বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সাংবাদিকতার সুযোগ চাই

সাংবাদিক সমিতি গঠন করায় ১০ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বেসরকারি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। যেন মস্তবড় অপরাধ করে ফেলেছেন এসব ছাত্র। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন, আবার সাংবাদিকতাও করবেন—এটা কীভাবে হয়! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয় পড়ানো হবে, কিন্তু সাংবাদিকতা করা যাবে না—এমন স্ববিরোধিতার মধ্য দিয়েই চলছি আমরা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা যেন এক অচ্ছুত কাজ। এর কিছু কারণ না বললেই নয়। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বেশ কম। আছে পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের দাপট। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকতে চায় বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তি হচ্ছে—আমি বা আমরা উদ্যোক্তা, টাকা বিনিয়োগ করেছি। অতএব, আমাদের চাওয়াটাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যদিও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চালাতে এসে নানা নিয়ম-নীতির কারণে এসব কথা বলার সুযোগ কম।

তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের প্রায় এক ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে, গুণে ও মানে সেগুলো অনেকটাই এগিয়ে গেছে। অবশ্য এই সংখ্যাটি শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় খুবই কম। তবু বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও নানামুখী বৈরী পরিবেশের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই এগিয়ে চলা গর্ব করার মতো।

পাবলিক পারসেপশনে শীর্ষস্থানীয় না হলেও ঢাকা ইন্টারন্যশনাল ইউনিভার্সিটির বেশ পরিচিতি রয়েছে। ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য।  তিনি সমাজের পরিচিত মুখ, ভালো বক্তা। তার উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে—এমন সিদ্ধান্ত কাম্য নয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর প্রথম দিকেই ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা ড. এ বি এম মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারী ১৯৯৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। আইন শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। এখনকার অবস্থা খুব একটা জানি না। তবে গণমাধ্যমে ১০ ছাত্রকে বহিষ্কারের খবর শোনার পর চোখের সামনে ভেসে ওঠে মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারীর মুখ। আমরা উনাকে ‌পাটোয়ারী স্যার বলতাম। ভাবছি, আইনের এই অধ্যাপক বেঁচে থাকলে এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতেন কি না।

পাটোয়ারী স্যার ছাড়াও মনে পড়ছে প্রয়াত হাফিজ জি এ সিদ্দিকী, বজলুল মোবিন চৌধুরী বা কাজী আজহার আলীর মতো দক্ষ ও জ্ঞানী মানুষদের। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা ছিল।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আইন রয়েছে। সেখানে সাংবাদিকতা করা যাবে না—এমন কথা নেই। সাংবাদিকতা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি লাগবে—এ কথাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-নীতিতে উল্লেখ নেই।

দেশের সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিক সমিতি রয়েছে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের হয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা যেন বাকস্বাধীনতার পরিপূরক। সেখানে যত বেশি আটকানোর চেষ্টা হয়েছে, ততবেশি সাংবাদিকতা বিকশিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে দেখেছি, দাঁত কামড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার সমালোচনা করেন। কিন্তু ছাত্র যে উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখবে—এটা শেষমেশ তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

ঢাকার বাইরে রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার সুযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কড়াকড়ি আরোপের চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে আবার পিছিয়ে যান।  বছর কয়েক আগে এমন বেশ কিছু ঘটনার কথা মনে পড়ে।

এই চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে চালু হওয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নানা হয়রানির শিকারও হয়েছেন, এখনো মাঝেমধ্যে হচ্ছেন। এর মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে পড়ছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার মেসবাহ তো প্রায় জীবন দিয়ে দিলেন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে। প্রভাবশালী শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করে লেখাপড়া শেষ করলেন অনেক যুদ্ধ করে। এই ঘটনা তাকে অসুস্থ করে তোলে, মেধাবী এই যুবক এখনো সুস্থ নন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শেষমেশ সাংবাদিকতা মেনে নিলেও সংবাদদাতাদের ওপর চোখ রাঙানির কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়।

তিন-চারটি ছাড়া শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সাংবাদিকতা করার সুযোগ নেই। মনে পড়ছে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সাল থেকে সাংবাদিকতা চালু রয়েছে। সেখানে সাংবাদিকদের সমিতি আছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সেখানে কাজ করেন। কিন্তু এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে শুনিনি।

গত ১৩ মার্চ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারের সই করা আদেশে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে কিছু সংখ্যক ছাত্র সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটি সমিতি চালাচ্ছেন। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এ ধরনের কোনো সাংবাদিক সমিতি নেই। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সাংবাদিক সমিতিকে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি।

আদেশের তিনটি বাক্যই অসঙ্গতিপূর্ণ। প্রথমে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নাম ব্যবহার করে কিছু সংখ্যক ছাত্র সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটি সমিতি চালাচ্ছেন। আসলে কি তাই? বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ছাত্র সাংবাদিকতা করলে তো সাংবাদিক পরিচয় দেবেনই। পেশাগত স্বার্থে তারা একটি সমিতি করেছেন। তারা একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আরেকদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করেন। অতএব, তারা পেশার স্বার্থে সমিতি গঠন করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে যে, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এ ধরনের কোনো সাংবাদিক সমিতি নেই, বিশ্ববিদ্যালয় এর কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এ ধরনের সমিতি থাকার কথাও নয়। এটা কয়েকজন সংবাদদাতার একটি সমিতি। এর কোনো রেজিস্ট্রেশন, অ্যাফিলিয়েশন বা পারমিশন প্রয়োজন হয় না।

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংবাদদাতারা একটি বসার জায়গা খোঁজেন। এটা পেলেই তারা খুশী। আর কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিকে বছরে কিছু অনুদান দিয়ে থাকে পিকনিক, সেমিনার বা শিক্ষাসফরের জন্য, যার পরিমাণ খুবই কম। তবে বসার জায়গা বা অনুদান না পেলেও কেউ সাংবাদিকতা করতে পারবে না বা সমিতি গঠন করতে পারবে না—এ কথা কিন্তু কোথাও বলা নেই। বরং এ ধরনের কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করারই কথা। সাংবাদিকতার মাধ্যমে বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বাড়ে, যেটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা অনেকটা জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো। একজন শিক্ষার্থী সাংবাদিকতা বা লেখালেখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। দেশের ভালো সাংবাদিকদের অনেকেই ক্যাম্পাস থেকে গড়ে ওঠেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি-অগ্রগতি যেমন তুলে ধরেন, তেমনি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের আপত্তি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি শেষমেশ মেনে নিতে পারলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এসব ব্যাপারে কঠোর। যেমন কঠোর ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা।

বাংলাদেশে অন্তত ২০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ, সাংবাদিকতা বা মিডিয়া নামে বিভাগ রয়েছে। যারা এসব বিভাগে পড়াশোনা করেন, তাদের হাতে-কলমে কাজ শেখার বড় সুযোগ ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা। সেই সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা চলবে না। বেসরকারি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা শেষে এই পেশায় কাজ করছেন অনেকে। আইইউবি, স্ট্যামফোর্ড, ইউডা বা ইউল্যাবের মতো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের অনেকে এই পেশায় আছেন। যদিও স্ট্যামফোর্ড বা ইউডার সুনাম ইতোমধ্যে নষ্ট হয়েছে।

বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। আমার সাংবাদিকতা পেশার শুরুটাও কাছাকাছি সময়ে। শুরুতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতাম। তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়ার নীরব বা সরব একজন সাক্ষী। দক্ষ ও জ্ঞানী মানুষেরা যেমন এই খাতকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি দুষ্টু লোকদের কম আনাগোনা দেখিনি, এখনো দেখছি।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক। মূল ধারার গণমাধ্যম তো আছেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে চলছে সমালোচনার জোয়ার। বলা হচ্ছে, মৌলিক অধিকার হরণ করে বাকস্বাধীনতা গলা টিপে হত্যা করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই সমালোচনা সহসা থামবে বলে মনে হয় না। তাই অবিলম্বে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রদের সাংবাদিক সমিতি করার অধিকার নিশ্চিত করা হোক।

শরিফুজ্জামান পিন্টু: সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

13h ago