বৈশ্বিক গড় থেকেও দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় গড়ে ৩ দশমিক ৪২ মিলিমিটার। তবে সরকারি এক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। ওই গবেষণা বলছে, এতে খাদ্য উৎপাদন ও জীবিকার ওপর ধারণার চেয়েও বেশি প্রভাব পড়বে।

উপকূলীয় ১২টি জেলায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে এসব অঞ্চলে জলাবদ্ধতা, উচ্চ লবণাক্ততা, ফসলের ক্ষতি, উচ্চ তাপমাত্রা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া এই গবেষণার ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। সমীক্ষার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মানুষজন তাদের ঘরবাড়ি হারাবে এবং দারিদ্র্য বাড়বে।

১৯৯৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গাঙ্গেয় জোয়ার-ভাটা প্লাবনভূমি, মেঘনা মোহনা প্লাবনভূমি এবং চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় বার্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ যথাক্রমে ৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার থেকে ৪ দশমিক ৫ মিলিমিটার, ৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার থেকে ৪ দশমিক ১ মিলিমিটার এবং ৩ দশমিক ১ মিলিমিটার থেকে ৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে দেখা যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত 'এস্টিমেশন অব সি লেভেল রাইজ (এসএলআর) ইন বাংলাদেশ ইউজিং স্যাটেলাইট আল্টিমেট্রি ডেটা' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমান হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি চলতে থাকলে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

গবেষণায় পলি জমার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে এই গবেষণার প্রধান গবেষক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, গবেষণায় স্যাটেলাইট আল্টিমেট্রি ডেটা ব্যবহার করে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে পানির স্তরের পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়েছে।

তিনি বলছিলেন, পলি জমার বিষয়টির সঙ্গে মাটির দেবে যাওয়াকেও তারা হিসেবে নিয়েছেন এবং দেখা গেছে বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার এই অঞ্চলে বেশি। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় জনগণের জীবন ও তাদের জীবিকায় ঝুঁকি বাড়বে।

লবণাক্ততা, উপকূলীয় প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাড়বে। এর প্রভাব পড়তে পারে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল সরবরাহ এবং উপকূলীয় অবকাঠামোর ওপর।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন ও এর বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৬ সালে জোয়ার-ভাটার তথ্য ব্যবহার করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেছিল।

উভয় গবেষণারই প্রকল্প পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন) মির্জা শওকত আলী বলেন, বিশেষজ্ঞরা স্যাটেলাইট আল্টিমেট্রি ডেটা ব্যবহার করে ২০১৬ সালের গবেষণার ফলাফল যাচাই এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়নের সুপারিশ করেছিলেন।

পরে পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট এবং সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) মাধ্যমে এই গবেষণাটি করে। যাতে অর্থ যোগান দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড। গবেষণায় নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও সিইজিআইএসের পরিচালক মোতালেব হোসেন সরকার।

মহাকাশ থেকে সমুদ্রের স্তর পরিমাপ করে এমন বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। যেখানে নাসা এবং ফরাসি অ্যারোস্পেস এজেন্সির টোপেক্স/পসেইডনের মতো স্যাটেলাইট যেমন ছিল তেমনি জেসন-১, ২ এবং ৩ এর পাঠানো তথ্যও ছিল।

বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা সময়ের সাথে সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সামগ্রিক প্রবণতা বোঝার চেষ্টা করেন।

গবেষণার অন্যতম লেখক মোহন কুমার দাস গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশ কয়েকটি নিখুঁতভাবে তৈরি মানচিত্র রয়েছে যা নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে থাকবে। এগুলো বাংলাদেশের উপকূলরেখা বরাবর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী অভিযোজন কৌশল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে।'

প্রভাব

'উপকূলীয় অঞ্চলের পানি, কৃষি ও অবকাঠামো খাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব' শীর্ষক আরেকটি গবেষণার মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়।

গবেষণায় ২০৩০, ২০৫০, ২০৭০ এবং ২১০০ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি কেমন হতে পারে তা ধারণা করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে।

এতে দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২১০০ সাল নাগাদ উপকূলীয় অঞ্চলের ১২ দশমিক ৩৪ থেকে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এর প্রভাবে প্লাবিত হবে বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, গোপালগঞ্জ, যশোর, ঝালকাঠি, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও শরীয়তপুর পর্যন্ত।

তিনি বলেন, 'যতভাবেই হিসেব করা হয়েছে তাদের সবটিতেই দেখা গেছে ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশাল সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই জেলাগুলিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ এসব জেলায় কোনো বন্যা সুরক্ষার জন্য পোল্ডার জাতীয় ব্যবস্থা নেই। প্লাবিত অঞ্চলগুলি বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ উপকূলীয় তাই এসব এলাকাকে বন্যা রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অভ্যন্তরে লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, 'এসএলআর যত বেশি হবে, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা তত বেশি হবে। এটি দক্ষিণ-মধ্য অঞ্চলকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে এবং এই অঞ্চলের কৃষি উত্পাদনশীলতা হ্রাস করবে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বন্যায় আমন ফসল উৎপাদনে ৫ দশমিক ৮ থেকে ৯ দশমিক ১ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে।

তিনি বলেন, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ২০৫০ থেকে ২০৮০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত পাঁচ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ বেশি হবে।

২০৮০ সালে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।

গবেষণায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য স্বয়ংক্রিয় জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস গেট স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড থেকে আসা বরফ গলা পানিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হবে।

'উপকূলীয় অঞ্চলের পানি, কৃষি ও অবকাঠামো খাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব' শীর্ষক গবেষণা পর্যালোচনা করে নিশাত বলেন, ৬০-৭০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিম্নাঞ্চলীয় বদ্বীপ এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা বেশি হবে এবং উচ্চমাত্রার ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হতে পারে।

গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, পিরোজপুর এবং ঝালকাঠির মতো দেশের মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিশেষ সুরক্ষা প্রয়োজন।

'ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জের মধুমতির পানি শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত থাকে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

4h ago