‘সমালোচনা করাটা সীমিত ও প্রশংসা করাটা অনেক বাড়াতে হবে’

শামীম আশরাফ। ছবি: সংগৃহীত

'আমার সন্তানেরা আকাশ দেখতে পারে না, আমি সেই কথা বলি। আমার ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যায়, আমি সেইসব কথা বলি। আমি আমার এই জনপদের মানুষের কথা বলি। আমি কবিতায় কথা বলি। আমার উচ্চারণে কথা বলি সুন্দরের। এটিই হচ্ছে আমার অপরাধ।'

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে কথাগুলো বলতে শোনা যায় ময়মনসিংহের কবি ও গ্রাফিক ডিজাইনার শামীম আশরাফকে।

জনদুর্ভোগ ও নগরীর সমস্যা নিয়ে পোস্টার ডিজাইন করায় গ্রেপ্তার ও জামিনের পর এই কবির বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলাও করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। শামীমকে গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের মাধ্যমে এমন বার্তাই দেওয়া হচ্ছে, যাতে কেউ কোনো কর্তৃপক্ষের সমালোচনা না করে।

এই পোস্টারগুলো ডিজাইন করার কারণে শামীম আশরাফকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার শামীমকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ময়মনসিংহের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. তাজুল ইসলাম সোহাগ জামিন মঞ্জুর করেন। একই সময়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষে প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাঞ্চন কুমার নন্দী বাদী হয়ে ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা দায়ের করেন।

এর আগে রোববার রাতে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আটকের পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে শামীম আশরাফকে সোমবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

শামীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পোস্টার ডিজাইনের মাধ্যমে তিনি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এবং সিটির সদ্য সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছেন। টিটু একইসঙ্গে ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আগামী ৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় সিটি নির্বাচনের একজন প্রার্থী।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনের সঙ্গে।

এ ব্যাপারে শাহদীন মালিকের ভাষ্য, 'সিটি করপোরেশনের কাজ সম্পর্কে নাগরিকের পক্ষ থেকে সমালোচনা করলে যদি ফৌজিদারি মামলার শিকার হতে হয়, তাহলে এর একটাই উপসংহার আছে যে কোনো কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করা যাবে না। সমালোচনা করলে ফৌজদারি মামলার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সমালোচনা করতে হবে।'

এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর পর্যবেক্ষণ হলো—'এখন কর্তৃত্ববাদী সরকার থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি আমরা। স্পষ্ট বিবর্তন হচ্ছে। এর প্রভাব হলো আমাদের সবাইকে সমালোচনা করাটা অনেক সীমিত করে ফেলতে হবে। আর বাহবা দেওয়াটা অনেক বাড়াতে হবে। প্রশংসা করাটা অনেক বাড়াতে হবে।'

গতকাল বিকালে জামিন মঞ্জুরের চিঠি কারাগারে পৌঁছলে শামীমকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি কারাগার থেকে বের হলে সংস্কৃতিকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাকে বরণ করে নেন। শামীমকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এদিন ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণাসহ বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধনও করেন সংস্কৃতিকর্মীরা। তাদের বক্তব্য, নাগরিক সমস্যা নিয়ে পোস্টার করা কোনো অপরাধ নয়।

বিষয়টি নিয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, 'একজন নাগরিক জনদুর্ভোগ নিয়ে কথা বলতে পারেন। কার্টুন আঁকতে পারেন। লিখতে পারেন। কিন্তু যখন প্রথম তাকে (শামীমকে) সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হলো, সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হলো, তখন এটা খুব স্পষ্ট যে এর মধ্য দিয়ে মানুষের কথা বলা, মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।'

মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের 'গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার অ্যাওয়ার্ড' পাওয়া নূর খান লিটন আরও বলেন, 'সে জন্যই এ ধরনের (সাইবার নিরাপত্তা) আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। মানুষকে বোবা বানিয়ে তোলার একটা চেষ্টা বলে আমি মনে করি।'

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির সদস্য নূর খান মনে করেন, 'এর মধ্য দিয়ে সমাজের অন্যদেরও এমন একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে যাতে এই ধরনের কার্যক্রম কেউ না করে। অর্থাৎ মানুষ যাতে সমালোচনা না করে। যৌক্তিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না তোলে। মানুষ যাতে সংঘটিত না হতে পারে। কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। কারও দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে না পারে।'

এভাবে চলতে থাকলে একসময় সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো লোক পাওয়া যাবে না মন্তব্য করে নূর খান আরও বলেন, '(এভাবে চলতে থাকলে) এটা একটা অনৈতিক সমাজে রূপান্তরিত হবে, যে সমাজে মানুষ থাকবে কিন্তু মনুষ্যত্ব থাকবে না। মানুষের স্বাধীন বিবেক থাকবে না। মানুষের চিন্তা করার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকবে না। ফলে বোধশক্তিহীন একটা অবস্থার মধ্যে আমরা পড়ে যাব। ইতোমধ্যে ওই জায়গার মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। চোখের সামনে অনেককিছু ঘটলেও আমাদের সাহসে কুলায় না সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করার।'

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago