গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা কি জলবায়ুর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ?

কপ-২৮ সম্মেলনে যোগ দিতে বিশ্বের বহু দেশের নেতারা সমবেত হয়েছেন দুবাইয়ে। এটি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের বার্ষিক সম্মেলন। সেখান থেকে দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার (এক হাজার ৫০০ মাইল) পশ্চিমে গাজায় ইসরায়েলের মুহুর্মুহু নির্বিচার হামলা চলছে।
উত্তর গাজার জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরায়েলের বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আছেন মুষড়ে পড়া এক ফিলিস্তিনি। ছবি: রয়টার্স

কপ-২৮ সম্মেলনে যোগ দিতে বিশ্বের বহু দেশের নেতারা সমবেত হয়েছেন দুবাইয়ে। এটি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের বার্ষিক সম্মেলন। সেখান থেকে দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার (এক হাজার ৫০০ মাইল) পশ্চিমে গাজায় ইসরায়েলের মুহুর্মুহু নির্বিচার হামলা চলছে।

দুই মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ১৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছয় হাজার ছয়শ'র বেশি শিশু। পরিবেশের ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গাজার সক্ষমতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

দূষিত পানি সরবরাহ থেকে শুরু করে পুড়তে থাকা ভবন ও মরদেহ থেকে উড়তে থাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন বাতাস- গাজার জনজীবনকে দূষণে ছেয়ে ফেলেছে। 

রামাল্লা-ভিত্তিক সংগঠন ইকোপিস মিডল ইস্টের ফিলিস্তিনি পরিচালক নাদা মাজদালানি আল জাজিরাকে বলেন, 'এই যুদ্ধ গাজার পরিবেশকে সবদিক থেকেই ধ্বংস করে দিয়েছে।'

গাজায় ইতোমধ্যে তাপমাত্রা বেড়েছে। এই অঞ্চলে অবিরত বোমাবর্ষণ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলছে তা দেখে নেওয়া যাক। চলতি শতাব্দীর শেষে গাজার গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইসরায়েলি বোমা হামলা যেভাবে গাজার জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলছে

গত ১৬ বছর ধরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অবরোধে আছে গাজা। এমনকি গাজায় অন্যান্য জিনিসের মতো জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ইসরায়েলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর পরিচালিত হয়।

এ কারণে গাজার বাসিন্দারা ঘর-বাড়ি আলোকিত করতে সৌরশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

নাদা মাজদালানি বলেন, 'গাজাবাসী জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, তাদের ৬০ শতাংশ শক্তি আসছে সৌরশক্তি থেকে।'

তবে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ হাজারো ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যার অনেকগুলোর ছাদেই সোলার প্যানেল বসানো ছিল।

ইকোপিস মিডল ইস্টের ফিলিস্তিনি পরিচালক বলেন, 'সোলার প্যানেল ধ্বংসের মাধ্যমে কেবল মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকাকেই টার্গেট করা হয়নি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং ক্লিন এনার্জি ব্যবহারে গাজাবাসীর যে প্রচেষ্টা, সেটিকেও ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে।' 

তিনি আরও বলেন, 'ভবনগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে সৌর স্থাপনাগুলোও এখন ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে, যা গাজার জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে পিছিয়ে দিয়েছে।'

গাজার প্রধান পরিবেশগত উদ্বেগগুলো কী কী

নাদা মাজদালানি বলেন, 'যুদ্ধ চলাকালে গাজার পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ ও সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।'

'তবে কিছু বিষয় পরিষ্কার। পচতে থাকা মরদেহ ও দূষিত পানির সরবরাহ একটি 'টাইম বোমার' মতো আভির্ভূত হচ্ছে, যার ফলে দ্রুত বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে', বলেন তিনি।

ইকোপিস মিডল ইস্টের ফিলিস্তিনি পরিচালক বলেন, 'এই মুহূর্তে এটিই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এবং বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলসহ সবারই চিন্তিত হওয়া উচিত। কেননা কলেরা ছড়ালে যুদ্ধের ময়দানে থাকা ইসরায়েলি সেনারাও এর থেকে রক্ষা পাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।'

আসন্ন বর্ষা আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। নাদা মাজদালানির দলের ধারণা, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার গ্যাস, পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ৪৪ শতাংশ আংশিক অথবা পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এরমধ্যে পানির কূপ এবং বর্জ্য পরিশোধনাগারও রয়েছে। ইতোমধ্যে পয়োনিষ্কাশনের পানি দ্বারা গাজার রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। এখন এই নোংরা পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশলে কলেরা ও অন্যান্য গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কনফ্লিক্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অবজারভেটরি'র পরিচালক ডোগ উইয়ার বলেন, 'যুদ্ধে গাজার পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা শীতের বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিলে বন্যার তোড় বাড়িয়ে তুলবে।'

এই যুদ্ধের আগেও গাজার অপ্রতুল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ ঘাটতির ফলে পয়োনিষ্কাশনের অপরিশোধিত পানি সাগরে ফেলা হচ্ছিল, যা গাজার ২৫ শতাংশ রোগের জন্য দায়ী। এ ছাড়া, গাজা উপত্যকায় শিশুমৃত্যু হার বেশি হওয়ার প্রাথমিক কারণও এই দূষিত পানি।

নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল জানায়, অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় জ্বালানি প্রবেশে সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করলে সেখানকার বর্জ্য-পানি ব্যবস্থাপনা প্লান্টগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর ফলে ভূমধ্যসাগরে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য পতিত হচ্ছে, যাতে গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।

ডোগ উইয়ার বলেন, 'চলমান যুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের কারণে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ও উচ্ছিষ্ট জমে সুয়ারেজ লাইনগুলো বন্ধ হয়ে আছে। এর ফলে যত নোংরা পানি জমবে, মানুষের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি তত বাড়বে। বর্জ্য পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশে ছড়িয়ে দেবে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ।' 

কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকি 

অতীতের মতো এই যুদ্ধেও প্রচুর পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন পড়ছে, যা কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশ দূষণকে অত্যধিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল গাজায় ২৫ হাজার টনের মতো বিস্ফোরক ফেলেছে বলে কিছু প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়। এর ফলে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, তা প্রায় দুই হাজার ৩০০ বাড়ির বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের সমান কিংবা চার হাজার ৬০০ যানবাহনের বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের সমান।

বিশ্বের সামরিক বাহিনীগুলো যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ও অস্ত্র চালনার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে, যা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের শতকরা ৫ দশমিক ৫ ভাগ। এর পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে, কেননা কোনো প্রতিরক্ষাবাহিনীই তাদের কার্বন নিঃসরণের সঠিক তথ্য দিতে বাধ্য নয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় সাদা ফসফরাস ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। এটি গাজায় 
দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে বলে জানিয়েছেন নাদা মাজদালানি। 

তিনি বলেন, 'গাজায় বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসিড বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সাদা ফসফরাসের কারণেই এমনটি ঘটবে।'

তার মতে, যারা প্লাস্টিক শিট ব্যবহার করে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে কিংবা যারা পানি সংকটের দরুন সরাসরি বৃষ্টির পানি পান করে- তারা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএ জানায়, যুদ্ধের প্রথম দিককার সপ্তাহগুলোতে গাজায় প্রতি ঘণ্টায় ৪২টি বোমা ফেলেছে ইসরায়েল।

ডোগ উইয়ার বলেন, 'অস্ত্রশস্ত্র থেকে কার্বন নিঃসরণের পাশাপাশি এগুলোর তৈরিকারকদেরও দায় রয়েছে পরিবেশ দূষণে। কেননা অস্ত্র উৎপাদনের সময় আরও বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়। যেমন- অস্ত্রের ধাতবিক আবরণ তৈরির সময়।'

ইউক্রেন থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, সেখানে যুদ্ধের প্রথম সাত মাসে বাতাসে ১০০ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসৃত হয়েছে। 

গাজার ক্ষেত্রে কী হবে

ডোগ উইয়ার বলেন, 'আমাদের অনুমান, এই যুদ্ধে অধিকাংশ কার্বন নিঃসরণ ঘটবে ইসরায়েলের সামরিক জ্বালানি ব্যবহার, ইসরায়েলের টার্গেট হামলায় বিধ্বস্ত ভবন এবং অগ্নিকাণ্ড থেকে এবং গাজাকে নতুন করে গড়ে তুলতে গিয়ে।'

অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে আছে আগুন, বিধ্বস্ত ভবনের চূর্ণ-বিচূর্ণ উপাদান- যার মধ্যে অ্যাসবেসটস'র মতো ক্ষতিকর উপাদান ও বিপজ্জনক উপকরণযুক্ত বিষয়বস্তু থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ। 

'এমনকি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকাগুলো পুনরায় গড়ে তুলতে গেলে ধ্বংসস্তূপ থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ঘটতে পারে। ভবন পুনর্নির্মাণের সময় কনক্রিট ও সিমেন্ট প্রস্তুতকালেও প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসৃত হয়, যা জলবায়ু সংকট বাড়িয়ে তুলতে পারে', যোগ করেন ডোগ উইয়ার।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রথম ছয় সপ্তাহে গাজায় যে পরিমাণ আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে, তা পুনর্নির্মাণ করতে গেলে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হবে তার একটি খসড়া পরিমাপ করেছেন যুদ্ধে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হিসাবকারী এক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লেনার্ড ডি ক্লার্ক।  

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, 'নির্মাণ সংক্রান্ত উপাদানগুলোর উৎপাদন ও নির্মাণ প্রক্রিয়া মিলিয়ে ৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন কার্বন নির্গত হবে।'

২১ মাস ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের বিপরীতে গাজায় মাত্র দুই মাসের যুদ্ধে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা পুনর্নির্মাণ করতে গেলে যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হবে তা ইউক্রেনের ৫ গুণ।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা
 
গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

Comments