কতটা জরুরি আনোয়ার পাশা অধ্যয়ন

আনোয়ার পাশা। ছবি: সংগৃহীত

মানুষ আসে, মানুষ যায়, কেউ কেউ বেঁচে থাকে স্মৃতির আয়নায়। মানুষ মরে গেলেও মরে না তার কাজ। তখন কেবল দেহান্তর ঘটে ওপারে, মরে না কখনও কভু। বেঁচে থাকে নিজ ভাষায়, নিজ দেশে, নিজের সংস্কৃতিতে।

শিক্ষক, গবেষক, সাহিত্যিক, দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা আনোয়ার পাশার ক্ষেত্রে এমন অজস্র বাক্য সৃজন করলেও তার অবদান শেষ করা যাবে না। বাংলা ও বাংলাদেশের আকাশে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তার নাম।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আনোয়ার পাশাকে যেভাবে স্মরণ করা উচিত তা কি আমরা করছি? এ প্রজন্ম কি ভুলে যাচ্ছে তার অবদান? রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি কতটা স্মরণীয়-বরণীয়—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সময়ের দাবি।

আনোয়ার পাশা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস তার হাতে ঋদ্ধ হয়েছে। নিখাদ দেশপ্রেমের অনুপম সমাবেশ তার লেখায় উদ্ভাসিত। সমকালীন সমাজ-ভাবনা নিয়ে তিনি লিখেছেন। বাস্তব পরিস্থিতি প্রকাশ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিকে বড় করে দেখেননি।

সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজচেতনা এবং এই চেতনার মাধ্যমেই মুক্তি—লেখার মূল উদ্দেশ্য তার। সন্ধানী মনে খুঁজেছেন সমাজের শোষক ও শোষিতের চিত্র।

'নীড় সন্ধানী' এমনই একটি শক্তিশালী উপন্যাস। দেশভাগের সংকট নিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি। প্রধান চরিত্র হাসান। বিএ পাশ করে সে ঢাকায় না এসে গ্রাম থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন কলকাতায়। পাকিস্তানের বন্ধুরা তাকে শেষ পর্যন্ত বলেছিল, 'হিন্দুদের সাথে থাকা যাবে না হে, ওদেশ ছেড়ে দিয়ে এখানেই চলে আসার ব্যবস্থা কর।'

তার মায়ের ইচ্ছাও এমনটাই, 'কবে হিন্দুরা আমাদের বেইজ্জতির একশেষ করে দেবে বাবা! তার চেয়ে সম্পত্তি বিনিময় করে চল আমরা ওদেশে চলে যাই।'

কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হাসান তা মানতে নারাজ, 'মানলাম না তোমাদের কথা। হাজার হলেও তো রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ ওদের সমাজেই জন্মেছেন। যে সমাজে ঐ সব মহাপুরুষ জন্মেছেন সে সমাজ আর কতটুকুই বা অনুদার হতে পারে বল?'

ঔপন্যাসিক অত্যন্ত দক্ষতায় এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছেন, সেই সঙ্গে চরিত্রায়নও। রাজনৈতিক উপন্যাসকে তিনি সামাজিক উপন্যাসে পরিণত করেছেন। তাই দেখা যায়, উপন্যাসের বাণী হয়েছে সমাজের মুক্তির হাতিয়ার। উপন্যাসের সমাজ-রাজনৈতিক ভাষ্য, তর্ক-বিতর্ক স্থান পেয়েছে অনিবার্যরূপে। প্রতিটি বাক্য যেন অগ্নিস্ফুরণ। বিদ্রোহ-বিপ্লবের, ন্যায়-অন্যায়ের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান। আখ্যান, প্লট ও চরিত্র নির্মাণের কুশলতা উপন্যাসটিকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। ঔপন্যাসিক পরাধীন দেশে থেকে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছেন সাহিত্যিক দক্ষতায়।

রাজনৈতিক কুশীলবদের কাছে ধর্না না দিয়ে মুক্তমনের সাহিত্য রচনায় তিনি জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে আলোচ্য উপন্যাস। তাইতো হাসান সমাজের কথা বলে, সমাজের মানুষের হতাশার চালচিত্র কথোপকথনে ফুটিয়ে তোলে অবলীলায়। এ যেন সংলাপ, মুক্তির সনদ। নীড়ের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপরেখা। সরল কথার বুননে রচিত উপন্যাসটি সমাজের দর্পণ। নিঃশব্দ প্রতিবাদের রূপায়ক এই 'নীড় সন্ধানী'। এর বাস্তবরূপের প্রকাশ দেশভাগসহ পরবর্তীকালের সব আন্দোলনের ধারায়।

দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত 'নীড় সন্ধানী'তে আনোয়ার পাশা ঔপনিবেশিক সময়ের প্রতিকূল বাস্তবতাকে শৈল্পিক তত্ত্বাদর্শে মানবচৈতন্যের পটে সমাজচিত্র বিধৃত করেছেন। সাহিত্যিক ভাষারূপ দিয়ে তিনি উদ্ভাসিত করেন স্বসমাজ মানসকে, স্বকালীন বাস্তবতাকে এবং পরমকাল সৃদশ আদর্শকে।

বিরূপ প্রতিবেশে ঐতিহ্য ও সমাজবাস্তবের আত্মকরুণ, বেদনাবিহ্বল চিত্র প্রকাশ করলেও লেখায় আবেগতাড়িত হননি। বরং আত্মচৈতন্য জাগ্রত করে সমাজচৈতন্যে অগ্রসর হয়েছেন। নীড়ে ফেরা আকুতি অবশেষে পরিপুষ্টি লাভ করে স্বপ্নসারথিতে। ফলে দেশভাগ অতি জরুরি বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। কিন্তু তাতে সংকটের সমাধান হয়নি। প্রকটতর পরিবেশে দুর্বিষহ জীবনের হাতছানি সিদ্ধান্তহীনতার যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে জনপ্রান্তর। কিন্তু স্বপ্নপিপাসু মানুষের জীবন থেমে থাকেনি, সম্মুখপানে অগ্রসর হয়েছে নতুন জীবন সন্ধানে। ঔপন্যাসিক এখানে জীবনের জয়গানকেই আলোকিত করেছেন।

'রাইফেল রোটি আওরাত' উপন্যাসটি রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে সংঘটিত গণহত্যা এবং পরবর্তীকালের সমাজবাস্তবতার চিত্র।

আনোয়ার পাশা উপন্যাসের আধেয় করেছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। ফলে পাঠক সমাবেশে তা ইতিহাস পাঠে পরিগণিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়রূপে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত 'রাইফেল রোটি আওরাত' ইতিহাস গবেষণার আকর-গ্রন্থ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আনোয়ার পাশা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রচনা করেছেন গ্রন্থটি। তিনি ছিলেন নির্ভীক দেশপ্রেমিক, শিক্ষক ও সাহিত্যিক। লেখার পরতে পরতে দেশপ্রেমের এমন অনুপম প্রকাশ বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে সত্যিকার অর্থে বিরল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনুসন্ধানী মন নিয়ে অবলোকন করেছেন পাকিস্তানি শাসকের স্বৈরাচারি মনোভাব। পূর্বপাকিস্তানি শান্তিকামী মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বেলিত জীবনকে ভস্মীভূত করেছেন দেশমাতৃকার কল্যাণে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পরবর্তীকালের বর্ণনা আছে এ উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়ের কালের সাক্ষী হয়ে থাকা 'রাইফেল রোটি আওরাত' বহন করে চলেছে বেদনাবিধূর চিহ্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক সুদীপ্ত শাহীন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। প্রকান্তরে এ চরিত্রের আড়ালে আনোয়ার পাশা নিজের ছবিই এঁকেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছেন দেশের ক্রান্তিকালে বিভিন্ন মানুষের মনস্তত্ত্ব।

প্রধান চরিত্র সুদীপ্তের কণ্ঠে আমরা যেমন যুদ্ধের হত্যাযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের বিপর্যয়ও দেখি, সেইসঙ্গে নতুন দিনের স্বপ্নবুননের ছবিও দেখি।

আনোয়ার পাশা উপন্যাসটি শুরু করেছেন 'বাংলাদেশে নামলো ভোর' এই চরণ দিয়ে। আর শেষ করেছেন 'নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূরে। বেশি দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈঃ! কেটে যাবে।'

ঔপন্যাসিকের মনোদর্শন পূরণ হয়েছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ। আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা। কিন্তু আনোয়ার পাশা স্বাধীনতার সেই ক্ষণের সারথি হতে পারেননি। আলবদর, আলশামস বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবী হত্যায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেছিল, সেই তালিকায় প্রথম সারিতে ছিলেন আলোচ্য ঔপন্যাসিক। তিনি ঘাতক আলবদর কর্তৃক অপহৃত ও নিহত হন।

১৯২৮ সালে মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া আনোয়ার পাশা হয়ে উঠেছিলেন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ। মাত্র ৩৯ বছরের জীবন পরিসীমায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার নাম সাহিত্যে স্থান পেয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই তার মুক্তিকামী মন খুঁজে ফিরেছে মানুষের শোষণ মুক্তির উপায়। সাহিত্যে সে ধারণারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। স্বাধীন দেশের পাখির কিচিরমিচির শব্দের মুখরতার স্বপ্ন এঁকেছিলেন তিনি। সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র রূপান্তরের স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ—বড় এই দুই মুক্তির আশার বাণী দেখিয়েছেন বাংলার মানুষকে। সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও এর প্রতিকার। গণমানুষের মুক্তির স্বাদ তার সাহিত্যে বড় জায়গা করে নিয়েছে। আনোয়ার পাশা অধ্যয়ন মানে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধের চর্চা।

সময়ের গতির সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার চিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে—বলা যাবে না। কারণ শোষণ-শাসন-পোষণ রাজনীতির পিষ্টে প্রতিনিয়ত মানবহৃদয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।

স্বাধীন একটি দেশের অভ্যুদয় মানেই মানুষের মুক্তির নিশ্চয়তা নয়। এখনও দৃশ্যমান সমাজের অন্ধ্রে অন্ধ্রে বৈষম্যের কষাঘাত। শাসক ও শোষকের ব্যবধান হ্রাস না পেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা হতাশার কারণ। আনোয়ার পাশা ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও জীবনাভূতির মিশেলে সাহিত্য রচনা করেছেন।

দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নির্ভর উপন্যাসে আবদুল মালেক, আবদুল খালেক, সোবহান মৌলভী, হাসিম শেখসহ চরিত্রগুলোর মধ্যে সুপ্ত রয়েছে মানুষের এক পূর্ণাঙ্গ জীবনসত্য। পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবসত্তার সংগ্রাম স্পৃহার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চরিত্রের মধ্যে আনোয়ার পাশা দেখিয়েছেন পাকিস্তানি মনোভাবের প্রতি সমর্থন। সমাজে এরূপ চরিত্র এখনও দুর্লভ নয়। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিকাশে তারা প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধ পরিবেশ তৈরির পায়তারায় লিপ্ত। আনোয়ার পাশা বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই। তার ভবিষ্যৎ দর্শন শক্তির প্রাচুর্যতা সহজেই অনুমেয়।

আনোয়ার পাশা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ছোটবেলা থেকেই মানবমুক্তির কল্যাণে কাজ করেছেন। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রনাথ সরকারের জন্মশতবার্ষিকী পালন করার অপরাধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত করে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতাকালে তিনি 'সাহিত্য মজলিশ' নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন।

এ সংগঠনের মাধ্যমে সচেষ্ট হয়েছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবোধ তৈরিতে; সেইসঙ্গে পাবনাতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে। মুক্তিযুদ্ধে নিজের অর্থ ছাড়াও অন্যদের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করে পাঠিয়ে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। গোপনে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের গোপন প্রচারপত্রে। তার ছিল মুক্তির উদ্দেশ্যে লড়ে যাওয়ার প্রত্যয়। এ মনোভাব থেকেই উৎসারিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উপন্যাস 'রাইফেল রোটি আওরাত'।

আনোয়ার পাশার লেখার মূল বৈশিষ্ট্য হলো, রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা। এর সারবত্তা শক্রকবলিত অবরুদ্ধ জীবনের। বিপন্ন ও ভীত প্রেক্ষাপট কিন্তু তাতে আশার কমতি নেই। এ যেন মৃত্যু গ্রাসের মধ্যে বসে মৃত্যুকে রোখার বিবরণ।

তার এই রচনাকে তুলনা করা যায় ইলিয়া এরিনবুর্গের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কাহিনী নিয়ে রচিত 'ফল অব প্যারিস' কিংবা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ নিয়ে রচিত আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ের লেখা 'ফর হোম দ্য বেল টোলস'র সঙ্গে।

আনোয়ার পাশা এপ্রিলেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে স্বাধীনতা আসন্ন। চিরকালেই দর্শন শক্তিসম্পন্ন লেখকেরা ধ্বংসের মুখে আশার বার্তা দিয়ে যান; তিনি তা-ই করেছেন সাহিত্যে।

আনোয়ার পাশা অধ্যয়ন সর্বদা প্রাসঙ্গিক। তরুণ প্রজন্মের কাছে অবশ্য পাঠ্য তার রচনা। বিজয়ের প্রভা উদ্ভাসনে তার সাহিত্য কালের ধ্বনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপ-রূপায়নে আনোয়ার পাশার সাহিত্য জীবনোপলব্ধির এক বড় ক্যানভাস।

জীবনের প্রতি স্তরে মানুষ বিপদ ও বিপথের সম্মুখীন হয়। তখন তার মধ্যে তৈরি হয় একধরনের সিদ্ধান্তহীনতা। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে কখনো কখনো। আনোয়ার পাশার লেখাগুলো এ পরিস্থিতিতে সহায়ক হতে পারে। সমাজে দুর্নীতি, অন্যায়, বৈষম্য দূরীকরণেও ভূমিকা পালন করতে পারে এসব রচনা।

মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও গণমানুষের অধিকার আদায়ে তার লেখা তৈরি করতে পারে দৃঢ়প্রত্যয়। আনোয়ার পাশা লিখেছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চেতনা জাগাতে। সেই চেতনা হবে মুক্তির পথ। মত ও পথের বিবিধ সম্ভাবনার মধ্যে তৈরি করতে চেয়েছেন সংযোগ সেতু। তাতে তিনি সিদ্ধহস্তের পরিচয় দিয়েছেন।

আনোয়ার পাশা অধ্যয়নের মধ্যে মানবমুক্তির নিশানা বিধৃত। রাষ্ট্রীয়ভাবে আনোয়ার পাশার চর্চা বেগবান করা অপরিহার্য। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তার লেখা বিভিন্ন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন তার দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক বাণী। তাহলে উন্নত রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পাশাপাশি আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব হবে।

সমাজে অযাচিত মানুষের দেশদ্রোহী মনোভাব নির্মূলে তার লেখা সর্বদা আধুনিক। স্বাধীন ও সমাজসচেতন মানুষ সবসময় স্বপ্ন দেখে ভালো কিছুর। সেখানে বিদ্রোহ ও বিপ্লব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বড় অবস্থান। আনোয়ার পাশা মানবিক মানুষের চিত্রপটে কল্যাণের জয়গান গেয়েছেন। স্বপ্নাতুর মানুষের জয়ের আকাঙ্ক্ষার তীব্র বাসনার বীজ অন্তরে বুনেছেন। সত্যিকার সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক, সমাজ পরিবর্তনের কারিগর হতে হলে এসব রচনা আস্বাদনের প্রয়োজনীয়তা অনেক।

সর্বোপরি আনোয়ার পাশার জীবন ও সাহিত্যদর্পণ পাঠের মাধ্যমে তীব্র জাতীয়তাবোধ তৈরি ও তার বাস্তবায়ন আমাদের সংস্কৃতি রূপান্তরে সবিশেষ কল্যাণ আনতে সহায়ক হবে।

আনোয়ার পাশার লেখনীতে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী, পাকিস্তানি শাসকচক্রের নৃশংসতা, দেশীয় কতিপয় লোকের বিপথগামিতা। এসব ঘটনা ঘটেছে দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতায়। এ ত্রিবিধ অধ্যয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতির আদি-অন্ত জানা সম্ভব।

দুভাবে এ সংক্রান্ত তথ্য আমরা পেতে পারি। প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। দ্বিতীয়ত, বইপুস্তক থেকে—কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ প্রভৃতি উৎস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স ৫৩ বছরের অধিক। মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বেঁচে নেই। যারা জীবিত তারা আগামী ৩০ বছরের মধ্যে কেউ বেঁচে থাকবেন না। সেক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান অবলম্বন হবে বই-পুস্তক।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এমন ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে নতুন প্রজন্ম অধ্যয়নের মাধ্যমে জীবনে তা রূপায়িত করতে পারে। আফ্রিকায় ১৯৬০ এর দশকে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশে রাজনীতি হারিয়ে গেছে, গণতন্ত্র হয়েছে উধাও। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য পূর্বপুরুষেরা যে আত্মাহুতি দিয়েছেন তা নতুন প্রজন্মকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয়।

আমাদের দেশের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস জানতে হলে আনোয়ার পাশা অধ্যয়নের পথ সুগম করতে হবে।

ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

$14b a year lost to capital flight during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

16h ago