সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি কোথায়, যাবেন যেভাবে

মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

ভারতের দ্বিতীয় মুঘল শাসক নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন। সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর ১৫৩০ সালে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসেন তিনি।

পুত্রের জন্য পিতার ভালোবাসা আর ত্যাগের একটি ঘটনা ইতিহাসে বিভিন্ন জায়গায় বর্ণিত হয়েছে, যা কিনা মুঘলদের নাম নিলে লোকমুখে আজও উচ্চারিত হয়। 

ঘটনাটি হলো-একবার সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ুন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। শয্যাশায়ী হুমায়ুনের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সব চিকিৎসাই যখন ব্যর্থ, সে সময় দরবারের হেকিম-দরবেশরা সম্রাট বাবরকে পরামর্শ দিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতে। 

হুমায়ুন সমাধির দ্বিতল। ছবি: সোমনাথ দত্ত

সম্রাট বাবর প্রিয় বস্তু হিসেবে নিজের জীবন বেছে নিলেন। এরপর হুমায়ুনের শয্যার চারপাশে তিন বার ঘুরে আল্লাহর কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে ছেলের জীবন ভিক্ষা চান, আর এভাবেই প্রার্থনা করতে থাকেন।

আশ্চর্যজনকভাবে কিছুদিন পর হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন আর বাবর শয্যাশায়ী হন। সবকিছু ছাপিয়ে পিতৃস্নেহের জন্য ইতিহাসে অমর হয়েছেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর।

২২ বছর বয়সে পিতার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার সামলাতে প্রচণ্ড বেগ পোহাতে হয় সম্রাট হুমায়ুনকে। ষড়যন্ত্র আর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিল্লিও ছাড়তে হয়েছে।

আবার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারও করেছেন হুমায়ুন। যদিও সেই সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তার জীবনকাল। লাল বেলে পাথরে তৈরি ভবনের ছাদের উপর নির্মিত গ্রন্থাগার থেকে নামার সময় সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পান হুমায়ুন। এর তিন দিন পর মৃত্যু হয় তার।

নীলা গুম্বাদ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

১৫৫৬ সালের ২৭ জানুয়ারি মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই জীবনাবসান ঘটে সম্রাট হুমায়ুনের। মৃত্যুর পর দিল্লির পুরান কিল্লায় দাফন করা হয়েছিল সম্রাট হুমায়ুনকে।

মহারাজা হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য দিল্লি আক্রমণ করলে হুমায়ুনের মৃতদেহ তুলে পাঞ্জাবের কালোনৌরে সরিয়ে নেওয়া হয়। 

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হুমায়ুন পুত্র মুঘল সম্রাট আকবর হেমুকে পরাজিত ও হত্যা করার পর হুমায়ুনের মৃতদেহ আবার দিল্লিতে মুঘল স্থাপত্যের প্রথম বাগান সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়।

সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ

মৃত্যুর ৯ বছর পর সম্রাট হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু বেগমের নির্দেশে ১৫৬৫ সালে দিল্লিতে সমাধিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পারস্যের বিখ্যাত স্থপতি মিরাক মির্জা গিয়াস সমাধিসৌধের নকশা করেছিলেন। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৫৭২ সালে।

মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই সমাধিসৌধ। 'চারবাগ' বাগানে স্থাপিত সমাধিসৌধের প্রধান কাঠামো লাল বেলে পাথরের দ্বিতল ভবন। কেন্দ্রে সাদা মার্বেলের গম্বুজটি চারটি ছোট গম্বুজ দ্বারা বেষ্টিত। হুমায়ুনের সমাধি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বাগান সমাধিসৌধ। চারটি অংশে বিভক্ত বাগান, জলের নালা ও ঝর্ণা রয়েছে।

চার বাগানের একাংশ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

হুমায়ুনের মূল সমাধি কয়েক স্তরের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। চারটি গেট পার হয়ে সেখানে প্রবেশ করতে হয়। 

মুঘল ও পারস্য শৈলীর সংমিশ্রণে গড়ে তোলা হুমায়ুনের সমাধি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। 

বলা হয়ে থাকে, হুমায়ুনের সমাধি আগ্রার তাজমহলসহ পরবর্তীতে অন্যান্য মুঘল স্থাপত্যের পূর্বসূরি। এই সমাধিসৌধে যা দেখবেন, তার একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা নিচে দেওয়া হলো।

১. সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি কক্ষ

সম্রাট হুমায়ুনের কবর। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

সমাধিসৌধের কেন্দ্রে অপূর্ব কারুকার্য খচিত চেম্বারে হুমায়ুনের কবর, দেয়ালগুলি পারস্যলিপিতে সজ্জিত। যদিও মূল কবরটি মাটির নিচে। চারপাশে বিভিন্ন কক্ষে হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বেগম ও মুঘল পরিবারের অন্যান্য সদস্যের শতাধিক কবর। এটি মুঘলদের ডরমিটরি নামেও পরিচিত।

২. ঈসা খানের সমাধি ও মসজিদ

ঈসা খান নিয়াজি ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত আফগান। তিনি শেরশাহ সুরীর দরবারে সভাসদ ছিলেন। হুমায়ুন সমাধিসৌধের মূল কমপ্লেক্সের প্রবেশ করার পর ডান দিকেই চোখে পড়বে নীল, হলুদ এবং সবুজ চকচকে টাইলসে সজ্জিত অপূর্ব এক স্থাপত্যশৈলী। ১৫৪৭ সালে লোদি স্থাপত্য শৈলীতে, ধূসর কোয়ার্টজাইট এবং লাল বেলেপাথরের এই সমাধিটিতে ঈসা খান নিয়াজির সমাধি। পাশেই একটি মসজিদ।

ঈসা খানের সমাধি ও মসজিদ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

৩. নীলা গুম্বাদ

নীলা গুম্বাদ বা নীল গম্বুজটি হুমায়ুনের বাগান সমাধির বাইরে  অষ্টভুজাকৃতির সমাধি যা গাঢ় নীল রঙের টাইলসে আবৃত, হুমায়ুনের সমাধির আগে নির্মিত। এটি ১৬২৫ সালে সম্রাট আকবরের দরবারের বৈরাম খানের পুত্র আব্দুল রহিম খান-ই-খানা নির্মাণ করেছিলেন।

৪. আরব সারাই গেটওয়ে

আরব সারাই গেটওয়ে। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

হুমায়ুন সমাধিসৌধ নির্মাণের কারিগরদের থাকার জন্য নির্মিত হয়েছিল। আরব সারাইয়ের দক্ষিণ প্রবেশদ্বারটি ৪৮ ফুট উঁচু।

৫. নাই কা গুম্বাদ

সম্রাট হুমায়ুনের প্রিয় নাপিতের সমাধিও রয়েছে এই কমপ্লেক্সে। যেটি নাই কা গুম্বাদ বা নাপিতের সমাধি নামে পরিচিত।

৬. চার বাগ

এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী পারস্যশৈলীর বাগান যা পথ ও জলের নালা দিয়ে চতুর্ভুজে বিভক্ত। উদ্যানটি প্রতিফলিত পুল এবং ফোয়ারা দিয়ে ল্যান্ডস্কেপ করা, যা সবুজের স্নিগ্ধতায় ভরপুর।

এছাড়া বু হালিমার সমাধি ও বাগান, আফসারওয়ালা মসজিদ ও সমাধি কমপ্লেক্সসহ দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে এখানে।

হুমায়ুন সমাধি কমপ্লেক্স। ছবি: সোমনাথ দত্ত

কীভাবে যাবেন

হুমায়ুন সমাধিসৌধ দেখতে হলে ভারতের ভিসাও থাকতেই হবে। উড়োজাহাজে সরাসরি যেতে পারেন দিল্লি। এছাড়া কলকাতা হয়ে ট্রেনে দিল্লি যাওয়া যায়। 

দিল্লি থেকে গাড়ি ভাড়া করে কিংবা মেট্রোরেল ধরে পৌঁছে যেতে পারবেন নয়াদিল্লির মথুরা রোডের নিজামুদ্দিন পূর্ব অঞ্চলে, যেখানে রয়েছে মুঘল স্থাপত্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্রাট হুমায়ুনের উদ্যান সমাধিসৌধ।

কখন যাবেন

সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে হুমায়ুন সমাধিসৌধ, ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়।

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশমূল্য ভিন্ন। অনলাইনে অথবা সরাসরি গিয়ে টিকিট কিনতে পারবেন।

Comments

The Daily Star  | English

Public admin reforms: Cluster system may be proposed for ministries

The Public Administration Reform Commission is likely to recommend reducing the number of ministries and divisions to 30 from 55 to improve coordination and slash the government’s operational cost.

7h ago