পর্যালোচনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়াবহ চিত্র : আসিফ নজরুলের `আমি আবু বকর'

আইন বিষয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে লেখালেখি করেন নিয়মিত। তিনি 'নিষিদ্ধ কয়েকজন' উপন্যাসের জন্য ছিলেন আলোচিত। পরবর্তীতে তার পিএইচডির গল্প, কয়েকজন হুমায়ুন, বেকার দিনের প্রেম, উধাও ও ঘোর বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। 'আমি আবু বকর' সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস। যেখানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান ভয়াবহ গণরুম সংস্কৃতি, গেস্টরুম সংকৃতি এবং ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির সংকট উঠে এসেছে।

প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, "বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের হলগুলোতে নির্যাতন করা হয়। সেরকম একটা নির্যাতনের বিষয় এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জাতীয় রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ভূমিকা কেমন, তুলে ধরা হয়েছে। ছাত্রজীবনের প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা এগুলো এসেছে। এসব কারণে হয়তো পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।'

আমি আবু বকরের প্লট আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে কীভাবে তরুণ সমাজকে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং ক্ষমতার রাজনীতি শিক্ষার্থীদের কীভাবে ব্যবহার করছে হীন স্বার্থে।

যে কোনো উপন্যাসের থিম হিসেবে প্রেম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রেমের অনুভূতি, প্রেমে পড়া, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া বা সফল হওয়া, ব্যর্থ প্রেমের আখ্যান প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের আগ্রহ চিরন্তন ও বিস্তর। আসিফ নজরুলের আমি আবু বকর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রেমে পড়া, প্রেমে ভাঙ্গন, প্রেম বিষয়ে প্রজন্মের দর্শন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কারো কারো ছাত্রীর প্রেমে পড়া এবং ছাত্রনেতার প্রেমের চিত্র সযত্নে উঠে এসেছে।

জীবনের শত প্রতিকূলতার মাঝেও আবু বকরের বারবার প্রেমে পড়া, এবং প্রেম নিয়ে নিম্মির অদল-বদল ও হাত বদল আমাদেরকে হুমায়ুন আজাদের প্রেম বিষয়ক সেই বিখ্যাত উক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রেম বিষয়ে অধ্যাপক আজাদ বলেছিলেন, "দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু নেই। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম" যা ইংরেজ কবি লর্ডবায়রনের 'ডন জুয়ানিজম' এর সাথে মিলে যায়।

বাংলাদেশের গোড়ার দিকের ইতিহাসে দেখা যায় এদেশের যাবতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখ-সমরে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রজনতা। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা লাভ, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এবং স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাংলাদেশের ছাত্রনেতৃত্বের বিপ্লবী ভূমিকার কথা আমরা সগৌরবে বলি। আক্ষেপের বিষয় হলো দেশে দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হওয়ার ফলে ছাত্ররাজনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবু বকর স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে বেদম পিটুনির শিকার হয়। নির্যাতিত হয় তারই সহপাঠী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে আবু বকর পরবর্তীতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে তাকে নির্যাতন করা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়। যে অন্যায় তার সাথে ঘটেছিল বলে একসময় তার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল এমনকি জীবন হুমকির মুখে পড়েছিল সেই একই সংগঠনে আবু বকর যোগদান করে। 

উপর মহলের নির্দেশে নিরীহ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্রসংঠনের সাথে জড়িত সন্দেহে পুলিশে দেওয়া, সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠনের উপর হামলা করে নিজ দলের উপর মহলের কাছে নিজের আনুগত্য তুলে ধরা, আয় নেই তবুও বাইক নিয়ে সচ্ছল জীবনযাপন করা, পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘুরাঘুরি করা হয়ে উঠে তার নিত্যকর্ম। এভাবে ছাত্ররাজনীতির কলুষতার কবলে পড়ে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে, মা-বাবার প্রত্যাশা পূরণে মফস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা আবু বকরের কাছে পড়ালেখা বাদে উপরে উল্লেখিত কর্মকাণ্ড মুখ্য হয়ে উঠে।

'আমি আবু আবু বকর' বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান গুরুতর ও ভয়াবহ অসুখের দিকে আমাদের নজর খুলে দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আবাসিক হলগুলোতে হলো ছাত্র নির্যাতন।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদ্যমান দুটি প্রধান সমস্যা ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি। আমি আবু বকর উপন্যাসে দলীয় বিবেচনায়  নিয়োগ, লেজুড়বৃত্তি, প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নতজানু আনুগত্য, প্রভোস্ট, প্রক্টর এবং ভিসি কার্যালয় ঘিরে গড়ে তোলা রাজনৈতিক বলয় দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দেউলিয়ত্ব প্রকাশ করে। এসব রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা সমান আচরণ পান না। রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের জিম্মি করে রাখতে পছন্দ করেন। অনেকটা ক্রিস্টোফার মার্লো রচিত ডক্টর ফস্টাস নাটকের সেই বিষয়বস্তুর মতো। যেখানে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী।

ফস্টাস ক্ষমতা পাওয়ার লোভে শয়তানের প্রতিনিধির হাতে নিজের আত্মা বিক্রি করে দেন চুক্তিতে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আচরণে অসাম্যের প্রমাণ পাই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবু বকর নির্যাতিত হওয়ার পর তার হলের প্রভোস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের আচরণে। তাদের কাছে সকল শিক্ষার্থী সমান, তবে ক্ষমটতাসীন দলের শিক্ষার্থীরা আরেকটু বেশি সমান! অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পদ-পদবী প্রাপ্তির লোভে নিজেদের বিবেক বিকিয়ে দেওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ হন ক্ষমতাসীন দলের হাতে।

'আমি আবু আবু বকর' বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান গুরুতর ও ভয়াবহ অসুখের দিকে আমাদের নজর খুলে দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আবাসিক হলগুলোতে হলো ছাত্র নির্যাতন। উপন্যাসের কথক আবু বকর, তার বন্ধু নাহিদসহ অন্যান্যরা অস্তিত্ব রক্ষার দৌড়ে আপাত দৃষ্টিতে সফল হলেও মিনহাজ নামের একজন ছাত্রকে জীবন দিতে হয় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে। 

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো গদির রক্ষার ঢাল হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন তৈরি হয়। সাধারণ, অসাধারণ এবং বিরোধীয় দলের সমর্থক শিক্ষার্থী এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে তারা। ছাত্ররাজনীতির বর্তমান চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন ছাত্রনেতা নাহিদের বয়ানে। নাহিদের কাছে রাজনীতি মানে হলো, 'জীবনটাই এমন, বুঝেছ? মার দেবে না হলে মার খাবে। এটাই পলিটিক্স।"

বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট অন্যতম সমস্যা। শিক্ষার্থীদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয়। এতে পড়ালেখার পরিবেশ নেই। তার উপর ছাত্ররাজনীতির অন্ধকার দিক। গণরুমে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ ছাত্রদের ডাকে মিটিং, মিছিল, মারামারিতে বাধ্য করা হয়। আসন সংকট ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশহীনতার কথা পাঠকের কাছে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে দেশের উচ্চশিক্ষার হালচাল বুঝার ক্ষেত্রে এই উপন্যাস বিশেষ সহায়ক। 

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

55m ago