বন্যপ্রাণী পাচারের ‘ট্রানজিট’ বাংলাদেশ

প্যাটাগোনিয়ান মারা। কিছুটা খরগোশ ও কিছুটা হরিণের মতো দেখতে এই প্রাণীর আবাসস্থল দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়ার বিশাল এলাকাসহ আর্জেন্টিনার অনেক জায়গায়। এই তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণীটি উপমহাদেশের এই অংশে কখনও পাওয়া গেছে এমনটা জানা যায় না।

কিন্তু ২০২১ সালের মার্চ মাসে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার তুষখালী সীমান্ত এলাকায় ফেলে রাখা বস্তা থেকে সাতটি বিপন্নপ্রায় প্রাণী উদ্ধার করেন সীমান্তরক্ষী সদস্যরা।

পরের বছর, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা থেকে উল্লুক, সজারু, মেছো বিড়াল, চিতা বিড়াল এবং কালো মথুরাসহ বিপুল সংখ্যক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে দুটি ভালুকের বাচ্চা উদ্ধার করা হয়।

এর আগে ২০১৮ সালে যশোরের শার্শা সীমান্তের কাছে একটি গোয়ালঘর থেকে নয়টি জেব্রা এবং ২০১৭ সালে যশোর থেকে দুটি সিংহ শাবক ও একটি চিতাবাঘ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এর অর্থ হলো, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে অনেক বিদেশি ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণি এদেশে পাচার হচ্ছে কারণ; বন্যপ্রাণী পাচারের ট্রানজিট হটস্পট হিসাবে কাজ করছে বাংলাদেশ।

গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে আশ্রয় পেয়েছে ২০২১ সালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি প্যাটাগনিয়ান মারা। ছবি: স্টার

বন কর্মকর্তারা উদ্ধারকৃত এসব প্রাণি গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে পাঠালেও পাচারকারীদের ধরতে বা এসব প্রাণীর চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় ছিল তা বের করতে পারেননি।

বন কর্মকর্তা, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন বিভাগের কর্মকর্তা ও গবেষকরা বলছেন, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে আনা ওই সব প্রাণি ভারত সীমান্ত থেকে উদ্ধার করায় ধারণা করা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশটিতে পাচারের জন্যই এগুলো বাংলাদেশে আনা হয়েছিল।

দীর্ঘদিন বন্যপ্রাণী পাচার নিয়ে গবেষণা করছেন নাসির উদ্দিন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বন্যপ্রাণী পাচার হয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। তবে এসব প্রাণি ও আমাদের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, বাংলাদেশও বন্যপ্রাণী পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।'

তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বন্যপ্রাণী পাচারের উৎস এবং ট্রানজিট রুট হিসেবে কাজ করছে। এটি এখন অনেক বন্যপ্রাণী প্রজাতির ভোক্তাও।

বাংলাদেশ থেকে বন্যপ্রাণী পাচার

নাসির উদ্দিন ও অন্য গবেষকদের 'এক্সপ্লোরিং মার্কেট বেইজড ওয়াইল্ডলাইফ ট্রেড ডায়নামিক্স ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা গেছে, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মিয়ানমারসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর চাহিদা রয়েছে।

২০২২ সালের নভেম্বরে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় বাংলাদেশের ১৩টি বন্যপ্রাণীর বাজার জরিপ করা হয় এবং বন্যপ্রাণী বিক্রির সঙ্গে জড়িত ৪২১ ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়।

আরেকটি গবেষণা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত 'লন্ডারড অ্যালাইভ? দ্য ট্রান্সন্যাশনাল ট্রেড ইন ওয়াইল্ড ফেলিডস থ্রু বাংলাদেশ' এ দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার ১৩টি দেশে বাঘজাত বিভিন্ন পণ্য পাচার হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনের সহলেখক নাসির উদ্দিন বলেন, 'দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও কেনিয়া মূলত এই চার দেশ বাংলাদেশে জীবিত ফেলিড (বিড়াল পরিবারের স্তন্যপায়ী প্রাণি) রপ্তানি করে।'

এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের চারটি, দক্ষিণ এশিয়ার চারটি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চারটি এবং পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশসহ বাংলাদেশ থেকে জীবন্ত বন্যপ্রাণী আসে এমন ১৫টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে জীবিত ফেলিডের শীর্ষ গন্তব্য ভারত। তারপরেই মিয়ানমার, চীন ও মালয়েশিয়া।

গবেষণার জন্য সাক্ষাৎকারের সময় অন্তত আটজন বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ী বলেছেন, পাচারকারীরা বাংলাদেশ থেকে স্থানীয় ও বিদেশি দুই ধরনের ফেলিডই ভারতে পাচার করে।

বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে গবেষণায় বলা হয়, পাচারকারীরা অনেক সময় সিআইটিইএস-এর (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পিসিজ অব ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা) জাল পারমিট নিয়ে প্রথমে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী পাচার করে পরে অন্য দেশে পাচার করে।

সাক্ষাৎকারে তারা জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে আকাশপথে জীবন্ত বন্যপ্রাণী আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু তারা স্থল সীমান্ত ব্যবহার করে সেগুলো ভারত ও মিয়ানমারে পাচার করে।

নাসির উদ্দিন ও অন্যান্যদের গবেষণায় বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোতে বন্যপ্রাণী পাচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে বাংলাবান্ধা, ভুরুঙ্গামারী, বেনাপোল, টেকনাফ, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও তামাবিল।

গত বছরের নভেম্বরে ওয়াইল্ডলাইফ জাস্টিস কমিশনের পৃথক এক গবেষণায় দেখা যায়, থাইল্যান্ড থেকে বাঘ শাবক বাংলাদেশে আনা হয়।

নাসির বলেন, 'আগে আমরা জানতাম বাঘের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি জীবন্ত বাঘের বাচ্চাও বাংলাদেশে আসছে। কিন্তু এগুলোর কী হচ্ছে তা আমরা জানি না।'

২০১৬ সালে ইন্টারপোলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচারকারীরা ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে হিমায়িত খাবারের চালান দিয়ে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, চীন ও কোরিয়ায় বাঘের বিভিন্ন অংশ রপ্তানি করে।

নাসির উদ্দিন বলেন, তিনি ২০২২ সালে সিআইটিইএসের ওয়েবসাইট থেকে রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে রপ্তানিকারক দেশগুলো বাংলাদেশে ১৮৮টি ফেলিড রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ আমদানির কথা জানিয়েছে মাত্র চারটি। অন্যদিকে বাংলাদেশ আরও ১৬টি পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়েছে, যা কোনো রপ্তানিকারক দেশ জানায়নি।

এসব ফেলিডের বেশিরভাগই বাংলাদেশ হয়ে অন্য দেশে পাচার হয় উল্লেখ করে বৈধ বন্যপ্রাণী আমদানির জন্য ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বিপন্ন প্রজাতি

বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যে মোটামুটি সমৃদ্ধ হলেও আবাসস্থল হারানোর কারণে বন্যপ্রাণী বাণিজ্য দেশের বিভিন্ন অভয়ারণ্যে বন্যপ্রাণীর ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী ১ হাজার ৬১৯টি বন্যপ্রাণী প্রজাতির মধ্যে ৩১৩টি বিভিন্ন মাত্রার হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে ১৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১০ প্রজাতির পাখি, ১৭ প্রজাতির সরীসৃপ, দুই ধরনের উভচর ও এক প্রজাতির প্রজাপতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন।

আইইউএনসির মূল্যায়নে দেখা গেছে, প্রায় ২৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ স্তন্যপায়ী, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ পাখি, ২২ দশমিক ৭৬ শতাংশ সরীসৃপ, ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ উভচর এবং ৬১ দশমিক ৬৩ শতাংশপ্রজাপতি হুমকির মুখে।

একটা গাড়ি আর সাত জন লোক

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক সানাউল্লাহ পাটোয়ারি বলেন, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী পাচারের উৎস ও ট্রানজিট রুট।

প্যাটাগনিয়ান মারা, জেব্রা বা সিংহ শাবকের মতো বন্যপ্রাণী কীভাবে দেশে ঢুকতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ নিশ্চয়ই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এগুলো আমদানি করেছে।

ঢাকা বিমানবন্দরে এই ইউনিটের কোনো ডেস্ক না থাকায় পাচারকারীদের জন্য বন্যপ্রাণীর চালান ছাড়িয়ে নেওয়া সহজ হয়।

এছাড়াও, বিমানবন্দরের কর্মকর্তা বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বিপন্ন বন্যপ্রাণী শনাক্ত করতে এবং তাদের পাচার রোধে কোনো প্রশিক্ষণও নেই।

এই ইউনিটের একটি মাত্র গাড়ি আছে। তবে জ্বালানি তেলের কোনো বাজেট না থাকায় হঠাৎ কোনো অভিযান চালানো কঠিন হয়ে যায়।

কর্মকর্তারা বলেন, উদ্ধার অভিযান চালাতে চাইলে প্রথমে তাদের নিজেদেরই জ্বালানি খরচ দিতে হয়, তারপর বিল জমা দিতে হয়।

সানাউল্লাহ বলেন, 'বর্তমানে বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট একজন পরিচালকের অধীনে তিন জন পরিদর্শক, দুই জন স্কাউট এবং দুই জন আউটসোর্সিং কর্মকর্তার সমন্বয়ে চলছে। এটাই আমাদের পুরো জনবল।'

Comments

The Daily Star  | English
health reform

Priorities for Bangladesh’s health sector

Crucial steps are needed in the health sector for lasting change.

17h ago