ড. ইউনূসের অভিযোগের জবাবে যা বললো গ্রামীণ ব্যাংক
নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল করে নেওয়ার অভিযোগ তোলার পরে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে গ্রামীণ ব্যাংক।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদ বলেছেন, 'এখানে কিন্তু উনাদের কোনো শেয়ার হোল্ডিং নেই। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এখানে অধ্যাপক ইউনূসের কোনো টাকা নেই।'
তিনি আরও বলেন, আইন অনুযায়ী তারা তিনটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মনোনয়ন দিয়েছেন। ড. ইউনূস এখন আর সেসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নন।
আজ শনিবার মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই কথা বলেন।
সাইফুল বলেন, 'আমাদের সব মিলিয়ে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার সংখ্যা এক কোটি পাঁচ লাখ। আমরা চেষ্টা করছি তাদের আইনগত অধিকার রক্ষা করার জন্য যেগুলো ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু নেই। আমরা একসঙ্গে কাজও করতে চাই।'
গত ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারির প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, 'এমন কিছু হয়নি, উনাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণের যে তথ্য এসেছে সেটা প্রকৃতপক্ষে সত্য নয়। শুধু একজন, গ্রামীণ কল্যাণের যিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উনি রূঢ় আচরণ করেছেন। ভালো হতো উনি যদি রূঢ় আচরণ কম দেখাতেন। সে জন্য হয়তো সামান্য কিছু হতে পারে।'
সংবাদ সম্মেলনে একটি লিখিত বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়। সাইফুল বলেন, 'পুরো তথ্য দেওয়া হয়নি, কারণ অনেক তথ্য আছে। গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ শক্তি, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন—আমি শুনলাম, অধ্যাপক ইউনূস টেলিভিশনের বলেছেন, এগুলো বড় হয়েছে মুনাফা করে। কিন্তু এই প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান কিন্তু নট ফর প্রফিট। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করার জন্য না। সারপ্লাস যদি হয়, জনকল্যাণে উনারা কাজে লাগাতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'সবাই বলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠান নয়। কেননা, এই প্রতিষ্ঠানগুলো নট ফর প্রফিট; লিমিটেড বাই গ্যারান্টি। অধ্যাপক ইউনূস এবং যারা পরিচালনা পর্ষদে আছেন, উনারা কিন্তু টাকা দেননি। টাকাগুলো গ্রামীণ থেকে গেছে। গ্রামীণের বোর্ডে অনুমোদিত হয়েছে এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন করার জন্য গ্রামীণ শুধু অনুমোদনই দেয়নি—গ্রামীণ পরিচালনা পর্ষদ অর্থ দিয়েছে, গ্রামীণে যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন, তারা অনেক শ্রম ব্যয় করেছেন। বছরের পর বছর উনারা খেটেছেন। গ্রামীণের অনেক পুরোনো কর্মচারীকে কাজে লাগানো হয়েছে।
'সব থেকে বড় কথা হলো, অধ্যাপক ইউনূস কিন্তু চেয়ারম্যান ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক; ফাউন্ডিং এমডি, ফাউন্ডার এমডি না। আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি, উনারা এতগুলো প্রতিষ্ঠানের ৫১-৫২টি, এই সংখ্যা নিয়ে একটু মতভেদ আছে, গ্রামীণ ব্যাংকের পূর্ণকালীন কর্মকর্তা হিসেবে উনারা এতগুলো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কী করে পরিচালক হলেন? এ ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষে যথাযথ অনুমতি লাগে। অধ্যাপক ইউনূস সবগুলো চেয়ারম্যান। গ্রামীণ কল্যাণ হয়েছে ১৯৯৬ সালে এবং তার দুবছর পর তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু উনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আজীবন চেয়ারম্যান। এটা খুবই অস্বাভাবিক,' বলেন তিনি।
১৯৮৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অডিট করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি, এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত নব্বইয়ের দশকে হয়েছে। আমরা কোনো লেজার খুঁজে পাইনি। যেহেতু আমরা পাইনি, আমরা জিডি করেছি।'
সাইফুল বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩ আইনগত কাঠামোতে স্পষ্ট করে লেখা আছে, গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা কোথায় কোথায় যেতে পারবে। আমরা আইনজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করেছি, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিটি টাকা ব্যয় হবে গ্রামীণের বিত্তহীন, দরিদ্রদের জন্য। অন্য কোথাও নিয়ে, অন্যভাবে এই টাকা খরচ করার এখতিয়ার নেই।'
গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'এখানে কিন্তু উনাদের কোনো শেয়ার হোল্ডিং নেই। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এখানে অধ্যাপক ইউনূসের কোনো টাকা নেই। গ্রামীণ কল্যাণে নেই, গ্রামীণ টেলিকমে নেই, গ্রামীণ পরিবারের অনেকগুলো বোর্ড সভায় অনুমোদন দিয়েছেন। কোথাও লিখেছেন অবহিত করেছেন। বোর্ড যদি আরও সক্রিয় হতো, তাহলে ভালো হতো।'
গ্রামীণ কল্যাণ নিয়ে আংশিক তথ্য উপস্থাপন করে সাইফুল বলেন, '৪২তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোম্পানি আইনের আওতায় গ্রামীণ কল্যাণ নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব অনুমোদন করা হলো। টাকাটা যেভাবে গেল—গ্রামীণ কল্যাণ প্রতিষ্ঠার পর গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণদানের জন্য অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত। গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল আছে এসএএফ; এই তহবিল থেকে ৪৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা গ্রামীণ কল্যাণে হস্তান্তর করা হয়। এগুলো সব গ্রামীণের টাকা। এর আগেও বেশ অনেক টাকা দেওয়া হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণদানের জন্য অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত ৪৪৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা কল্যাণে স্থানান্তর করা হয়। এটা ১৯৯৫-৯৬ সালের কথা।'
তিনি আরও বলেন, 'উনাদের কোনো শেয়ার হোল্ডিং নেই। যারা পরিচালনা পর্ষদ এত দিন চালিয়েছেন বা প্রফেসর ইউনূস সবগুলোতে চেয়ারম্যান ও পরিচালক উনার কিন্তু শেয়ার হোল্ডিং নেই। কোনো মালিকানা নেই। মালিকানার জন্য উনারা কেউ টাকা দেননি। গ্রামীণ কল্যাণে প্রথম পরিচালক ছিলেন নয়জন। প্রফেসর ইউনূস হয়েছেন চেয়ারম্যান। বাকিরা যারাই ছিলেন, তারা গ্রামীণের পূর্ণকালীন কর্মকর্তা।'
গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, 'সাতটি প্রতিষ্ঠানে আইন অনুযায়ী আমরা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বোর্ডের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান নমিনেশন দিতে পারি এবং দুই জন পরিচালক নিয়োগ দিতে পারি। আমরা সেটাই করেছি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আমরা শুধু এই কাজটি করেছি।
'প্রশ্ন করতে পারেন এত বছর পর কেন? কোনোটা করার কথা ছিল ১৯৯৮ সালে, কোনোটা ১৯৯৭ সালে। আমরা অবৈধ কিছু করিনি। গ্রামীণের ৭৫ শতাংশের মালিক এখন আমাদের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা সদস্য। বাকি ২৫ শতাংশের মালিক সরকার। সেভাবে তারা টাকা দিয়েছেন। ১৯৮৩ সালে ৬০ শতাংশ টাকা দিয়েছিল সরকার। বাকি ৪০ শতাংশ টাকা দিয়েছিলেন আমাদের ঋণ গ্রহীতারা। মূল কথা হচ্ছে, প্রফেসর ইউনূস মালিক না। উনার সঙ্গে যারা আছেন তারাও মালিক না। আমরাও মালিক না। আমরা নেমেছি, গ্রামীণে আইনগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আমরা বেআইনিভাবে কিছু করতে চাই না, আইনিভাবে চলবো,' যোগ করেন তিনি।
সাইফুল বলেন, 'আমরা যা করছি, গ্রামীণের তরফ থেকে করছি। কারও কোনো তরফ থেকে আমরা কিন্তু কথা বলতে আসিনি।'
কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মিটিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তিনটি চেয়ারম্যান নমিনেশন দিয়েছে। আমরা আইন অনুযায়ী দেখেছি, আগে যিনি ছিলেন উনার চেয়ারম্যান থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ ফান্ড।'
তিনি বলেন, 'আমরা তো জবরদখল করতে যাইনি। আইনি মতে যতদূর বুঝি, (ড. ইউনূস) উনি এখন চেয়ারম্যান নন।'
এর আগে গত বৃহস্পতিবার গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকম ভবনে থাকা আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল করে নেওয়ার অভিযোগ তুলে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'আমরা বহু রকমের দুর্যোগের ভেতর দিয়ে যাই। এ রকম দুর্যোগ আর দেখি নাই কোনোদিন যে, হঠাৎ করে বাইরের থেকে কিছু লোক এসে বললো তোমরা সরে যাও।'
Comments