ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গে সমাজতন্ত্র পতনের সাক্ষ্য

সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হিসেবে দ্বিতীয়বর্ষে পড়েছিলাম সাংবাদিক জন রিড এর বিখ্যাত বই দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। যার ইংরেজি নাম টেন ডেইজ দ্যাট শক দ্যা ওয়ার্ল্ড। জন রিড ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব রাশিয়ায় থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার সামনেই ঘটেছিল অভূতপূর্ব এই মহাবিপ্লব। যাতে পরিবর্তিত হয়েছিল মানচিত্র, সমাজ, সংস্কৃতি এবং বিশ্বরাজনীতির গতিপথ। 

জন রিড এর বর্ণনায় লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের চাক্ষুষ সাক্ষ্য যে কারও ভালো লাগবে। সমাজতন্ত্রের প্রতি তৈরি হবে এক ধরনে ঘোরলাগা মোহ। জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে শ্রমিকরা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে এই দৃশ্য যে কোনো মুক্তিকামীর কাছে মনোহর। আমিও ব্যতিক্রম না। কিন্তু এই মহান বিপ্লব ১৯৯১ সালে কোনো ভেস্তে গেলো, কেনো মানুষ সমাজতন্ত্রের আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে বিষয়ে বিস্তর কৌতূহল, এখনো আছে। এছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পরমবন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভের রাশিয়া বাঙালি জাতির পক্ষে না দাঁড়ালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়তো আরও কঠিন হতো। হয়তো অনেক বেশি রক্ত ঝরাতে হতো।
    
সোভিয়েত রাশিয়া পতনের বিষয়ে বিশেষ কৌতূহল থেকেই হাতে নিই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ। সুনীল বা নীললোহিত প্রিয় লেখক। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত মাত্র ১১৬ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম ৫৪০ টাকা। যদিও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত অন্য একটি প্রকাশনার বইটির দাম মাত্র ২৮০ টাকা। আনন্দ পাবলিশার্সের বইটির মান খুব ভালো। চমৎকার পাতা। হাতে নিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়। সেজন্যেই বইটি বাছাই করা।

ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ মূলত লেখকের ইউরোপ ভ্রমণ কাহিনী। ভ্রমণ স্মৃতি বললেও ভুল হবে না। তবে এই ভ্রমণের সময়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ সময়েই ইউরোপে সোভিয়েত রাশিয়াভূক্ত দেশগুলো রাতারাতি স্বাধীন হয়ে যায়। একটি গুলি না ছুড়েও, একটি প্রাণহানি না ঘটিয়েও পতন হয় মহা পরাক্রমশালী লেনিন-স্টালিনের সোভিয়েত রাশিয়ার। জনতার আকাঙ্খা আর আন্দোলনের মুখে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রও পারেনি এই পতন ঠেকাতে। লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙ্গা হয়েছিল বার্লিন প্রাচীর। যার মাধ্যমে দুই জার্মানি একত্রিত হয়েছিল।

এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, 'সন্ধে থেকেই এখানে সমবেত হয়েছিলেন কয়েক লক্ষ মানুষ। কথা ছিল প্রেসিডেন্ট বুশ, মিখাইল গর্বাচভ, মার্গারিট থ্যাচার প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ক-নায়িকারা উপস্থিত থাকবেন এই মিলন-উৎসবে, কিন্তু এর মধ্যে ইরাকের সাদ্দাম হুসেন মধ্যপ্রাচ্যে কুয়ায়েতি কা-টি ঘটাবার পর সবাই বিচলিত ও ব্যস্ত, তারা আসতে পারেননি কেউ। অবশ্য এই রাত্তিরে নেতাদের বক্তৃতারও তেমন গুরুত্ব নেই, দু'দিকের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত হাত মেলানোই বড় কথা, মাঝখানের বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই তো মিলনপর্ব শুরু হয়ে গেছে। মধ্য রাত্রি পার হওয়া মাত্র সমস্ত গীর্জায় গীর্জায় ঘন্টা, কনসার্ট হলে ধ্বনিত হল বিটোফোনের নাইনথ সিমফনি, আকাশে ভাসলো আলোর মালা। সঙ্গীত ও আালোর মধ্যেই ঘোষিত হল জার্মান জাতির পুনর্জন্মের বার্তা।' (পৃষ্ঠা; ১৩-১৪)    

লেখক বর্ণনা দিয়েছেন একত্রিত জার্মানির প্রথম দিনটিরও। সেদিন ছিল ছুটি, চারদিকে আনন্দ-উল্লাস। সাথে অনেকেই হাতুড়ি-খন্তা দিয়ে ভাঙছে বিভেদের সেই কঠিন দেওয়াল। ১৯৬১ সালে নির্মিত ১৫৫ কিলোমিটারের বার্লিন দেয়াল ছিল খুবই শক্তপোক্ত এক প্রাচীর। এর ভেতরে ছিল লোহা বাসানো রি-ইনফোর্সড কংক্রিট। প্রবল হাতুড়ির আঘাতেও যার সামান্য চলটা উঠানো কঠিন ছিল। লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী, যারা এই বিভেদের দেওয়াল তৈরি করেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন এই বিভেদ চিরস্থায়ী হবে। কিন্তু মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়নি। জয় হয়েছে ভালোবাসার। 

জার্মানির মিলনপর্ব শেষে লেখক কয়েকজন বন্ধুর সাথে গিয়েছেন হাঙ্গেরি। তখন সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত হয়ে হাঙ্গেরি নতুন করে পথচলা শুরু করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে যাওয়র আগে সুনীল বর্ণনা দিয়েছেন দেশটির রাজধানী বুডাপেস্টের। বুডা ও পেস্ট মূলত দুটি আলাদা নগরী। যাকে বিভক্ত করেছে ইউরোপের সর্ববৃহৎ দানিয়ুব নদী। এই দুই নগর মিলে আধুনিক রাজধানী শহর বুডাপেস্ট। এছাড়া এই পর্বে বর্ণনা আছে হাঙ্গেরির জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ইমরে নেগির রাজনৈতিক উত্থান ও নির্মম হত্যার।  

হাঙ্গেরি থেকে লেখক গেছেন রুমানিয়া। এই অংশে দেশটির একনায়ক নিকোলাই চওসেস্কুর ক্ষমতায় টিকে থাকা ও একনায়কতন্ত্রের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আছে তাঁর কিছু পাগলামীর কাহিনীও। রুমানিয়ার স্বৈরশাসক চওসেস্কু ও তাঁর স্ত্রীর ছিল পরমায়ু পাওয়ার বাসনা। যেজন্য তারা নানা কা-কীর্তি করেছেন। 

এরপর লেখকের গন্তব্য ছিল পোল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের শুরুতেই যে দেশটি দখলে নিয়েছিল হিটলার। পরের কয়েক বছরে দেশটির প্রায় ৩০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে হিটলার বাহিনী। ঔই যুদ্ধে দেশটির রাজধানী ওয়ারশ প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছিল। এই শহরের উপর নাৎসিদের ছিল ভয়াবহ আক্রোশ। শহরটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করেছিল সেনারা। এছাড়া হিটলার বাহিনী যখন পোল্যান্ড দখল করে তখনকার পোলিশ সেনারা যে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়েছিল, তারও বর্ণনা দিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। পোল্যান্ড ভ্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমাজতন্ত্রের পতন নিয়ে একটি বিশেষ বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, 'পরপর এতগুলি দেশ সমাজতন্ত্র প্রত্যাখান করল, তার কারণ সর্বত্রই এক, একই নজির। এক পার্টির শাসনে পার্টি সদস্যরা হয়ে যান সর্বেসর্বা।...পার্টির উঁচু মহলের কর্তারা আজীবন ক্ষমতা দখল করে থাকে, তাদের নড়ানো যায় না, শ্রমিকরা পায় না কল-কারখানার নীতি নির্ধারণের কোনও ভূমিকা, যুব সমাজ পায় না সমাজ পরিচালনার কোনও অধিকার।' (পৃষ্ঠা:৮৩)

এরপর লেখক দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী রাশিয়ার বিবরণ। এই অংশে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগে সমাজতন্ত্রীদের অভ্যুত্থান চেষ্টা নিয়ে একটা আলোচনা আছে। সোভিয়েন ইউনিয়ন পতনের আগে কৃষ্ণ সাগরের তীরে একটি অবকাশ কেন্দ্রে মিখাইল গর্বাচভকে অবরুদ্ধ করেছিল একটি দল। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন ইউরি প্লাখনভ। এরপর জাতীয় বার্তা সংস্থায় প্রেসিডেন্ট অসুস্থ বলে খবর প্রচারিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল গর্বাচভ সব ক্ষমতা ইয়ানাইয়েভকে দিয়েছেন। এ সময় দৃশ্যপটে আসেন বরিস ইয়েলেৎসিন। যিনি নানা নাটকীয়তার পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই পর্বে লেখক ছিলেন মস্কো ও লেনিনগ্রাদে। লেখক যখন লেনিনগ্রাদে তখন ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁর মূল্যবান বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। যা খুবই যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। 

সুনীল উল্লেখ করেছেন, মানুষের নিত্য পণ্যের নিশ্চয়তা দিতে না পারা এবং চিন্তা ও বাক স্বাধীনতা না থাকার কারণেই সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ছিল অসাধারণ প্রচেষ্টা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, 'মাক্সবাদী সমাজতন্ত্র শুধু আধুনিক চিন্তাই নয়, তাতে প্রকৃতপক্ষে অনেক আশার বাণী আছে। শ্রেণী বিলোপ, উৎপাদনের সমবন্টন, দেশের সম্পদের অধিকার থাকবে রাষ্ট্রের হাতে, রাষ্ট্রই সব মানুষের জীবিকা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে, এসব প্রতিশ্রুতি তো আছেই, তাছাড়া ধর্মীয় প্রভেদ একেবারে মুছে দিতে চেয়েছে। ... ধর্মীয় মূর্খতার জন্য মানুষের যে কত ক্ষতি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।' (পৃষ্ঠা: ১১১)  

ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমায় মুগ্ধ করেছে, আপনাকেও করতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

13h ago