর্টের জন্য একটি নথি নিতে খাগড়াছড়ির একটি সরকারি অফিসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন ওই চক্রের তিন সদস্যকে আটক করা হয়। উদ্ধার হন ওই তরুণী।

দুটি মামলাই তদন্ত করছে সিআইডি।

২০১৮ সালে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্টীর তিন নারীকে চীন থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

রাঙ্গামাটির কাউখালীর ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্র দেওয়ান বলেন, গত কয়েক মাসে ওই এলাকার অন্তত তিন জন তরুণীকে চীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পাচারকারীদের হাত থেকে দুই স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে।

সুবিধাবঞ্চিত নারীরা যাতে মানব পাচারকারীদের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পায় সেদিকে নজরদারি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূর ই আলম মিনা বলেন, পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

বাংলাদেশে চীনা দূতাবাস একটি ইমেইলে বলেছে, চীন সরকার নারী ও শিশুদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করে এবং মানবপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। এছাড়া দূতাবাস বাংলাদেশে চীনা নাগরিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানায়।

লাভলীর মামলার বিষয়ে এতে বলা হয়, দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি।

[আমাদের রাঙ্গামাটি সংবাদদাতা লালটালিয়ান পানখোয়া এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন।]

Comments

The Daily Star  | English

Those involved in Ijtema ground deaths won't be spared: home adviser

He also said that those who are involved with the killings must be brought to book.

55m ago