কেন বিশেষ জেবুন নিসা মসজিদ, জানালেন স্থপতি সায়কা ইকবাল মেঘনা

জেবুন নেসা মসজিদ
ছবি: আসিফ সালমান

স্থাপত্যের উদ্ভাবন ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তির মেলবন্ধন হয়ে আশুলিয়ার জামনগরে দাঁড়িয়ে আছে জেবুন নিসা মসজিদ। মনোলিথিক গঠনে তৈরি এই মসজিদটিকে 'ব্রিদিং প্যাভিলিয়ন' হিসেবে নকশা করা হয়েছে। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা। চমৎকার এই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের স্থাপত্যটির পাশ দিয়ে গেলে মুগ্ধ চোখে তাকাবেন যে কেউ।

যার অক্লান্ত পরিশ্রমে এই মসজিদের নকশা তৈরি হয়েছে, তিনি স্থপতি সায়কা ইকবাল মেঘনা। 

বুয়েট থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর মেঘনা স্পেনের ইনস্টিটিউড অফ অ্যাডভান্সড আর্কিটেকচার অফ কাতালোনিয়া থেকে মাস্টার্স করেন। শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে গ্লেন মারকাট ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ক্লাসে অংশ নেওয়ার ফলে মেঘনার শিক্ষাজীবন হয়েছে আরও সমৃদ্ধ, আরও পাকাপোক্ত। সাম্প্রতিক প্রকল্প জেবুন নেসা মসজিদ স্থাপত্যে তার নিজস্ব দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

'আমরা দুঃখ-দুর্দশায় ও প্রয়োজনে প্রার্থনার জন্য হাত তুলি, কেমন হয় যদি আনন্দ ও প্রাচুর্যের সময়েও প্রার্থনা করি?'

কাহলিল জিবরানের এমনই একটি উক্তিতে অনুপ্রাণিত হয়ে মসজিদের নকশা করেছিলেন মেঘনা। তিনি মসজিদটি এমন একটি জায়গায় তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যার সঙ্গে এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব ভালোভাবে মিলেমিশে যায়।

মসজিদ
ছবি: আসিফ সালমান

জল ও স্থলের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করে দেওয়া এই মসজিদটিকে এমন একটি স্থান হিসেব গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে আছে একইসঙ্গে আধ্যাত্মিকতা চর্চা ও মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ।

স্থপতি মেঘনা বলেন, 'এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পাউন্ডের মালিক চেয়েছিলেন তার কর্মীদের জন্য একটি মসজিদ তৈরি করতে এবং একইসঙ্গে তার মায়ের স্মরণে এমন কিছু নির্মাণ করতে, যা দেখলে এই কঠোর শিল্পাঞ্চলেও বয়ে যাবে এক নরম-কোমল আবহ। আর সেজন্যই এই মসজিদটি একইসঙ্গে হয়ে উঠেছে একটি আধ্যাত্মিক ও সামাজিক স্থান, যেখানে পারস্পরিক যত্ন ও বিশ্বাসের মাধ্যমে মালিক ও কর্মীদের মধ্যে নির্মিত হবে এক উষ্ণ সম্পর্ক।'

ছিমছাম তবে বেশ কার্যকর নকশা করা হয়েছে মসজিদটির। উঁচু জায়গা করে তার উপর এই মনোলিথিক স্থাপত্যটি নির্মিত হয়েছে। ভারি কংক্রিটের দেয়ালে ছোট ছোট আয়তাকার শূন্যস্থান রাখা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে একটু আলো ঢুকে পড়ে– যা মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন মসজিদের ঝুলন্ত লণ্ঠনের কথা।

সাইকা ইকবাল মেঘনা
সাইকা ইকবাল মেঘনা। ছবি: সংগৃহীত

মসজিদটির নকশাতে শুধু নির্মাণগত নান্দনিকতাই ফুটে উঠে না, কর্মীদের জন্য এক ধরনের প্রশান্তি ও প্রতিফলনের জায়গাও তৈরি হয়। টেকসই প্রকৃতি মেঘনার কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই মসজিদের নকশাতেও বড় ভূমিকা রেখেছে এটি।

মেঘনা বলেন, 'আমার কাজের উদ্দেশ্য মূলত এই ব-দ্বীপের শহরগুলোর আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা, পরিত্যক্ত স্থানগুলোকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই করে গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানগুলোর সুপ্ত স্বভাব জাগিয়ে তোলা।'

মসজিদের স্থাপত্যে রয়েছে প্রাকৃতিক ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। বাগানের গাছগুলোতে রিসাইকেল করা পানি দেওয়া হয়। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রতি তার শ্রদ্ধারই প্রমাণ পাওয়া যায়।

ঐতিহ্যগত উপাদানগুলোর সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় ঘটিয়ে মেঘনা অনেক যত্ন আর বিবেচনাবোধ নিয়ে তার কাজটা করেন।

মসজিদ
ছবি: আসিফ সালমান

'আমার মনে হয় না কোনো প্রকল্পের উদ্দেশ্য যদি ঠিকঠাকভাবে পূরণ হয়, তাহলে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যে কোনো সংঘাতের আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়ে তিনি মসজিদের গম্বুজের উদাহরণ দেন, যা কি না ইতিহাস ও অধুনা নকশার দর্শনের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে', বলেন তিনি।

স্থাপত্যকে মেঘনা মূলত দেখেন সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সংযোগ হিসেবে। আর তাই এতে সম্প্রদায়গত বন্ধনটা বড় ভূমিকা রাখে।

স্থপতি ব্যাখ্যা করেন, 'মসজিদটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্যুনিটির কর্মীদের জন্য দেখা-সাক্ষাৎ, আরাম করে শ্বাস নেওয়ার মতো একটি স্থান হবে– এই ধারণাটি থেকেই মসজিদটি প্রায়মুক্ত প্যাভিলিয়নের মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে গাছপালা, জলাশয় সবই আছে।'

জেবুন নেসা মসজিদ,
ছবি: আসিফ সালমান

তবে প্রকল্পটির কথা বলতে গিয়ে মেঘনা স্থাপত্যের যাত্রায় আসা বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির কথাও স্বীকার করে নেন। কোভিড মহামারির সময় আসা বিলম্ব এবং একটি সক্রিয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল আঙিনায় কাজ করার চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরেন। তবে এই সবই তার দলের সদস্যরা মিলেমিশে জয় করতে পেরেছেন বলেও জানান তিনি।

অধুনা চর্চার সঙ্গে আবহমান ঐতিহ্যের মিশেল এবং মানুষের সঙ্গে স্থানের সংযোগ ঘটিয়ে মেঘনা এমন এক ধরনের স্থাপত্যশৈলী সামনে নিয়ে এসেছেন, যাতে একইসঙ্গে প্রকৃতি, মানুষ ও স্থাপত্যের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। শুধু আশুলিয়ার শ্রমিকরাই নন, স্থাপত্য কীভাবে প্রত্যন্ত স্থানেও সামগ্রিক অর্থেই মানুষের নিজস্বতা, যত্নশীল মনোভাব ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার অনুষঙ্গ হতে পারে এই মসজিদের মাধ্যমে মেঘনা সেটিই দেখিয়েছেন।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

2h ago