কালো টাকায় রাষ্ট্রের বার্তাটা কী?

কালো টাকার ক্ষেত্রে এবারের বাজেটে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার কুফল বা পরিণামটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? সম্ভবত না। এর মধ্যে দিয়ে কি অবৈধ-অন্যায় এই অপকর্মকেই উৎসাহিত করা হলো না? যারা কালো টাকার সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে কি আমরা জেনে-বুঝেই এমন একটা আস্কারা দিলাম?

২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর এর বিভিন্ন দিক নিয়ে নানামুখী কথা হচ্ছে। কালো টাকা নিয়েও দেদার আলাপ চলমান। সরকারের তরফে নানা যুক্তি হাজির করার চেষ্টা রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও অর্থখাতের বিশেষজ্ঞদের থেকেও এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তরফেও। তাদের অভিমত হলো, এর মধ্য দিয়ে কালো টাকার মালিকদের প্রণোদনা ও সৎ করদাতাদের তিরস্কৃত করা হয়েছে।

বাজেট নিয়ে এই আলোচনা-সমালোচনা কিছুদিন চলমান থাকবে। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হবে সপ্তাহখানেক কিংবা বড়জোর একমাস। তারপর অন্য প্রসঙ্গ এসে হাজির হবে। এটাই নিয়ম। এভাবেই সবকিছুর পালাক্রম ঘটে। বছরের চাকা ঘুরে আবার হাজির হবে নতুন অর্থবছরের বাজেট।

কিন্তু এবারের বাজেটে যেভাবে কালো টাকার মালিকদের গাত্র ধুয়ে সাদা হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নৈতিকভাবে ক্ষত তৈরি করা হলো, তার মাশুল দিতে হবে অনেকদিন। এই ক্ষত সহসা শুকাবে না। বরং এই ক্ষত সমাজ ও রাষ্ট্রে আরও বেশি ক্ষত তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দেবে। কালো টাকার মালিকদের ক্ষেত্রে কেন এই বিষয়টাকে আমলে নেওয়া হলো না, সেটাই বিস্ময়ের; বেদনারও।

কালো টাকাকে এই সুযোগ দেওয়ায় যে ক্ষতটা হবে, সেটা হলো নৈতিকতার ক্ষত। যাতে একবার পচন ধরলে আর রেহাই পাওয়া যায় না। কালো টাকার মালিকদের ১৫ শতাংশ কর দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে কালো টাকা কোনো দোষের কিছু নয়। কালো টাকার সঙ্গে বৈধতা-অবৈধতার কোনো সম্পর্ক নাই। বরং কালো টাকাই ভালো।

এ কারণে তারা কর দেবে ১৫ শতাংশ। আর যারা সৎ করদাতা তারা কর দেবেন ৩০ শতাংশ।

এর মধ্য দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে আমরা আসলে কী বার্তা দিলাম? আমাদের লক্ষ্যটা কী?

সরকারের তরফে বলা হয়েছে, কালো টাকার মালিকদের এরকম সুযোগ দেওয়ার নজির এবারই প্রথম নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা চলে আসছে। সরকার চায়, মানুষ টাকা-পয়সা ব্যক্তিপর্যায়ে গচ্ছিত না রেখে ব্যাংকে জমা রাখুক। ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে আগ্রহী হয়ে উঠুক। এই আগ্রহকে উৎসাহিত করতেই এরকম সিদ্ধান্ত।

আমরা জানি, কালো টাকাকে সাদা করার লক্ষ্যে এই ব্যবস্থা বেশ কবছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। একইসঙ্গে এটাও জানা যে এই সুযোগকে খুব একটা কাজে লাগায়নি কালো টাকার মালিকপক্ষ। অর্থাৎ অনৈতিকভাবে রাষ্ট্র সুযোগ দিলেও সেই সুযোগকে আমলে নেওয়া হয়নি। তা হলে কেনই-বা এরকম একটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্তকে নিয়মিত করা হচ্ছে? এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নৈতিক শক্তি কি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে না?

একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে কালো টাকার ক্ষেত্রে বিগত দিনগুলোর ঘটনা আর এবারের ঘটনার মধ্যে ফারাক রয়েছে। বিগত দিনগুলোতে একজন বেনজীর কিংবা আজিজের মতো ঘটনা জনগণের সামনে আসেনি। এবারের বাজেট আলোচনায় কালো টাকার প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বেনজীরের নামটা সামনে এসেছে।

এমন প্রশ্নও হাজির হয়েছে যে বেনজীর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তার কালো টাকা সাদা করে নিতে পারবে কি না? অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বলেন, 'বেনজীরের বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' একই প্রশ্নের উত্তরে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, 'তার টাকা কেইসে (মামলায়) পড়ে গেছে, এটা কীভাবে সাদা হবে! এখন ফৌজদারি মামলা চলছে।'

যদিও দুর্মুখরা বলছেন, বেনজীর ও বেনজীরের মতো কালো টাকারা মালিকদের রক্ষা করতেই সরকার বাজেটে এরকম সুযোগ রেখেছে। যার বদৌলতে বেনজীর দুধে ধোয়া সাদায় পরিণত হবেন এবং দুদক থেকেও রেহাই পাবেন।

খুব সহজে, সংক্ষেপে এবং এককথায় যদি আমরা বুঝতে চাই, কালো টাকা আসলে কী? তা হলে বলতে হয়, কালো টাকা হলো সেই টাকা, যা বৈধপথে অর্জিত নয়, যার আয় প্রশ্নবিদ্ধ ও অপ্রদর্শিত।

দেশে কালো টাকার মালিকদের মধ্যে বড় সংখ্যক রয়েছে সরকারি চাকরিজীবী। এদের যে আয়, তার সঙ্গে তাদের ব্যয় ও যাপিত জীবনের বিলাসিতার বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। ঢাকা শহরের বনানী-গুলশান এলাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যক রয়েছে সরকারি চাকরিজীবী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। ওসব এলাকার জীবনযাপনের যে ব্যয় এবং ফ্ল্যাটের যে দাম, তা কোনোভাবেই তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এসব যে কেউ জানে না, ব্যাপারটা এমন নয় মোটেই। কেননা বিষয়টা ওপেন সিক্রেট। পত্রপত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখিও রয়েছে। কিন্তু এসব তলিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে হয়নি। ফলে, যে প্রশ্ন চাউর রয়েছে জনমনে, সেটাকে একেবারে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কালো টাকা নিয়ে যাদের প্রশ্ন রয়েছে তারা মনে করেন, সরকারি চাকরিজীবীদের অবৈধ ও অসঙ্গতিপূর্ণ আয়কে বৈধতা দিতেই বাজেটে কালো টাকার ক্ষেত্রে এরকম একটা অন্যায় ও অন্যায্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে সরকারের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে।

এই লেখার শুরুতে আমরা যে প্রশ্ন হাজির করেছিলাম, শেষাশেষিতে সেটা আরও একটু খোলতাই করি। যেকোনো ব্যক্তির শক্তি হলো নৈতিকতার শক্তি। মানুষকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য নানামুখী লড়াই করে যেতে হয়। যার সঙ্গে সর্বদা আরও একটি লড়াইকে জীবনের অংশ করে নিতে হয়। সেটা হলো নৈতিকতার লড়াই। যা ছাড়া অন্যসব লড়াই বৃথা।

একই কথা প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও প্রযোজ্য। সামাজিক শক্তি বা সংঘ হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকার নেপথ্যে রয়েছে তার নৈতিকতার শক্তি।

প্রশ্ন হলো, নৈতিকতা কী? নৈতিকতা হলো সততা, ন্যায্যতা, যৌক্তিকতা, কল্যাণবোধ, সমতা, নিরপেক্ষতা, মূল্যবোধ—এসবের সমষ্টি।

রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সংঘ, ব্যক্তির ভেতরে যদি নৈতিকতার চর্চা না থাকে, তা হলে সে নিজের জয়গান গাইতে পারে না। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন, যেসব মনীষীদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোয় আমরা আজও নির্মাণ করে চলেছি আমাদের সমৃদ্ধ বর্তমান। তাদের সকলেই নৈতিকতাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছেন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে মান্যতা দিয়েছেন। একই কথা অন্যদের বেলায়ও প্রযোজ্য।

এই যে আমাদের শিক্ষার মান একেবারে তলানিতে গিয়ে দাঁড়াল, তার নেপথ্যের কারণ হলো, আমরা শিক্ষা থেকে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েছি। আমরা শিক্ষক নিয়োগের নামে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার নামে, শিক্ষাখাতের অবকাঠামো উন্নয়নের নামে, শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে যা কিছু করেছি তার সবটাই প্রশ্নবিদ্ধ, নৈতিকতা বর্জিত।

ফলে, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা এখন দুর্নীতি নামক ক্ষয়ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। শিক্ষার্থী যদি জানে, যে শিক্ষক আমাকে পড়াচ্ছেন তিনি কিছুই জানেন না, ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন; যে শিক্ষক আমাকে ভালো হওয়ার কথা বলছেন, তিনি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত; সেই শিক্ষার্থীর কাছে ভালো কিছু প্রত্যাশা করার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? ফলে, দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী তৈরি করবেন, এটাই কি স্বাভাবিক ও সঙ্গত নয়?

হালজামানার বাংলাদেশে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি বর্গে দুর্নীতিকে এমনভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যাতে দুর্নীতিগ্রস্তরা লজ্জিত না হয়ে উদ্বুদ্ধ হয় নতুন কোনো অপকর্মে। দুর্নীতিকে জায়েজ করতে তারা সংঘবদ্ধ হয়। নানাকিছুর দোকান খুলে বসে। নিজেদের শক্তিমত্তা জাহির করে। ধোয়া তুলসীপাতারূপে নিজেদের পরিচিত করান। এখন তুলসীপাতা যদি তুলসীপাতা না হয়ে নকল পাতা হয়, তা হলে তা খেলে যেমন সর্বনাশ নিশ্চিত, এই দুর্নীতিগ্রস্তরাও তেমনভাবে সমাজ রাষ্ট্রের সর্বনাশকে নিশ্চিত ও অনিবার্য করে তোলে।

যেমনটা আমরা বেনজীরের ক্ষেত্রে দেখলাম। পোশাকের নামে কী করা যায়, তার ভয়ংকর এক উদাহরণ বেনজীর। প্রশ্ন হলো, কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেনজীররা এতটা দানব হয়ে ওঠে? কোন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা এতটা সর্বনাশ ঘটায়?

আমরা মনে করি, এসব প্রশ্নের উত্তর কারোরই অজানা নয়। কথার কথা—যদি নাই-বা জানা থাকে, তা হলে উদ্যোগ নিতে বাধা কোথায়? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে আমরা কি একজন দুর্নীতিবাজকেও দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে পেরেছি? একজন কালো টাকার মালিককে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে? কালো টাকার মালিকদের কি এভাবে ছাড় দেওয়া চলতেই থাকবে?

প্রচলিত আইনে তাদের বিচারের আওতায় আনতে বাধা কোথায়? যারা অবৈধ পথে আয় করবে রাষ্ট্র কি তাদের ক্ষেত্রে এরকম প্রণোদনা দিতেই থাকবে?

রাষ্ট্র চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। যাদেরকে তিরস্কৃত করার কথা, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা, তাদেরকে উল্টো প্রণোদনা দিতেই পারে।

নিশ্চয় পারে। আর পারে বলেই, কালো টাকার মালিকরা কর দেবেন ১৫ শতাংশ, অবশ্য যদি তারা দেন। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আর সাদা টাকার মালিকরা অর্থাৎ সৎ করদাতারা কর দেবেন ৩০ শতাংশ এবং অবশ্যই তাদেরকে পদে পদে প্রশ্ন করা হবে। যেমনটা বলে সৎ করদাতাদের পুরনো অভিজ্ঞতা। কর দেন বলেই তারা পদে পদে হয়রানির শিকার হন। সবই নির্ভর করে রাষ্ট্রের ওপর, শাসক ও প্রশাসকদের মর্জিমাফিক। কিন্তু পারলেই সবকিছু করতে নেই, নৈতিকতাকে উড়িয়ে দিতে হয় না।

কালো টাকার মালিকদের ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত, তা কি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য? তা কি কোনোভাবে যৌক্তিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া যায়?

এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না হয়, তা হলে কালো টাকার ক্ষেত্রে যে সুযোগ দেওয়া হলো বাজেটে, তার জন্য রাষ্ট্রকে বড় মাশুল দিতে হবে। সেটা হয়তো আজ নয়, কিন্তু কাল কিংবা পরশু দিতেই হবে। কেননা এর ভেতর দিয়ে আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো, প্রচলিত আইনকে পাশ কাটানো হলো এবং অন্যায়-অপকর্মের হোতাদেরকে সমীহ করার রেওয়াজ তৈরি হলো। যা থেকে অন্যরা এই শিক্ষাই নেবে—কালো টাকা কোনো দোষের নয়, কালো টাকা কোনো অপরাধের নয়। কালো টাকা ভালো, কারণ কালো টাকায় কম—সাদা টাকার অর্ধেক—কর দিতে হয়। রাষ্ট্র কি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকার ক্ষেত্রে এই বার্তাই দিতে চেয়েছে?

ড. কাজল রশীদ শাহীন: সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক

kazal123rashid@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka cannot engage with non-state actors: foreign adviser

Md Touhid Hossain also emphasised that peace and stability in the region would remain elusive without a resolution to the Rohingya crisis

20m ago