শতবছর পূর্বের চিত্র

বৃষ্টির জন্য নামাজ, ব্যাঙের বিয়ে ও গীত

আজ সব ছাপিয়ে আলাপের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে— 'গরম'। রাজধানী থেকে প্রান্তিক অঞ্চল সবখানেই এক‌ই দশা। এই তাপে জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত ফসলের মাঠ‌ও চৌচির। কর্পোরেট চাকরিজীবী থেকে কৃষক— সকলের জীবনে হাহাকার চরমে। বাধ্য হয়ে যে যার বিশ্বাস অনুযায়ী প্রার্থনা করছেন।

কেউ বৃষ্টির জন্য খোলা ময়দানে নামাজ আদায় করছেন, কেউ লোকাচার রীতিতে বিয়ে দিচ্ছেন ব্যাঙের, কেউ বা আবার গানে-গীতে স্মরণ করছেন সৃষ্টিকর্তাকে— মিনতি জানাচ্ছেন বৃষ্টির জন্য। বাংলায় বৃষ্টির জন্য নামাজ, ব্যাঙের বিয়ে এবং গীত— কোনোটিই নতুন নয়। শতবছর পূর্বের চিত্র‌ও তেমন ভিন্ন ছিল না। যে যার মতো বৃষ্টির জন্য চেষ্টা করতেন।

বৃষ্টির জন্য নামাজ

বৃষ্টির জন্য যে নামাজ আদায় করা হয় তাকে ইসলামী পরিভাষায় 'ইসতেসকার নামাজ' বলা হয়। এই পরিভাষা যে বাংলায় নতুন নয় তা আমরা ইবরাহীম খাঁর স্মৃতিকথা থেকে বুঝতে পারি।

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালে, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে। ছোটবেলায় তিনি বৃষ্টির জন্য শরিক হয়েছিলেন নামাজে। এই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন 'বাতায়ন'-এ: "বিষ্টি হয়তো আসত, হয়তো আসত না। না এলে এ গাঁয়ের মাতবরেরা বলাবলি করত: 'একলা বললে চলবে না রে! আর মাঠের মাটি ঘাস পুড়ে খাক হয়ে গেল, এখন ছায়ায় বসে ডাকলেও চলবে না। চল যাই দলে দলে মাঠে, সেইখানে আগুন-ঝরা রোদ মাথায় নিয়ে এছতেছকার নামাজ পড়ি।' সেই মত‌ই কাজ হত, দলে দলে লোক গিয়ে বিষ্টির নামাজে শরীক হত।"

বেগম সুফিয়া কামালের জন্ম বরিশালের শায়েস্তাবাদে, ১৯১১ সালে। তাঁর বাল্যজীবনের স্মৃতিপটেও দেখা মেলে বৃষ্টির নামাজের। লিখেছেন: "বৃষ্টি না হলে সবাই খালি মাথায় খালি পায়ে খোলা মাঠে নামাজ পড়তেন। মেয়েরা ভিজা কাপড়ে ভিজা চুলে দোওয়া দরুদ পড়তেন। বৃষ্টি সত্যিই হত।" সুফিয়া কামালের এই ভাষ্যে দেখা যাচ্ছে, পুরুষরা যখন খোলা মাঠে নামাজ আদায় করছেন বৃষ্টির জন্য তখন নারীরা বসে নেই ঘরে, বরং তারাও দোওয়া দরুদ পড়ে বৃষ্টির জন্য দোয়া করছেন। বৃষ্টির এবাদতে পুরুষের সাথে নারীর উপস্থিতি শতবছর পূর্বেই ছিল— অবিশ্বাস্য না হলেও বিস্ময়কর তো বটেই!

নামাজের আরেকটি স্মৃতিচারণ পাওয়া যায় শামসুল হকের আত্মকথায়। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৫ সালে, রংপুরে। বৃষ্টির জন্য নামাজ প্রসঙ্গে লিখেছেন: "আমাদের বাড়ির পাশে গোয়ালকূলৈ পানিশূন্য বিলে বাজানের সঙ্গে গিয়েছিলাম এস্তেস্কার নামায পড়তে। উপস্থিত হাজার হাজার গ্রামবাসী মাথার তালুগলা রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কান্নাকাটি করেছিলেন বৃষ্টির জন্য। আল্লাহর কি মর্জি। একটু পর আকাশ জুড়ে মেঘ এল। বিকাল বেলা বড় বড় ফোঁটায় নামল ঝমঝম বৃষ্টি। তৃষিত ধরণী পানি পেয়ে ঠাণ্ডা হলো। আমরা ছোটরা বৃষ্টির পানিতে ভিজতে বা গোসল করতে বেড়িয়ে পড়ি আনন্দ কলরব করতে করতে।"

টাঙ্গাইল, বরিশাল ও রংপুরের মুসলিম সমাজে যে শতবছর পূর্বেও বৃষ্টির জন্য নামাজের রীতি সচল ছিল তা তিনজনের সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণিত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম সমাজেও যে এই সচলতা ছিল না তা বলা যায় না। আর বর্তমান তাপদাহে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির জন্য সবাই মিলে নামাজ পড়ে দোয়া করছেন মুসুল্লিরা। এসব দৃশ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

ব্যাঙের বিয়ে

ব্যাঙের বিয়ের মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য আহ্বানের রেওয়াজ বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। বহু আগ থেকেই অনেক জায়গায় বিষয়টি প্রচলিত। বর্ষাকাল ব্যাঙের প্রিয় ঋতু। তাই ব্যাঙের অত্যধিক ডাকাডাকি বৃষ্টির পূর্বাভাস বলে গণ্য করা হয়। খনার বচনে আছে:

ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন/ শীঘ্র বৃষ্টি হবে জান।

প্রচণ্ড তাপদাহে অনাবৃষ্টিতে মেয়েদের নেতৃত্বে দুটি ব্যাঙ ধরে এনে পানিভর্তি একটি গর্তে রেখে কাল্পনিক বিয়ে দেওয়া হয়। তখন সমস্বরে উপস্থিত সকলে ছড়া পাঠ করে। যেমন:

বেঙ্গী ছেড়ীর বিয়া

সোনার লাডুম দিয়া
বেঙ্গীলো মেঘ নামাইয়া দে।
চাচা মিয়া কান্দন করে ক্ষেতের আইলে ব‌ইয়া
ক্ষেত খলা বিরান অ‌ইল পানি না পাইয়া।
বেঙ্গীলো মেঘ নামাইয়া দে।
 

ব্যাঙের বিয়ের বিভিন্ন ধরনের রীতি বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত আছে। কিন্তু রীতি যাই থাকুক কেন্দ্রে থাকে ব্যাঙের বিয়ে। এই বিয়ে-বাড়িতে আবৃত্তির জন্য রচিত আরো একটি ছড়া:

বেঙ্গের ঝির বিয়া গো,
গিরস্থের অলদী দিয়া।
ও বেঙ্গি মেঘ দেছ না কেয়্যা॥
বেঙ্গের ঝির বিয়া গো,
আফন মেন্দীর পাতা দিয়্যা।
ও বেঙ্গি মেঘ দেছ না কেয়্যা॥

ব্যাঙের বিয়ের উল্লেখিত পদ্ধতি ও আবৃত্তির জন্য রচিত ছড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এটি একটি উৎসবমুখর ব্যাপার। যেখানেই এটি অনুষ্ঠিত হয় সেখানেই একটি উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। বৃষ্টির জন্য হাহাকার আর ব্যাঙের বিয়ের আমোদে তৈরি হয় অন্য এক পরিবেশ।

বৃষ্টির ছড়া, গীত ও শিন্নি

অনাবৃষ্টিতে ছড়া ও গীত গাওয়ার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করার রেওয়াজ‌ও বাংলায় বেশ পুরনো। উল্লেখিত ব্যাঙের বিয়ের সময় আবৃত্তির জন্য রচিত ছড়া ও গীত ছাড়াও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা-কাতর ছড়াও দুর্লভ নয়। যেমন:

আয় রে বৃষ্টি আয়
চ‌ইড়া মেঘের নায়।
তুই না আইলে ভাই,
ক্ষেত খোলার ফসল যে আর
রক্ষা নাহি পায়।

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর স্মৃতিতেও এমন বেশ কিছু ছড়ার উপস্থিতি আছে। তিনি লিখেছেন: "অনেক দিন বিষ্টি না হলে বয়স্ক বাচ্চারা গাঁয় গাঁয় দল বাঁধত, বাড়ী বাড়ী ঘুরত, বড়রা কলসে কলসে পানি এনে বাইর-বাড়ীতে ঢালত, তারপর গড়াগড়ি দিত। বাচ্চারা অন্দরে চলে যেত; বাড়ীর বৌ-ঝিরা কলসে কলসে পানি এনে ঢেলে দিত; ওরা আনন্দে গড়াগড়ি দিত আর বিষ্টিরে ডেকে গান ধরত:

এতের কুলা

বেতের বান্দ

গুড়গুড়াইয়া
বৃষ্টি আন।

দু-চারটা গড়াগড়ি দিয়ে ওঠার পর আবার গাইত :

দেওয়া গোল করিল রে,

পুবান চালায় বাও

সমুদদুরে টলমল করে

কাছেম সাধুর না ও

দেওয়া গোল করিল রে।

না! বিষ্টির মেজাজ তবু নরম হয় না। তখন তারা কাতর হয়ে হাত উপরের দিকে তোলে:

ধান গেল মরিয়া

ধানের ছোবা ধরিয়া

সোনার বিষ্টি নামরে

শরীল গেল পুড়িয়া।"

বৃষ্টির জন্য গীত গাওয়ার রেওয়াজ এখনও দৃশ্যমান আমাদের দেশে। চলমান তাপদাহেই কিছু কিছু জায়গায় গীত গাওয়ার দৃশ্য অনলাইনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 'আল্লা মেঘ দে, পানি দে ছায়া দেরে তুই/ আল্লা মেঘ দে'— গানটি শতাধিক বছর আগেও বাংলায় অনাবৃষ্টিতে হরহামেশাই গাওয়া হতো। বৃষ্টির দোয়া নিয়ে রচিত গীতের মধ্যে এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। অনেক সময় পাড়ার ছেলেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরতো গাইতো:

আসমানের উপর খোদার ঘর

মন্দির মসজিদ তারপর

হায়রে খোদা পানি দে

মোদের গুনা তুলে নে।

হাইলা তারা তেরো ভাই,

লাঙল ধুইতে পানি নাই।

আল্লাহর কাছে দোয়া, ব্যাঙের বিয়ে এবং গীত সব একাকার হয়ে গেছে আজিজ মিছির বর্ণিত স্মৃতি থেকে। ১৯২৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করা আজিজ মিছির এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন: "অনেকদিন বৃষ্টি হচ্ছে না। জমি শুকিয়ে ঠন্ ঠন্। হাল চাষ করা যাচ্ছে না, সবার গালে হাত। কে যেন বললো, চল বৃষ্টির মাংগন করি। বৃষ্টির মাংগন করলে বৃষ্টি হইব! ঠিক আছে। কী করতে হবে? একটি ভাংগা কুলায় বিশকাটালি গাছ রেখে তার সঙ্গে একটি জ্যান্ত ব্যাঙ বেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হবে। মুখে থাকবে আল্লা মেঘ দে পানি দে গান। সবাই চাল ভিক্ষা দেবে। ওটা রান্না করে খাওয়াও হবে।

অনাবৃষ্টি ও তাপদাহে কাতর হয়ে নিরুপায় বাঙালি মুসলমান বৃষ্টির জন্য উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে আসছেন শতবছর ধরে। কিছুটা হেরফের হলেও অনাবৃষ্টি ও খড়ায় ধর্ম ও ভৌগলিক সংস্কৃতির আশ্রয় নেওয়ার এই ধারাবাহিকতা বাংলায় আজ‌ও চলমান।

যে বাড়িতে যাব সে বাড়ির মেয়েরা এগিয়ে এসে এক কলস পানি ঢেলে দেবে ব্যাঙ বহনকারীর মাথায়। আমার উপর দায়িত্ব পড়লো (বলা যায় দায়িত্ব চাপিয়ে দিল সবাই যুক্তি করে) ব্যাঙের কুলা মাথায় নেবার। কল্পনা করুণ সারাদিন গ্রামের এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরেছি। প্রত্যেকে এক কলসী পানি ঢেলেছে এবং এক পুরা চাল দিয়েছে। সারাদিন ভিজে সন্ধ্যা হতে না হতেই জ্বর এলো। ওই জ্বরে বেহুঁশ তিন দিন। অনেক কষ্টে জ্বরের হাত থেকে মরতে মরতে রেহাই পেয়েছিলাম। মাংগনের ভাত খাওয়া আর হয়নি।"

এখন দেখা যাচ্ছে, আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া, ব্যাঙ এবং বৃষ্টির গীত সব‌ই উপস্থিত! ধর্ম এবং লোকাচার এমনভাবে মিশে গেছে এই পদ্ধতিতে যা বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিরও ইঙ্গিত বহন করে। বৃষ্টির পানি মাংগনের উছিলায় উত্তোলিত চাউল দিয়ে শিন্নি খাওয়ার রেওয়াজও ছিল। এর মাধ্যমে মূলত উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হতো এবং সবাই উপভোগ করতো। বাউল শাহ আব্দুল করিমের 'ভাটির চিঠি' ব‌ইতে এই প্রসঙ্গে পাওয়া যায়:

"মাঘে বৃষ্টি না হইলে ছিল এক বিধান।

ছোটো মেয়েরা গাইত বেঙ্গাবেরি গান॥

মাঘ মাসে মিলে-মিশে গ্রামের নওজোয়ান।

সু-বৃষ্টির মানসে গাইত বাঘাই শিন্নির গান৷৷

বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে চাউল পয়সা পাইত।

শিন্নি তৈয়ার করে তারা মিলে মিশে খাইত॥"

অনাবৃষ্টি ও তাপদাহে কাতর হয়ে নিরুপায় বাঙালি মুসলমান বৃষ্টির জন্য উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে আসছেন শতবছর ধরে। কিছুটা হেরফের হলেও অনাবৃষ্টি ও খড়ায় ধর্ম ও ভৌগলিক সংস্কৃতির আশ্রয় নেওয়ার এই ধারাবাহিকতা বাংলায় আজ‌ও চলমান।

Comments

The Daily Star  | English

Time to build the country after overcoming dictatorship: Tarique

Highlights need to build skilled generations across all sectors

45m ago