বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, ভারতের নীতি ও কিছু বাস্তবতা

ইলাস্ট্রেশন: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত ব্যাপক, বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক। অভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ভাগাভাগি, গভীরতর বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তিন ডোমেইনে দেশ দুটির সম্পর্ক সময় উত্তীর্ণ।

করোনার পরে ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে গভীরতা এসেছে, এসেছে নতুন নতুন মাত্রা। এ সময় চীন থেকে আমদানি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেড়েছে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি দ্বিগুণ বাড়লেও বাণিজ্য ব্যবধানও বেড়েছে দ্বিগুণ।

বাংলাদেশে ভারতের কনজিউমার মার্কেট প্রসারের পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানি, বাংলাদেশে ভারতীয়দের দক্ষ শ্রমবাজার তৈরি এবং ভারতে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা ও মেডিক্যাল ট্যুরিজম ইত্যাদি খাত বিগত দশকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।

এর একটি বড় অংশ হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই, যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সরকারে থাকার সম্পর্ক কম। করোনার পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সরবরাহ রুটগুলো বাঁধাগ্রস্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি গন্তব্যে ভারত সুবিধা পায়। স্থিতিশীলতায় ভারত ও আওয়ামী লীগ যে সুবিধা পেয়েছে, সেটা জবাবদিহি ও প্রতিষ্ঠানহীনতায়, ডলার ও ব্যাংকিং সংকটে আবার হারাতেও বসেছে।

তবে রাজনৈতিক প্রশ্নে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক একটি জটিলতর সুদূরপ্রসারী রূপান্তরের মধ্যে পড়ে গেছে। এই রূপান্তরের মধ্যে আমরা কয়েকটি ধারা দেখতে পাই।

প্রথম ধারাটি ভারতের দিক থেকে।

বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় নির্বাচিত যেকোনো সরকারের সঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা তৈরির পরিবর্তে ভারত ক্রমাগতভাবে একটি দলকে ক্ষমতায় রেখে আন্তঃসম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার নীতি নিয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে দিল্লি সরকার ঢাকা, দিল্লি ও ওয়াশিংটনে কাজ করছে—মিডিয়াতে এর সপক্ষে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ মিলছে।

অভিযোগ উঠছে যে, ভারতের প্রবল সমর্থনের কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টা গৌণ হয়ে উঠেছে এবং এতে বাংলাদেশে একটি একদলীয় সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা বলছে, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিক বা না নিক, ফলাফল আগেই সরকারের অনুকূলে সাজানো থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দলীয় ভূমিকা নিচ্ছে।

২০০১-২০০৬ সময়কালে বাংলাদেশের তৎকালীন বিএনপি সরকারের শাসনামলে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে কিছু নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল বলে ভারতের পক্ষ থেকে সবসময়ই বলা হয়। নিরাপত্তার কারণে ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিচালনাকারী দল নির্ধারণে একটি ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সেটেলমেন্ট চাপিয়ে দিয়েছে এবং স্থিতিশীলতার কারণ দেখিয়ে সেটা ৫ বছর পরপর নবায়ন করছে—এমন অভিযোগ বাংলাদেশের তরুণ ও শিক্ষিত সমাজে রয়েছে।

আওয়ামী লীগ আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন বাহিনী, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া সেটেলমেন্ট করে ভোট ব্যবস্থাটাকে গৌণ করে দিতে সক্ষম হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাস প্রশ্নে বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোটাকেই থমকে দিতে পেরেছে। এসব কাজ আওয়ামী লীগ করলেও বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজে অভিযোগ আনা হয় যে এর পেছনে ভারতের বুদ্ধি, পরামর্শ ও সহযোগিতা রয়েছে।

দ্বিতীয় ধারাটি বাংলাদেশের সরকারপন্থীদের দিক থেকে।

ভারত বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোর মূল চালিকা শক্তি বলে দেশটির আমলাতন্ত্রে এবং বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক বাহিনীতে ভারতের প্রতি অনুগত একটা ধারা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাতে নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্র শুধু প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় নেই এককভাবে।

তৃতীয় ধারাটি বাংলাদেশের সরকার বিরোধীদের দিক থেকে।

আন্দোলন সংগ্রাম করে নির্বাচনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে না পেরে, বৈরি ও চরম প্রতিকূলতায় নির্বাচনে যেতে না পেরে, বিদেশ নির্ভর হয়ে, বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করতে না পেরে, কিংবা নির্বাচনে না গিয়ে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতি একটি কঠিন সময় পার করছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে ভারত বয়কটের পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান চোখে পড়ার মতো। এটা বাংলাদেশ ও ভারত বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত।

প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি সমস্যা সম্পর্কে সজাগ হলেও তাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া যায় না। উপরন্তু ভারত বয়কটের আন্দোলন আংশিকভাবেও সফল হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশে চীনের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়া। নেপাল ও মালদ্বীপে ভারতের রাজনৈতিক ভূমিকার প্রতিক্রিয়া দেশ দুটিতে যে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে, সেটা ভারত কিংবা ওইসব দেশের নাগরিকদের জন্য সুখকর ছিল না। মালদ্বীপ ও নেপালে ভারতের সম্মান বাড়েনি বরং কমেছে, ভারত দিনশেষে দেশ দুটিতে রাজনৈতিক প্রভাব হারিয়েছে। ফলে, বাংলাদেশে ভারতের যে রাজনৈতিক দৃষ্টি, তাতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য না পাওয়ার বিপদ রয়েছে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত মিয়ানমার সীমান্তে এবং বঙ্গোপসাগরের আরাকান উপকূলে একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা তাড়িয়ে আরাকানে মিয়ানমার জান্তা যে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছে, ভারতও তাতে পুঁজি ঢেলেছে। বাস্তবে মিয়ানমারের চিন ও আরাকান প্রদেশে জান্তা সরকার বিদ্রোহীদের হাতে পর্যুদস্ত হয়েছে এবং এই অঞ্চলে ভারতের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ কৌশল সম্পূর্ণ ভুল বলেই প্রমাণিত হতে পারে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে ভারতের বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ওপর ভারতের নির্ভরতা বাড়বে। কিন্তু ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সমস্যা থেকে যাওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের অনুকূল কোনো নীতি বাস্তবায়ন কার্যত আমাদের স্বার্থবিরোধী।

ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দেশটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুটি দেশেই নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সামরিক সরকার কিংবা কর্তৃত্ববাদীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইমেজ হারাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত নতুন ঝুঁকি বাড়ছে। চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, আরাকান আর্মি, মিয়ানমারের প্রবাসী সরকার (এনইউজে)—কেউ বাংলাদেশের শত্রু নয়। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা বার্মিজ জান্তা এবং চীনের অবস্থানের অনুকূল হওয়ায়, ভারত বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিকূল অবস্থায় আছে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী এই মুহূর্তে জান্তা নয়, বরং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং আরাকান আর্মি। তারা নিজ নিজ প্রদেশের অন্তত ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। চিন কিংবা আরাকান প্রদেশ দুটির বাণিজ্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, নিরাপত্তা এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তা প্রশ্নে জান্তা নয় বরং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, আরাকান আর্মি ও এনইউজিকে আলাদা আলাদাভাবে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকে।

ফলে, ভারতের অবস্থান যাই হোক, শাসক হিসেবে নতুন প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্ভাবনা প্রশ্নে বাংলাদেশকে এদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে নিবিড় যোগাযোগ রাখার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা ও আরাকানের বৌদ্ধ জনজাতি দুটির মধ্যকার আন্তঃযোগাযোগ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য মুখ্য। স্পষ্টভাবেই ভারতের স্বার্থ এসব নয়, ফলে এখানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট' আছে।

বাংলাদেশের মূল প্রশ্ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং পূর্ব সীমান্তে বন্ধ কূটনীতি ও বাণিজ্য উন্মুক্তকরণের নতুন সম্ভাবনা। ভারতের মূল প্রশ্ন নিরাপত্তা, কালাদানে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সুরক্ষা। চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, আরাকান আর্মি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়। আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের বৈরিতার প্রশ্নে, নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ অভিন্ন নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধের একপেশে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া টেকসই নয়। প্রতিবেশী দেশের জনগণের গণক্ষোভের বিস্তার দীর্ঘমেয়াদে ভালো কিছুর জন্ম দেবে না। উপরন্তু এক সীমান্তে নিরাপত্তা ঝুঁকি বন্ধ হলেও অন্য আঞ্চলিক শক্তির প্রশ্রয়ে ভারতের অন্য সীমান্তে সেটা অরক্ষিত হওয়ার প্রশ্ন সামনে আসবে।

একদলদর্শী নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে 'ইন্ডিয়া আউট' ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির হালে পানি না দিয়ে, গণক্ষোভের ভিত্তি প্রস্তুত না করে, ভারতের দরকার বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারকে সম্মান দেখানো। সঠিকভাবে জনগণের নির্বাচিত সরকারই বরং সার্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীকে নেগোসিয়েশানের লেভারেজ দেবে।

 

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

3h ago