বালু-পাথর উত্তোলনে মৃত্যুর মুখে ৩ নদী

ছবি: স্টার

অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর ও বালু উত্তোলনের কারণে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় আন্তঃসীমান্ত তিনটি নদী এখন মৃতপ্রায়।

সম্প্রতি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় সরেজমিনে ধরলা, সিঙ্গিমারী ও সানিয়াজান নদী তীর পরিদর্শন করে দেখা যায়, নদীগুলোতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। অবৈধভার ড্রেজার মেশিন দিয়ে উত্তোলন করা বালু ও পাথরের স্তূপ হয়ে আছে নদীর পাড়ে। নদীর তলদেশে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন, বর্ষাকালে আকস্মিক বন্যা এবং ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, জীববৈচিত্র্য ও জীবিকার ক্ষতি হচ্ছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ধরলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৩১.৫ কিলোমিটার, সিঙ্গিমারি ২১ কিলোমিটার এবং সানিয়াজান ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এই নদীগুলোতে ২৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার খনন এবং আড়াই কিলোমিটার বাঁধ সুরক্ষা কাজ সম্পন্ন করে। 

ধরলা নদীকে মৃতপ্রায় দেখে নীরবে কাঁদছেন পাটগ্রামের রসুলগঞ্জ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম (৭৭)। এই নদীরপাড়ে তার বসতভিটা। শৈশবকাল থেকে ধরলা নদীর সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক। নদীর ভাঙনে তার বসতভিটা, দশ বিঘা আবাদি জমি ও গ্রামের কবরস্থান বিলীন হয়েছে। 

নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিনটি নদী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী তিনটি থেকে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর ও বালু উত্তোলন করা হয়। ক্ষমতায় যখন যে রাজনৈতিক দল থাকে তখন সেই দলের নেতাকর্মীরা এই অবৈধকাজের নিয়ন্ত্রণ নেন।'

'অবৈধভাবে পাথর-বালু উত্তোলণ করে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন। কিন্তু আমরা হয়েছি নি:স্ব। আমাদের বসতভিটা ও আবাদি জমি বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলণের কারণে নদীর বুকে বড় বড়গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় বর্ষাকালে আমাদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা মোকাবেলা করতে হয়। ভাঙনের কারনে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে,' বলেন তিনি।

জানতে চাইলে পাটগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করছেন তাদের কোনো দল নেই। তারা সবসময়ই সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'

'সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নদী তিনটি তাদের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে,' বলেন তিনি।

একই গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম (৬৫) বলেন, 'বর্তমানে প্রায় ৪০০-৫০০ ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।'

বাংলাবাড়ী গ্রামের কৃষক নজির আলী (৭৮) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় পাটগ্রামের তিনটি নদীতে নৌকা চলতো। এখন নদীর বুকে শুধু চর। বর্ষাকালে পানি থাকলেও বছরের ৭-৮ মানুষ পানি থাকে না। বৈধভাবে পাধর ও বালু উত্তোলনের কারনে নদীগুলোকে খুন করা হয়েছে। আমরা নদী হত্যাকারীদের চিনি। কিন্তু প্রশাসন নীরব।'

জানতে চাইলে পাটগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল গাফ্ফার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীভাঙনে কী পরিমাণে আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে এটার কোনো জরিপ নেই। তবে নদীপাড়ের বিপুল সংখ্যক কৃষি পরিবার আবাদি জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়েছে। তিনটি নদী মৃতপ্রায় হওয়ায় কৃষিতে মন্দপ্রভাব ফেলছে। অনেক কৃষি জমি বালুতে ঢেকে গেছে।'

যোগাযোগ করা হলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিটির লালমনিরহাট জেলা ইউনিটের সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) টি. এম. এ. মমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাটগ্রামের তিনটি নদীকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সে ব্যাপারে পানি উন্নযন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তুতি নিয়েছে।'

'জেলা ও উপজেলা প্রশাসন অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর-বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে,' তিনি বলেন।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর-বালু উত্তোলনের কারণে পাটগ্রামের তিনটি নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসন নদী হত্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন। দুটি ছোট নদী সিঙ্গীমারী ও সানিয়াজান খননের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। ধরলা বড় নদী হওয়ায় সরকার উচ্চপর্যায়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।'

পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুরুল ইসলাম বলেন, 'বর্তমানে নদীগুলো থেকে পাথর ও বালু উত্তোলণ বন্ধ রয়েছে। তবে রাতের অন্ধকারে দূর্গম এলাকায় পাথর উত্তোলণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।'

'তথ্য পেলেই সেখানে ভ্রাম্যমান আাদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। গেল কয়েকবছরে উপজেলা প্রশাসন শতাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অনেক ড্রেজার মেশিন ধ্বংস ও জরিমানা করেছে। কয়েকটি মামলাও করা হয়েছে। অবৈধভাবে পাথর-বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে পরিচালিত মোবাইল কোর্টও হামলা শিকার হয়েছিল, বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

India bans select jute, fabric imports from Bangladesh via land routes

Today's action by DGFT came a little more than one month after India had imposed port restrictions on the import of certain goods like readymade garments and processed food items from Bangladesh via land routes

43m ago