গ্রীষ্মের ফুল

নিঠুর নগরে কোমল মনোহর

বাতাসে বিষ। প্রায় ৮২ শতাংশ এলাকা কংক্রিটের আচ্ছাদনে ঢেকে থাকা রাজধানী ঢাকার পুরোটাই যেন তাপীয় দ্বীপ। টানা কয়েক দশকের অপরিকল্পিত নগরায়ণে ধ্বংস হয়ে গেছে এ শহরের বৃক্ষরাজি।
হাতিরঝিলের সোনালুবীথি। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

বাতাসে বিষ। প্রায় ৮২ শতাংশ এলাকা কংক্রিটের আচ্ছাদনে ঢেকে থাকা রাজধানী ঢাকার পুরোটাই যেন তাপীয় দ্বীপ। টানা কয়েক দশকের অপরিকল্পিত নগরায়ণে ধ্বংস হয়ে গেছে এ শহরের বৃক্ষরাজি। জলাভূমি নেই বললেই চলে। সবমিলিয়ে জনস্রোতে উপচে পড়া দুই কোটি মানুষের এই মহানগর পরিচিত হয়েছে প্রবল মানসিক চাপের শহর হিসেবে। এতটুকু কোমলতা কিংবা নৈঃশব্দের পরিসর এখানে বিরল।

এরপরেও বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে তলানিতে থাকা নিষ্ঠুর-ঊষর এই রাজধানীর এখানে-ওখানে যতটুকু সবুজের অস্তিত্ব টিকে আছে, তার সিংহভাগ জায়গায় এখন গ্রীষ্মের ফুলের রাজত্ব।

গোলাপিরঙা সোনালু। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

বসন্তকে যেমন অবিতর্কিতভাবেই ঋতুরাজ বলা যায়, তেমন গ্রীষ্মকে পুষ্প উৎসবের ঋতু বললে ভুল হবে না। এই উৎসবে এখন রাজপথের দুই ধারে মাথা দোলাচ্ছে বেগুনি জারুল, স্বর্ণাভ সোনালু, রক্তিম কৃষ্ণচূড়া। সেইসঙ্গে এত প্রতিকূলতার ভেতরেও টিকে থাকা নগর উদ্যানগুলোয় শোভা পাচ্ছে নাগেশ্বর, রাধাচূড়া, গুস্তাভিয়া, কাঠগোলাপ, ডুলিচাঁপা, উদয়পদ্ম, মধুমঞ্জুরি, কনকচূড়া ও ঝুমকোলতার মতো বহু বর্ণের ফুল।

এর পাশাপাশি আছে পাদাউক, পেল্টোফোরাম, কমব্রেটাম, পালাম, গোলাপি রঙা সোনালু, নাগেশ্বর, হিজল, জ্যাকারান্ডা ও কুরচির কোমলতা।

বেগুনি জারুল। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা মনে করতেন, ফুলহীন বিশ্বে মানুষের সৌন্দর্যচিন্তার বিকাশ অবশ্যই খণ্ডিত হত। 'নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা' গ্রন্থে সংকলিত 'কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন' শীর্ষক প্রবন্ধে তাকে বলতে শোনা যায়, 'মানুষ ফুলের প্রতি প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছে তার জন্মের বহুযুগ পরে, কেবল জ্ঞানী হয়ে ওঠার, হোমোস্যাপিয়েন্স হয়ে ওঠার পর। এক সময় তারই কল্যাণহস্তের ছোঁয়ায় অনাকর্ষী বনফুল হয়েছে অপরূপ মধুগন্ধী, দীর্ঘায়ু।'

ওই প্রবন্ধেই মানুষের জীবনে আনন্দময় অনুষঙ্গ হয়ে ওঠা ফুলের মাহাত্ম্য বর্ণনায় দ্বিজেন শর্মা বলেন, 'ইরাকী কুর্দিস্তানে নিয়ানডার্থাল মানুষ এক লক্ষ থেকে ষাট হাজার বছর আগে মৃতদের ফুলসহ কবর দিত। ক্রমাগনন মানুষ শিল্পবুদ্ধির পরিচয় রেখে গেছে বিশ হাজার বছর আগের আঁকা ফ্রান্সের গুহাচিত্রে।'

গ্রীষ্মের ফুলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন কৃষ্ণচূড়া। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, জংলী গাছের ফল-ফুল-কন্দ আহরণ থেকে মানুষ দশ হাজার বছর আগে নব্যপ্রস্তরযুগে কৃষিবিদ্যা আয়ত্ত করে। শিখে নেয় শস্য, ফলমূল ও সবজি চাষের কৌশল। সৃষ্টি করে কিছুটা প্রাচুর্য ও অবসরের অবকাশ। আর তখনই মানুষ 'প্রয়োজনের জগৎ থেকে মুক্তির জগতে' উত্তীর্ণ হয়। ভালোবাসতে শেখে অপ্রয়োজনীয়কেও। বলতে শেখে, 'যেথা যত ফুল আছে বনে বনে ফুটে, আমার পরশ পেলে খুশি হয়ে ওঠে।'

কিন্তু নিঠুর ঢাকার পথে পথে ফুটে থাকা গ্রীষ্মের মনোহর ফুলের দল কাছে-পিঠে মানুষের পরশ পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে কিনা তা বুঝতে পারাটা কঠিন। তবে ফুলের কাছে গেলে মানুষের ভালোলাগায় যে কোনো কমতি হয় না, তা হয়তো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

মধুমঞ্জরী। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

খররোদের তপ্ত দিনে ঢাকার পথে পথে জৌলুশ ছড়ানো কৃষ্ণচূড়ার কাছে গেলেই এর প্রমাণ মিলবে। ঢাকা শহরে কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন জাতীয় সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন সড়ক। এছাড়া বিজয় সরণি, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের চারপাশ, রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বেইলি রোড, হাতিরঝিল, কাকরাইল ও বিমানবন্দর সড়কে রক্তিম কৃষ্ণচূড়াবীথি নান্দনিক সুষমা ছড়িয়ে দিয়েছে শহরের পরিবেশে।

এছাড়া জারুল আর পেল্টোফোরামের শোভা দেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, হাতিরঝিলে। রমনায় পাওয়া যাবে উদয়পদ্মের দর্শন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চোখ ধাঁধাঁনো জারুলবীথিও মনোমুগ্ধকর।

বিরল নাগলিঙ্গম। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গেলে দেখা যাবে নীল জ্যাকারান্ডা। ভিনদেশি এই ফুল নীল কৃষ্ণচূড়া নামেও পরিচিত।

উদ্ভিদ উদ্যানে এর পাশাপাশি দুষ্প্রাপ্র নাগলিঙ্গমও ফুটেছে। আছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও রমনার শ্যামল প্রান্তরেও।

গ্রীষ্মের আরেকটি সুন্দর ফুল সোনালু। উজ্জ্বল সোনালি হলুদ রঙের জন্য এমন নামকরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা, ওসমানী মিলনায়তন, সুপ্রিমকোর্টের সামনের এলাকা ও বলধা গার্ডেনসহ আরও অনেক এলাকায় চোখে পড়বে কোমল-মনোহর এই ফুল।

কাঠগোলাপের সাদার মায়া। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

আর কাঠগোলাপ বা গোলক চাঁপার শোভা দেখা যাবে জাতীয় জাদুঘর, বেইলি রোড, ভিকারুননিসা স্কুল, শিশু একাডেমী ও ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে। সাদা, সাদা-হলুদ বা গোলাপি রঙের পাঁচ পাপড়ির এই ফুলের আদি নিবাস মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা ও মধ্য ভারতে। এই ফুল নিয়েই নজরুল লিখেছিলেন, 'ম্লান আলোকে ফুটলি কেন গোলক-চাঁপার ফুল/ভূষণহীনা বনদেবী কার হ'রি তুই দুল…'।

Comments

The Daily Star  | English
US dollar price rises

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago