করোনা মহামারির পর শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২০ গুণ

করোনা মহামারির পর শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২০ গুণ
স্টার ফাইল ফটো | ছবি: শেখ এনামুল হক/স্টার

সাতক্ষীরার একটি কলেজে অনার্স পরীক্ষার কয়েক মাস পর চাকরির সন্ধানে ২০১৮ সালে ঢাকায় আসেন কাজী মঞ্জুরুল। এরও প্রায় চার মাস পর একটি কোম্পানিতে তার চাকরি মেলে।

প্রথম দিকে বেতন কম হওয়ায় ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে বাবা-মাকে টাকা পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন মঞ্জুরুল।

তার বেতন কিছুটা বাড়ার পরে ২০১৯ সালের শেষের দিকে তিনি বিয়ে করেন এবং পল্লবী এলাকায় দুই রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নেন।

এরপর আসে কোভিড-১৯ মহামারি। এই সময় কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী তিন মাস মঞ্জুরুলকে বেকার বসে থাকতে হয়। তার পরে তিনি অন্য চাকরি পান, তবে বেতন ছিল আগের চেয়ে কম।

মহামারির কারণে যে লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, মঞ্জুরুল তাদের একজন।

'চাকরি পাওয়ার পরও বাড়ি ভাড়া দেওয়া এবং পরিবারের খরচ চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। ছোটখাটো যে সঞ্চয় ছিল, তাও খরচ করে মাঝে মাঝে গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতাম,' বলেন মঞ্জুরুল।

তবে টিকে থাকতে তিনি অন্য চাকরির সন্ধান চালিয়ে যান। ২০২২ সালে তাদের ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এর পরে মাসগুলোতে খাদ্য দ্রব্যের দাম ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় কিন্তু তার আয় বাড়েনি। গত বছর জুলাই মাসে তিনি গ্রামে ফিরে যান।

'আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি কিন্তু বেতনের ২৫ হাজার টাকায় ঢাকা শহরে আমার পরিবার চালানো, আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ করা অসম্ভব ছিল। ফিরে আসা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। এখন অন্তত বাড়ি ভাড়া দিতে হবে না,' বলেন মঞ্জুরুল।

গ্রামে ফিরে তিনি একটি ছোট পোল্ট্রি খামার চালাচ্ছেন।

জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও চাকরির অভাবে তার মতো বহু মানুষ নিজেদের গ্রামে ফিরে গেছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস' অনুসারে, কয়েক বছর ধরে অনেক বেশি মানুষ শহর থেকে গ্রামে পাড়ি জমাচ্ছেন।

সারা দেশে তিন লাখ আট হাজারের বেশি পরিবারের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, ২০২৩ সালে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ১৩ দশমিক আট জন গ্রামে ফিরে গেছেন। ২০১৯ সালের তুলনায় এ ধরনের অভিবাসন প্রায় ২০ গুণ বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে আসা মানুষের সংখ্যা ২০২২ সালে ছিল ২৬ দশমিক চার; গত বছর সেটি কমে প্রতি হাজারে ১৯ দশমিক ছয় জনে নেমে এসেছে।

স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, রিভার্স মাইগ্রেশনের অন্যতম কারণ এই মহামারি। এক শ্রেণির মানুষ উপার্জনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পেরে শহর ছেড়েছেন।

তিনি বলেন, 'এখনো অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে আসছেন এবং কেউ কেউ চাকরি পাচ্ছেন।'

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছাড়াও বাড়ি ভাড়া ও পরিবহন খরচ বাড়ছে।

অন্যদিকে, বড় শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও মানুষের আয় কমে গেছে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপর্যাপ্ত কাজের সুযোগ এবং জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়—উভয়ের চাপ মানুষকে অভিবাসনে বাধ্য করে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস বলেন, 'গ্রামাঞ্চলে নাগরিক সুবিধা ভালো হয়েছে মনে করে নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ শহর ছাড়ছে। পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিও সেখানে রয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এই গোষ্ঠী মনে করে যে, শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় খুব বেশি এবং নিরাপত্তাহীনতাও রয়েছে।'

অধ্যাপক বায়েস বলেন, শহরের বাইরে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিপরীত অভিবাসনে মানুষ উৎসাহিত হয়েছে।

'যোগাযোগ সহজ হওয়ায় মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। মানুষ শহরে আসে এবং তার কাজ শেষ করে চলে যায়। গ্রামেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আয়ের সুযোগ বেড়েছে। আগামী দিনগুলোতে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে। সেই কারণে আমাদের গ্রামগুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুত করা প্রয়োজন,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Rizvi criticizes PR system in elections

PR system a threat to democracy: Rizvi

Under the PR system, the party, not the people, will choose MPs, he says

4h ago