জসীম উদদীনের আকাঙ্ক্ষায় দেশ নির্মাণ

স্কেচ : বিপ্লব চক্রবর্তী/ স্টার

জসীম উদদীনের আকাঙ্ক্ষায় দেশ ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একজন কবি-কাহিনীকার-নাট্যকার-সংগ্রাহক ও সংকলক রূপে তিনি দেশ নির্মাণের অভিপ্রায়কে জারি রেখেছিলেন সর্বতোভাবে। প্রশ্ন হল, কবির জীবদ্দশায় এবং মৃত্যু পরবর্তীতে প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও কি আমরা কবির আকাঙ্ক্ষিত দেশ পেয়েছি, নাকি রাষ্ট্র নামক প্রপঞ্চে দেশ ক্রমশ দুর্বল-কোণঠাসা হয়ে পড়েছে?

জসীম উদদীন গত শতাব্দীর প্রারম্ভিকলগ্নের যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন তখন  ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার শাসনকাল। মধ্যজীবন পর্যন্ত কবি এই শাসনক্ষমতার নিগড়ে ছিলেন। তখন তিনি সৃষ্টি করেন অমর কিছু রচনা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাখালী' প্রকাশিত হয় ১৯২৭-এ। 'নক্সী কাঁথার মাঠ' ১৯২৯-এ, 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' ১৯৩৩-এ, 'রঙিলা নায়ের মাঝি' ১৯৩৫-এ। এরপর কবির আরও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যার সবটাই ১৯৪৭-এর পর।

দেখা যাচ্ছে, উনার সিগনেচার কাজের সবগুলোই প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে যখন অবিভক্ত ভারত নানা ঘটনা-পরিক্রমায় স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন একজন কবি নিজেকে সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে সরিয়ে রেখে, নিবিষ্ট মনে লিখে গেছেন বাংলার হৃদয়ের কথা। সংগ্রহ করে চলেছেন পূর্ববঙ্গ গীতিকার মতো রত্নরাজি। যে সবের অভিজ্ঞান ছিল দেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। 

এরকম সাধনার পথ কেন বেছে নিলেন কবি? সেইসময়ের ঘটনাপ্রবাহে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল যে, দেশ স্বাধীন হবেই হবে। কবিরও সেটা নিশ্চয় জানা ছিল। এ কারণেই তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন দেশটা যেন প্রকৃতার্থেই দেশ হয়ে উঠুক। রাষ্ট্র নামক শৃঙ্খলে দেশ-দেশবোধ-দেশচেতনা-দেশভাবনা যেন হারিয়ে না যায়, তার জন্য সৃজনে-মননে দেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জারি রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশটা যেন সদর্থক অর্থেই বাঙালির দেশ হয়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িকতা যেন তার মূলমন্ত্র হয়। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা যেন সদর্থক অর্থেই দৃশ্যমান থাকে। সকলের মাঝে সাম্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লড়াই যেন জারি রাখা হয়। কবির এই দেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ও সাধনা কতোটা প্রবল ছিল তা হাজির রয়েছে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল প্রকার লেখালেখিতেই।

রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন- 'প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।'

জসীম উদদীনকে বাঙালির-আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের অপর নাম বলায় সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত। কারণ, তিনি বাঙালি সংস্কৃতির আদি ও অকৃত্রিম রূপটাই তুলে ধরেছেন সৃজনশৈলীতে। বাঙালি যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের কাঠামোর মধ্যে ছিল। কেবল ব্রিটিশের দু'শ বছর নয়, তার পরে এবং তারও আগেও। আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডসহ ভারতবর্ষ অতীত ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিজাতী-বিভাষী-বিদেশী-বিধর্মী-বিসংস্কৃতির মানুষ দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে।

একারণে, তার ভেতর জন্ম নিয়েছে ঔপনিবেশিক এক মন। যা তাদের আবিষ্ট ও আলিঙ্গণ করে, নিজেদের নির্মিত মর্যাদার জায়গাতেও কর্তৃত্ব করে চলেছে। এ কারণে স্বাধীন হলেও তার মন, স্বভাব, বৈশিষ্ট্য এবং খাসলতের পুরোটা কিংবা অনেকখানি ঔপনিবেশিকতার ভূত দ্বারা আচ্ছন্ন ও নিয়ন্ত্রিত। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই সম্ভবত ফ্রান্স ফাঁনো বলেছেন, 'স্থানীয় বুদ্ধিজীবীর কাজ কেবল বিদেশি শ্বেতাঙ্গ পর্যবেক্ষকদের প্রতিস্থাপন করা না বরং সমাজের জন্য নতুন আত্মা নির্মাণ করা।' জসীমউদ্দীন বাঙালি ও বাংলাদেশের আত্মা নির্মাণের কাজকে সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন। আমরা মনে করি, ফাঁনো যেটাকে বলছেন আত্মা নির্মাণ, জসীমউদদীন সেটাকে দেখেছেন দেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে।

তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন- 'প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।' রবীন্দ্রনাথ উল্লিখিত এই 'খাঁটি জিনিস মূলত' বাংলার মানুষের যাপিত জীবন। তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, কয়েক হাজার বছরের মানবিক ও সামগ্রিক এক পরম্পরা।

বালুচর গ্রন্থের 'প্রতিদান' কবিতায় জসীমউদদীন লিখেছেন, 'আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।/ যে মোরে করিল পথের বিবাগী;/ পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;/দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;/ আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।' এখানে বৈষ্ণব পদাবলীর, 'ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর/ পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর' এর  ছায়া থাকলেও জসীমউদ্দীনের 'প্রতিদান' মূলত বাঙালি মানসের চিরন্তন চাওয়ার-নির্মোহ এক উচ্চারণ। একটা দেশের মানুষ যদি 'প্রতিদান' এর মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে তা হলে সেই দেশে হিংসার চর্চা না থাকায় স্বাভাবিক ও সঙ্গত। বাঙালির-বাংলার জল-হাওয়ায়, প্রকৃতি ও পরিবেশে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই জারি রয়েছে অহিংসার পূণ্যস্রোত। জসীম উদদীন 'প্রতিদান' কবিতায় সেই সত্যকেই করেছেন মানবীয় প্রত্যাশায় মহিমান্বিত ও উচ্চকিত।

'জসীম উদদীন' শিরোনামে আনিসুজ্জামান বলেন, 'হুমায়ুন কবিরের মতে, দেশের গণ-মানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাব্যে রূপান্তরিত করতে পারাই জসীম উদদীনকে কাব্যসিদ্ধি দিয়েছে; কিন্তু সে-শক্তি পশ্চাৎমুখী বলে তা নতুন নতুন রাজ্যজয়ে অগ্রসর হতে পারেনি। কথাটা ভেবে দেখার যোগ্য। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, জসীম উদদীন বাংলা কবিতায় নিজস্ব ও নতুন একটি পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। লোক-ঐতিহ্যেও পুনরাবৃত্তি তিনি করেননি, তিনি সে-ঐতিহ্য থেকে বস্তু ও রূপ নিয়ে তার পুনর্সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাহিনীকাব্যকে পূর্ববঙ্গ গীতিকার প্রতিরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। তাঁর খণ্ড কবিতাও এমন যার ধরণের সঙ্গে আমাদের আগে কখনো পরিচয় ছিল না। পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয়কে এবং সমাজের সাধারণ স্তরের সঙ্গে তাঁর একাত্মতাকে তিনি রূপদান করেছেন বাংলা কবিতার একটি নতুন ধারায়। মাটির হৃৎস্পন্দন তিনি শুনতে পান তাঁর এ-দাবি সত্য। এবং তাকেই তিনি রূপ দিয়েছেন শিল্পিত, সুকুমার, সুন্দর কবিতায় যা বাংলাভাষীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপভোগ করবে।' ('কালের ধ্বনি', বাংলা ও বাঙালির কবি জসীম উদদীন সংখ্যা)।

আনিসুজ্জামানের উপর্যুক্ত মূল্যায়নে এটাই স্পষ্ট যে জসীম উদদীন কবিতাসহ-সমস্ত লেখালেখিতেই দেশের হৃদয়কে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশ একটা কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিপ্রধান জনপদ ও জনমানসের যাপিত জীবন ও সংস্কৃতির যে চিত্র তিনি এঁকেছেন এককথায় তা ঋদ্ধ ও অতুলনীয়। বাংলার কৃষি কৃষককে এ কবির মতো করে আর কেউ বুঝেননি, বুঝতেও চাননি।

যে কোন জাতির জীবনে নবজাগরণের পর যদি আধুনিকতা আসে, সেই আধুনিকতা যথার্থ-যুক্তিসঙ্গত ও ব্যবহারিক হয়। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাপারটা ঠিক সেভাবে ঘটেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বর্তমান ভূখণ্ডে 'বাংলাদেশের নবজাগরণ' নামে যে নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছে তা নিয়ে আমাদের বৌদ্ধিকজগতে কোন অনুসন্ধান নেই।

জসীম উদদীন লিখেছেন : 'জনম কালো মরণ কালো/ কালো ভুবনময়,/চাষীদের ঐ কালো ছেলে/ সব করেছে জয়।' আহা! বাংলার ভুখা-নাঙ্গা কৃষককূলকে জসীম উদদীন ছাড়া আর কে এভাবে চিত্রায়িত করার সাহস দেখিয়েছেন? কেইবা বাংলার কৃষককে বিশ্ব মাঝে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রত্যয়দীপ্ত মাধুরি মাখা এমন বাণী শুনিয়েছেন: 'চাষীদের ঐ কালো ছেলে/ সব করেছে জয়।' জসীম উদদীন জানতেন দেশ নির্মিত না হলে, সব জয় করা চাষীদের ওই কালো ছেলে বিভ্রান্ত ও বিপন্ন হবে। কৃষক তার প্রাপ্য উষ্ণীষ থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষিকাজকে দেখা হবে হেয়ভাবে-অমর্যাদার জায়গায়। এ কারণেই দেশ নির্মাণের লক্ষ্যে কবি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সংশপ্তকের জায়গায়। জসীম উদদীন ছাড়া আর কেউ নেই যার লেখনী থেকে এদেশকে আঁকা যাবে, এদেশের স্বরূপ ও সত্তা নির্মাণ করা সম্ভব হবে।

জসীম উদদীন লিখেছেন : এক. কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি/ কালো দাঁতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লিখি/জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়/চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয় ('নক্সী কাঁথার মাঠ')।

দুই. এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো/ মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো। ('রাখালী')। তিন. কাল সে আসিবে, মিছাই ছিঁড়িছি আঁধারের কালো কেশ/ আজকের রাত পথ ভুলে বুঝি হারাল ঊষার দেশ।('কাল সে আসিবে')।

জসীমের মতো আর কোন কবি কি এভাবে দেখেছেন বাংলা ও বাঙালিকে, তার নিরাভরণ রূপ এবং সরল ও সাবলীল জীবনকে। জসীমের এই উচ্চারণের ভেতর দিয়ে বাংলার হৃদয় যেন কথা বলে উঠেছে। যে বাংলাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!/ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!'। নজরুল বলেছেন, 'নমঃ নমঃ বাঙলা দেশ মম/ চির-মনোরম চির-মধুর।/ কোন নিরবধি বহে শত নদী/ চরণে জলধির বাজে নূপুর।' জীবনানন্দ দাশ বলেছেন : 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/ খুঁজিতে যাই না আর; অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/চেয়ে দেখি ছাতার মতো বড় পাতাটির নিচে বসে আছে/ভোরের দোয়েলপাখি চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ/... সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,/ শ্যামার নরম গান শুনেছিল - একদিন অমরায় গিয়ে/ ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদ-নদী-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।'

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের বাংলাকে যদি আমরা একত্রে খুঁজে পেতে চাই। সেই বাংলাকে আমরা যদি যাপন করতে চাই, তা হলে আমাদেরকে বারবার জসীম উদদীনের কাছে ফিরে আসতে হবে। বেদনার হল, কবির দেশ নির্মাণের যে স্বপ্ন-প্রত্যয় ও প্রত্যাশা তাকে আমরা যথার্থভাবে অবলোকন করতে পারিনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটাকে দেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে পাথেয় কবি তার সৃজন ও মননালোকে রেখে গেছেন তাকে আমরা বাস্তবসম্মতভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এর কারণ কী হতে পারে?

আমরা মনে করি, যে কোন জাতির জীবনে নবজাগরণের পর যদি আধুনিকতা আসে, সেই আধুনিকতা যথার্থ-যুক্তিসঙ্গত ও ব্যবহারিক হয়। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাপারটা ঠিক সেভাবে ঘটেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বর্তমান ভূখণ্ডে 'বাংলাদেশের নবজাগরণ' নামে যে নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছে তা নিয়ে আমাদের বৌদ্ধিকজগতে কোন অনুসন্ধান নেই। অন্যদিকে, অবিভক্ত বঙ্গে 'বাংলার নবজাগরণ' নামে যে নবজাগরণ সংঘটিত হয়-আমরাও তার উত্তরাধিকার। সেই নবজাগরণকে আমলে নিয়ে বলতে হয়, আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নবজাগরণ ও আধুনিকতা এসেছে হাত ধরাধরি করে। এমনকি বিস্ময়কর হলেও সত্য নবজাগরণের আগেই আধুনিকতা এসেছে। এসেছে মানে ঔপনিবেশিক শাসক, তার বিদ্বজ্জন ও এদেশীয় দোসররা, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের লক্ষ্যে আধুনিকতাকে চাপিয়ে দিয়েছেন এবং আমরা সেটাই কবুল করে নিয়েছি। 

এই যে চাপিয়ে দেয়া আধুনিকতা, এই আধুনিকতার কাছে আমরা কতোটা ইহজাগতিকতার প্রত্যাশা করতে পারি? ফলে, আমরা দেশ পেলেও সেটা রাষ্ট্র হিসেবে রয়ে গেছে। দেশ হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা এখনও অপরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে বলি, আপনার দেশ কোথায়? প্রশ্নটা হল আপনার বাড়ি কোথায়। আমরা যেহেতু এখনও পুরো দেশটাকে একসূত্রে বাঁধতে পারিনি-সম উন্নয়নের ভিত্তিতে-সম সুযোগ ও সুবিধার বদৌলতে, সুশাসন ও সামাজিক সুরক্ষার নিরিখে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানসহ সকল মৌলিক অধিকারের বাস্তবতায় বৃহত্তর অর্থে একটা দেশ হয়ে উঠতে পারিনি। ফলে একদেশের হয়েও দেশের ভেতরেই আমরা দেশ কোথায় তালাশ করি।

এ হচ্ছে উপনিবেশজাত চিন্তাচর্চার কুফল। এবং রাষ্ট্রের শাসক ও প্রশাসকবর্গের সীমাহীন ব্যর্থতার নজির। যদি নবজাগরণ সংঘটিত হওয়ার পর আধুনিকতার যাত্রা হতো তা হলে বোধ করি বিষয়টা ওরকম হতো না। কারণ নবজাগরণ হলো সেই আলো বা বাতিঘর বিশেষ যা, জাতিকে-দেশের মানুষকে আধুনিকতার পথে চলার শক্তি ও সাহস যোগায়। বাংলায় নবজাগরণ সম্পন্ন হওয়ার পর, নিদেনপক্ষে নবজাগরণের সূচনা হওয়ার পর যদি আধুনিকতার সুত্রপাত হত, তা হলে হয়তো জসীম উদদীনের রাষ্ট্র নির্মাণের যে আকাঙ্ক্ষা তা বোধ করি এতোটা অপূর্ণ থাকত না। কারণ নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, নিজের দিকে দৃষ্টি ফেরানো, শেকড়ের অনুসন্ধান করে নিজের আত্মজাগরণ ঘটানো, সমৃদ্ধ অতীতকে আবিস্কার করে বর্তমানকে আলোকিত ও ঋদ্ধ করা।

এই ব্যাপারটা কবিও ভালভাবেই বুঝেছিলেন। 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' প্রবন্ধে তিনি যা বলেছেন, তা বোধ করি সেই ভাবনা থেকেই উৎসারিত। তিনি বলেছেন : 'প্রায় সব দেশেই বড় সাহিত্য-প্রতিভা তাঁর দেশবাসীর জন্য রসধারার পানপাত্রটি পূর্ণ করিয়ে দেয়। সেই পাত্র ভরিয়া টুবুটুবু হইয়া যাহা গড়াইয়া পড়ে, তাহাই হয় বিশ্বরস-পিপাসুদের সম্পদ। এই কবির ব্যাপার হইল তাহার বিপরীত। এখানে বিশ্বের পাত্র ভরিয়া যাহা গড়াইয়া পড়িয়াছে, তাহাই পাইয়াছে তাহার দেশবাসী।... সর্বপ্রাচ্যের বিরাট পদক্ষেপ কবি রচনা করিলেন ইউরোপীয় দৃষ্টি লইয়া।... এ দেশের যা কিছু ইউরোপের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে, তাই লইয়া তিনি পসরা সাজাইলেন। এ দেশের সব ভাল লইয়া কবি পাশ্চাত্যের রুচি বদলাইতে চেষ্টা করিলেন না। (জসীম ১৯৯০)।

দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ''আমি হিন্দু। আমার কাছে বেদ পবিত্র, ভগবৎ পবিত্র। কিন্তু 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' তাহার চাইতেও পবিত্র।''

'জসীমউদ্দীন স্মৃতিকথাসমগ্র'তে 'কবি ভাই-এর শেষ প্রত্র' শিরোনামে উনার লেখা একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে দেশ, জাতি, মাটি, মানুষ ও তার প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পর্কে এমন চিত্র উল্লিখিত হয়েছে যা কেবল অসাধারণ নয়, এর মধ্যে কবি মনের স্বরূপটাও চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে। কবি লিখেছেন : ''আমার সোনামনি ভাই বোনেরা... এ দেশ তোমার-এ দেশ আমার-এ দেশ সকল বাঙালির। তেলী, তাঁতী, কামার, কুমার, চাষী, মজুর, কাঁশারী, শাঁখারী এরা বংশানুক্রমে নিজ নিজ শিল্পের সাধনা করিয়া প্রতি পদে পদে দেশের গৌরব বাড়াইতেছে। ইহাদের সকলের কথা আজ বিস্তৃত করিয়া তোমাদের বলিতে পারিলাম না। দেশের শাসনভার যাহাদের হাতে, তারা এদের ভালবাসে না। এদের কাজের উপযুক্ত মূল্য দেয় না। তোমরা বড় হইয়া এদের পাশে যাইয়া দাঁড়াইও। ...

অবসর মত তোমরা দেশে বনে প্রান্তরে পল্লীতে ঘুরিয়া বেড়াইও। সেখানে যে অপরূপ রূপ দেখিতে পাইবে তাহাই তোমাদিগকে এদেশকে ভালবাসিতে শিখাইবে। ...

ইতি

তোমাদের

কবি ভাই''

উপর্যুক্ত চিঠিতেও স্পষ্ট হয়, কবি এই দেশটাকে কীভাবে দেখেছেন। এই দেশ সম্পর্কে উনার অভিব্যক্তি কি ছিল। বাংলাদেশ ও বাঙালি কবির মানসপটে কীরূপে বিরাজমান। জসীম উদদীন এ চিঠিতে যেন একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। যে শিল্পী জানেন তার ক্যানভাস কোন রঙের ছোঁয়ায় কীভাবে ফুটে উঠবে। এই চিঠি পাঠে যে কারও মধ্যে দেশপ্রেম নতুনভাবে জাগ্রত হবে। দেশকে নতুনভাবে চেনা-জানার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। কবি নূতনদের, নতুন প্রজন্মকে মিনতি করে বলছেন ওরা সবাই যেন বাংলার পল্লী মায়ের কোল ঘুরে দেখে। পিতামাতা যেমন সন্তানকে নতুন পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত করে। ঠিক তেমনি কবিও এখানে পিতৃ ও মাতৃহৃদয়কে জাগরুক করে তুলেছেন।

একজন কবি যে, দেশকে এভাবে ভালবাসতে পারেন, তার উদাহরণ বোধ করি জসীম উদদীনের মতো কবির জন্ম না হলে আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না। যে কবি লিখেছেন : 'শুধু কহিলাম-পরাণ বন্ধু! তুমি এলে মোর ঘরে,/আমি ত জানিনে কি করে যে আজ তোমারে আদর করে!/ বুকে যে তোমারে রাখিব বন্ধু, বুকেতে শ্মশান জ্বলে;/নয়নে রাখিব! হায়রে অভাগা, ভাসিয়া যাইবে জলে!/কপালে রাখিব! এ ধরার গাঁয়ে আমার কপাল পোড়া;/মনে যে রাখিব! ভেঙে গেছে সে যে কভু নারে লাগে জোড়া!/সে কেবল শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চাহিল আমার পানে;/ও যেন আরেক দেশের মানুষ, বোঝে না ইহার মানে।'

দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ''আমি হিন্দু। আমার কাছে বেদ পবিত্র, ভগবৎ পবিত্র। কিন্তু 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' তাহার চাইতেও পবিত্র।''

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ''জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে।'' জসীমউদদীনের এই হৃদয়জুড়ে ছিল দেশ-মানুষ-প্রকৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-কিংবদন্তীর অবস্থান। কবি এসবকে বহন করেছেন একটা দেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায়। যে দেশে সবাই-সবার হয়ে উঠবে। যে দেশ সকলের সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় হাত ধরাধরি করে চলতে শিখবে। যে দেশে সবাই সবার অবস্থান ও সত্তা ধারণ করেও অন্যের সঙ্গে মিলবে ও মেলাবে-কখনো আত্মীকরণে, কখনোবা সাঙ্গীকরণে। কিন্তু কাউকেই বঞ্চিত করবে না, উপেক্ষিত হতে দেবে না। সমগ্রকে ধারণ করবে সে। কারণ মানুষের প্রধান চ্যালেঞ্জ হল সমগ্র'র হয়ে ওঠা। তাতেই তার মুক্তি ও কল্যাণ।

Comments

The Daily Star  | English

Firefighter dies after being hit by truck while battling Secretariat fire

Another firefighter sustained injuries in his leg while working to extinguish the fire

54m ago