আসহাব উদ্দীন আহমদ

সামাজিক মুক্তির প্রাণপুরুষ

যুগে যুগে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় যারা মানুষ ও মানুষের মুক্তির জন্য সারাজীবন লড়ে যান। নিজের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ছাপিয়ে এরা কাজ করে যান মানুষের জন্য।  জঞ্জাল পরিষ্কার করে একটা বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন এদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। সংবেদনশীল হৃদয় ও কোমল ব্যক্তিত্বের এসব মানুষ দিনশেষে অনেকটা একা, নিভৃত জীবনে চলে যান। ধীরে ধীরে তাঁরা হারিয়ে যান স্মৃতির তলে।

তেমনি একজন বিস্মৃতপ্রায় সাধক পুরুষ অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ। চট্টগ্রামের বাশখালী থানায় ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে তার জন্ম।

আসহাব উদ্দীন আহমদের পারিবারিক নাম আসহাব মিয়া। সেকালে চট্টগ্রামের মুসলমান পরিবারের ছেলে সন্তানের নামের সাথে মিয়া লেখা ছিলো একটা স্বীকৃত প্রথা। বাণীগ্রাম সাধনপুর হাইস্কুলে পড়ার সময় একজন স্কুল পরিদর্শক তার নাম বদলে দেন। আসহাব মিয়া হয়ে ওঠেন আসহাব উদ্দীন। বিদ্যালয় পরিদর্শক তাকে জানতে চেয়েছিলেন, ভবিষ্যৎ জীবনে কী হতে চাও?' আসহাব উদ্দীন আহমদ 'শিক্ষক হতে চাই'- উত্তর দেওয়ায় পরিদর্শক মহোদয় খুশি হলেও পরবর্তীতে তার শিক্ষকরা তাঁকে তিরস্কার করেন। কারণ শিক্ষকরা নিজেরা জানেন এদেশে শিক্ষকের মর্যাদা অত্যন্ত তলানিতে। আমরা শিক্ষার উন্নতি চাই, শিক্ষকের কথা না ভেবে।

মেধা ও প্রখর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করে প্রিন্সিপাল মহোদয় তাকে কলেজের ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেন। বর্তমানে তার বিপরীত চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই পত্রিকার পাতায়। টাকা এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তি না থাকলে আজকাল মেধাবীদের জন্য শিক্ষকতার পথ রুদ্ধ।

কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাসের পর আসহাব উদ্দীন আহমদ চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার শিক্ষকতায় আসার বিষয়টা এখানে খুলে বলা প্রাসঙ্গিক। আগেকার দিনে ভালো শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় নিযুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা সবার মধ্যে ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষের কাছে যান একটি প্রত্যায়ন পত্রের জন্য। তার আগ্রহ অন্তত একটা হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করবেন। মেধা ও প্রখর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করে প্রিন্সিপাল মহোদয় তাকে কলেজের ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেন। বর্তমানে তার বিপরীত চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই পত্রিকার পাতায়। টাকা এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তি না থাকলে মেধাবীদের জন্য শিক্ষকতার পথ রুদ্ধ।

চট্টগ্রাম কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি চট্টগ্রাম ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, যা বর্তমানে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, ফেনী কলেজ, লাকসাম নাবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা করেন। এক যুগেরও বেশি শিক্ষকতা জীবনের তিনি ইতি ঘটান রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন বাংলাদেশের যাবতীয় আন্দোলন সংগ্রামে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিলো সর্বাগ্রে। বর্তমানে যা আর তেমন হয় না।

রাজনৈতিক হিসেবে আসহাব উদ্দীন ছিলেন গণমানুষের নেতা। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে মাওলানা ভাসানীর সাথে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপে যোগদান করেন। কৃষকদের দুর্দশা দূর করার জন্য আজীবন লড়ে গেছেন আসহাব উদ্দীন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষকদের সংগঠিত করেন তিনি। ১৯৫৪-১৯৫৭ পর্যন্ত সময়ে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বাঁশখালী আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। বাঁশখালীর সাথে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনন্য।

তিনটি বস্তু ব্যতীত ব্যক্তি টিকে থাকতে পারেন না—বিদ্যাচর্চা, ব্যবসা ও রাষ্ট্রশাসন। বলেছেন শেখ সাদী। রাজনীতিতে মোহভঙ্গের কারণে হতাশ হলেও আসহাব উদ্দীন নিজেকে গুটিয়ে নেননি মানবসেবা বো বিদ্যাচর্চা থেকে। বেছে নেন লেখালেখি। তাঁর মনে হতে থাকে হেনরি ডেভিড থরোর  সেই উক্তি, 'সমাজের একজন ব্যক্তিকেও যদি অন্যায়ভাবে জেলে নেওয়া হয়, বিবেকবান মানুষের কাছে পুরো সমাজটাকেই জেল মনে হয়'—ধ্রুব সত্য। দার্শনিক থমাস হবসের মতে, 'পৃথিবীতে স্বল্পসংখ্যক মানবিক ও সৃষ্টিশীল মানুষ জন্মগ্রহণ করে; যারা নিজের স্বার্থকুন্ডলিতে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে অপরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মতো উদারতা দেখাতে পারে।'

বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাথে যুক্ত হয়ে  আসহাব উদ্দীন আহমদ পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৬। উল্লেখযোগ্য বই; 'সেরা রম্যরচনা', 'বোকামিয়ার ইতিকথা', 'ঘুষ', 'ধার', 'বাঁশ সমাচার', 'দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ', 'ভূমিহীন কৃষক কড়িহীন লেখক' , 'উজান স্রোতে জীবনের ভেলা', 'ভাতের বাংলা কাপড়ের বাংলা', 'ইন্দিরা গান্ধীর  বিচার চাই','হাতের পাঁচ আঙ্গুল', 'মেইড ভেরি ইজি', 'বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর', 'সের এক আনা মাত্র', 'জান ও মান', 'ডেনজার সিগনাল' ইত্যাদি।

লেখালেখিতে তিনি অত্যন্ত অল্পসময়ের মধ্যে পাঠকের নজর কাড়েন। তার ব্যঙ্গাত্মক এবং রম্যরচনা সমাজে বিদ্যমান অনাচার, কুসংস্কার, দুর্নীতি এবং সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরেন। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, "রীতিমতো সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায়, আমি তা নই, খেয়ালের চাপে লিখি। খেয়াল না চাপলে মাথায় লাঠির বাড়ি মারলেও কলম দিয়ে কিছু বের হয় না।'

আলম চৌধুরী আসহাব উদ্দীন আহমদ ও সমাজের মুক্তিভাবনা গ্রন্থে আসহাব উদ্দীন আহমদের লেখালেখি সম্পর্কে বলেন, 'বাস্তবতার নির্দয় কামড় তাঁর বিবেককে লিখতে প্ররোচিত করে। তাই তিনি প্রথাগত সাহিত্যিকদের ছায়ারূপ থেকে সরে এসে নিজস্ব শৈলীতে লিখেছেন। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।'

একজন কীর্তিমান শিক্ষক ও মুক্তিকামী লেখক আসহাব উদ্দীন আহমদ জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত সমাজের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

ভলতেয়ারের একটা কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি ক্লাসে। তিনি বলেছিলেন, 'Cultivate your own garden'। অর্থাৎ নিজের সৃজনশীলতাকে চর্চা করো। সেটা প্রতিকূল বা বিপন্ন যে পরিবেশেই হোক না। আসহাব উদ্দীন আহমদ তাই করতেন। সমাজকে জাগাতে, মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য তিনি দীর্ঘসময় আত্মগোপনে থেকেও চালিয়ে গেছেন লেখালেখি ও রাজনৈতিক কর্মসূচী। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'বোকামিয়ার ইতিকথা' পাঠ হতে পারে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস জানার পথে সহায়ক। ত্রিকালদর্শী এই পন্ডিত ও সমাজ চিন্তক আজীবন ছিলেন বাংলাদেশ প্রেমিক। তিনি ২০০৫ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।

একজন কীর্তিমান শিক্ষক ও মুক্তিকামী লেখক আসহাব উদ্দীন আহমদ জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত সমাজের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ, সাতকানিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাই স্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাই স্কুল ও বাহারছড়া রত্নপুর হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৯৪ সালের ২৮ মে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ত্রিশতম জন্মবার্ষিকে এই মহান শিক্ষক, ত্যাগী রাজনীতিবিদ ও গুনী সমাজ চিন্তককে স্মরণ করছি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

42m ago