অর্থ পাচারের তথ্য আড়াল করেছে এনআরবিসি ব্যাংক
অর্থপাচার, ঋণ অনিয়ম, অতিরিক্ত ব্যয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয় এনআরবিসি ব্যাংক। ৭০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে অপসারণে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে।
তৎকালীন চেয়ারম্যান ফরাসত আলীকে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়। মুজিব ও ফরাসতকে পরিচালক পদ থেকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিষিদ্ধ করে এবং পরবর্তীকালে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়।
কিন্তু নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন এমন একজন, যার বিরুদ্ধে আগেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল এবং ব্যাংকটিতে এখনো অনিয়ম অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংকটির সভার কার্যবিবরণী এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও সুপ্রিম কোর্টের নথির শত শত পৃষ্ঠা গত ছয় মাস ধরে বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অসংখ্য অনিয়ম, এমনকি অস্ত্র দিয়ে ভীতি সৃষ্টির করার মতো ঘটনার বিষয়েও জানতে পেরেছে।
চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে তুলে ধরা হলো কীভাবে ব্যাংকটির উত্তরা শাখা তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের বিষয়টি আড়াল করতে চেয়েছে।
এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার ছয়জন গ্রাহকের অন্তত ৩৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আসেনি এবং শাখাটি এই তথ্য আড়াল করেছে বলে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও মামলার নথি থেকে জানা গেছে।
উপরন্তু, এদের মধ্যে পাঁচটি কোম্পানি ৯০ কোটি টাকার এলসির বিপরীতে কোনো ধরনের রপ্তানি করেনি। যার ফলে ব্যাংকটির ডলারের খরচ হলেও তা আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
২০২১ সালের ১৯ আগস্টে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তরা শাখা গত চার বছরে এই অর্থ ফোর্সড লোন হিসেবে দেখায়।
তথ্য আড়াল করার সুবিধার্থে এরপর সেটিকে সাধারণ ঋণে রূপান্তরিত করে বারবার পুনঃতফশিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে ব্যাংকের সভার কার্যবিবরণী থেকে।
রপ্তানির অর্থ না আসার পরও রপ্তানি নথি জমা না দিয়েই অর্থ তুলে নেওয়া এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটির সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত আছেন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম।
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনটিতে বলা হযেছে, 'বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করা গেছে যে শাখাটি ফরেন ডকুমেন্টারি বিল পার্চেজ লোন অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তাদের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি বিল পরিশোধ করেছে, যেখানে এই বিলগুলো সংশ্লিষ্ট রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা উচিত ছিল।'
গত বছরের ১১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যাংকটির ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগ করা হয়েছে, প্রতারণামূলকভাবে তারা ব্যাংক থেকে ৭৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং ইক্সোরা অ্যাপারেলস নামে একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরির নাম ব্যবহার করে পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পাচার করেছে। রপ্তানি আয় দেশে না আনা ছয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি হলো এই ইক্সোরা।
এনআরবিসির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এনআরবিসি নিয়ে একাধিক তদন্ত হয়েছে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনআরবিসি ব্যাংকে অডিটের পর অডিট করেছে। কিন্তু কোনো ধরনের বিচারিক বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ইক্সোরার সঙ্গে আদনানের সংশ্লিষ্টতা
ইক্সোরার নিবন্ধন সংক্রান্ত নথির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন আদনান ইমাম। এর আগে বেনামি ঋণের মাধ্যমে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত চলাকালীন এনআরবিসি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের সঙ্গে তাকেও ব্যাংকের বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তারা দুজনেই অর্থ পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছেন, একটি 'স্বার্থান্বেষী মহলের তোলা এই অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'।
ইক্সোরার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও অস্বীকার করেছেন আদনান।
দুদকের তদন্ত অনুসারে, ইক্সোরা অ্যাপারেলস ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ টাকার পোশাকের ১২টি চালান যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে। কিন্তু এ বাবদ রপ্তানি আয় দেশে আনেনি।
২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন থেকে তৈরি করা নথি অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকটির বৃহত্তম ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ইক্সোরা ১৯তম।
নথিতে আরও উল্লেখ রয়েছে, কোম্পানিটি এর মোট ঋণের মধ্যে ১১৯ কোটি টাকা ২০২৭ ও ২০২৮ সাল পর্যন্ত পুনঃতফশিল করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এরপরও সময়মতো কিস্তি পরিশোধ না করায় কোম্পানিটির অতিরিক্ত বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকায়।
কোম্পানিটি ২০১৬ সালের আগস্টে এনআরবিসির সঙ্গে ব্যাংকিং শুরু করে।
ওই বছরই কোম্পানিটি যখন প্রথম ঋণ নেয়, তখন এর মালিকদের মধ্যে রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও মাসুদ রানার কাছে ছিল ৪০ শতাংশ করে শেয়ার। এছাড়া, তাদের স্ত্রীদের প্রত্যেকের নামে ছিল ১০ শতাংশ করে মালিকানা। দুদকের মামলায় রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও মাসুদ রানাকে আসামি করা হয়েছে।
২০২৩ সালে এনআরবিসি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা পলিগনের মোট বকেয়া ঋণ গত নভেম্বরে দাঁড়িয়েছিল ৮৭ কোটি ৭০ লাখ টাকায় এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই টাকা আদায়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে।
২০২১ সালে কোম্পানিটির ৮৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ভাইব্রানিয়াম নামে আরেকটি কোম্পানি।
ভাইব্রানিয়ামের নিবন্ধন নথি অনুযায়ী, এর চেয়ারম্যান বদরুল হাসান পাটোয়ারী। তিনি জেনেক্স ইনফোসিস নামে একটি কোম্পানির সেক্রেটারি। সেই জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান আদনান ইমাম।
মাত্র ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে চালু করা হয়েছিল ভাইব্রানিয়াম। কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে চালু করার দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তারা এমন একটি কোম্পানি কিনেছে যাদের রয়েছে ৭৮ হাজার ১৬৪ বর্গফুটের কারখানা ও ৮০০টি মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কারখানার প্রতিদিন আট হাজার পিস পোশাক তৈরির সক্ষমতা আছে।
এনআরবিসি ব্যাংক কোম্পানিটির ঋণসীমা অন্তত আটবার নবায়ন করেছে এবং তিনবারই হয়েছে বদরুল হাসান পাটোয়ারী মালিকানা নেওয়ার পর।
দুদকের মামলায় বদরুল হাসান পাটোয়ারীকে আসামি করা হয়নি। অথচ, দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, একের পর এক ঋণ নিয়েও কোম্পানিটি পরিশোধ করেননি।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গ্রাহকের লেনদেন সন্তোষজনক না হওয়ার পরও ঋণ দেওয়া হয়েছিল।'
২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানিটিকে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচটি আদেশের বিপরীতে তিন লাখ ৫৮ হাজার ২৭৩ মার্কিন ডলার মূল্যের রপ্তানি আয় সামঞ্জস্য করার জন্য ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আদনান ইমাম বলেন, 'ইক্সোরা অ্যাপারেলস এনআরবিসি ব্যাংকের ক্লায়েন্ট এবং আমার সঙ্গে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমাকে বলা হয়েছিল যে, মহামারি চলাকালীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ইক্সোরাও আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল এবং ব্যাংক অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো ইক্সোরাকেও সহায়তা করেছে। আমাকে আরও বলা হয়েছিল যে, পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ টাকা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দুদক বিষয়টি তদন্ত করেছে এবং কোনো সমস্যা খুঁজে পায়নি।'
নিখোঁজ ডলার
এনআরবিসি ব্যাংকের ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কম্প্লায়েন্স ডিভিশনের (আইসিসিডি) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পলিগন ফ্যাশন লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি আট লাখ ৩৩ হাজার ৯২৮ মার্কিন ডলার বা নয় কোটি ১০ লাখ টাকার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি।
কোম্পানিটি পোশাকের চালান পাঠাতেও ব্যর্থ হয় এবং তিন দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এলসি নিস্পত্তি করতে পারেনি, যা খোলা হয়েছিল উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানির জন্য।
২০২৩ সালে ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা ছিল পলিগন। গত বছরের নভেম্বরে কোম্পানিটির মোট বকেয়া ঋণ দাঁড়িয়েছিল ৮৭ কোটি ৭০ লাখ টাকায় এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই টাকা আদায়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে।
এরপর ব্যাংকটির উত্তরা শাখা গাজীপুরভিত্তিক কোম্পানির দায় ৭৪টি ফোর্সড লোনে পরিণত করে।
এত টাকা ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত না হলেও পলিগনকে এই পরিমাণ অর্থ ঋণ দেওয়া হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ফলে গ্রাহক যথাযথভাবে তহবিল ব্যবহার করতে পারেনি। তার তহবিল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল এবং তারা হয়তো তহবিল অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।'
ঋণ অনুমোদন করার আগে চালানের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহকের ক্রেডিট রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হয় ব্যাংককে। কিন্তু তদন্তকালে অডিট দল দেখতে পেয়েছে যে কয়েকজন গ্রাহকের ক্রেডিট রিপোর্ট নেই।
এছাড়াও, রপ্তানির প্রমাণ হিসেবে ব্যাংকটি কোম্পানিটির সব রপ্তানি নথি সংগ্রহ করেনি বলেও দেখেছে তদন্ত দল।
প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, দেনা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পলিগন এই অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। ২০২১ সালের নভেম্বরে ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়।
২০২১ সালের আইসিসিডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকটির ২০তম বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা ছিল ব্লেসিং নিটওয়্যার লিমিটেড।
কোম্পানিটির ছয় লাখ ৬১ হাজার ৮৫ ডলার (সাত কোটি ২০ লাখ টাকা) মূল্যের রপ্তানি আয় ব্যাংকে জমা করা হয়নি। আরও কয়েকটি এলসির বিপরীতে চালান করতে না পারায় ব্যাংককে আরও দুই দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার (২৫ কোটি টাকা) পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি।
এসব ঘটনায় এমনটিই বোঝা যায় যে, ব্যাংকটি আমানতকারীদের স্বার্থের দিকে নজর দেয় না।
প্রতিবেদনে বলা হযেছে, 'দেখা গেছে যে শাখাটি রপ্তানি নিশ্চিত না করে বা অরিজিনাল অথেন্টিকেটেড বিল অব লেডিং না করে অসম্পূর্ণ নথির বিপরীতে গ্রাহককে অযৌক্তিক সুবিধা দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে।'
ফেরত না আসা এই অর্থ ফোর্সড লোনে পরিণত করা হয়েছে এবং কোম্পানিটি এই তহবিল অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর এসব ঋণকে সাধারণ ঋণে পরিণত করা হয়।
ইনসাইড নিট লিমিটেড তাদের রপ্তানির তিন লাখ এক হাজার ১৯১ ডলার বা তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা ফেরত না দিয়ে এই অর্থ ফোর্সড লোনে পরিণত করতে বাধ্য করেছে, যা 'সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত' বলে উল্লেখ করেছে আইসিসিডি।
কারখানা পরিদর্শনকালে আইসিসিডি টিম এলসির বিপরীতে কোনো পণ্যের মজুত দেখতে পায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এতে প্রতীয়মান হয় যে গ্রাহকের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার এবং স্থানীয় বাজারে পণ্যের স্টক ইচ্ছা মতো বিক্রি করেছে।'
উপরন্তু, কোম্পানিটি আরও কিছু চালান পাঠাতে পারেনি। ফলে ব্যাংকের দশমিক নয় লাখ ডলার (নয় কোটি ৭০ লাখ টাকা) এলসির বিপরীতে কোনো ডলার আয় হয়নি।
২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ডিভিশনের সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, 'ব্যাংকের মূলধনের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে নতুন গ্রাহক গ্রহণ সক্ষমতা' এবং 'সুনাম' বাড়াতে এসব ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫এফ অ্যাপারেলস রপ্তানির ১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ফেরত দেয়নি এবং অসম্পূর্ণ রপ্তানি নথির বিপরীতে এই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
চালান সম্পন্ন করতে না পারায় কোম্পানিটি সাত লাখ ডলারের (সাত কোটি ৬০ লাখ টাকা) ঘাটতিও রেখেছিল।
প্রতিবেদন বলছে, 'ব্যাংকটির শাখা কোনো শিপিং নথি ও লেডিংয়ের আসল বিল ছাড়াই আলোচনা করেছে এবং ফলস্বরূপ এই বিলের জন্য কোনো চালান সম্পন্ন করা হয়নি।'
এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক এই অর্থ ফোর্সড লোনে পরিণত করেছে এবং কোম্পানিটি এই তহবিল অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে থাকতে পারে।
২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১২৯তম বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কোম্পানিটির ১২ কোটি ২৩ লাখ টাকার ২৪টি ফোর্সড লোন ১০ বছরের জন্য সাধারণ ঋণে পরিণত করা হয়েছে।
রিলাক্স ফ্যাশন লিমিটেড ৮৫ হাজার ৮২০ ডলার বা ৯৪ লাখ টাকা ফেরত দেয়নি এবং এই ঋণ ফোর্সড লোনে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও, অসম্পূর্ণ রপ্তানির ফলে ব্যাংকের আট লাখ ডলারের (নয় কোটি টাকা) অপূরণীয় এলসি খুলতে হয়েছে।
আইসিসিডি বলছে, 'রপ্তানি নীতি লঙ্ঘন করে রপ্তানি এলসির মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতএব, রপ্তানি আয় ব্যাক-টু-ব্যাক বাধ্যবাধকতা নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত হবে না।'
২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল এনআরবিসি ব্যাংকের বোর্ড সভার কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায়, রেকর্ড থেকে অর্থ পাচারের তথ্য মুছে দিয়ে ফোর্সড লোনগুলোকে 'সাধারণ' ঋণে রূপান্তরিত করে পাঁচ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
ফোন ও ইমেইলের মাধ্যমে সবগুলো পোশাক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে ডেইলি স্টার। তাদের মধ্যে সাড়া পাওয়া গেছে কেবল পলিগনের কাছ থেকে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এলসির মূল্যগুলো ফোর্সড লোন হয়ে যায়।
তিনি বলেন, 'এমন উদাহরণও আছে যে, চালানগুলো পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু ক্রেতারা সেগুলো নেয়নি। আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতারা চালান পেলেও আমাদের অর্থ পরিশোধ করেনি। ফলে ফোর্সড লোন নেওয়া হয়।
এনআরবিসি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান তমাল পারভেজ, যিনি পারভেজ তমাল নামেও পরিচিত, বলেন, ২০১৭ সালে ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রেই এসব খারাপ ক্লায়েন্টদের পান তিনি।
ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তমাল বলেন, 'এগুলো আমানতকারীদের টাকা এবং আমি তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। এসব বেনামী ঋণের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি এবং আমি সেগুলো পুনরুদ্ধার করব।'
তমাল জানান, তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন ব্যাংকের দেওয়া বেশিরভাগ ঋণই ছিল অনিরাপদ ওভারড্রাফ্ট লোন, অর্থাৎ সেগুলোর বিপরীতে কোনো সম্পদ ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এসব ঘটনায় এমনটিই বোঝা যায় যে, ব্যাংকটি আমানতকারীদের স্বার্থের দিকে নজর দেয় না।
'এই ধরনের ফোর্সড লোনের ক্ষেত্রে নির্দেশিকায় কী আছে, তা অবশ্যই দেখতে হবে।'
এই অবস্থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের 'শাসনে ব্যর্থতা' হিসেবেও অভিহিত করেন এই অর্থনীতিবিদ।
'কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকে অডিটের পর অডিট করেছে। কিন্তু কোনো ধরনের বিচারিক বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি', বলেন তিনি।
Comments