জীবনানন্দ দাশের যে চেয়ার লুট করে নিয়েছিল রাজাকাররা

কবি জীবনানন্দ দাশের চেয়ার। ছবি: টিটু দাস/স্টার

'আবার চেয়ার থেকে উঠে— ব'সে— উলের বুনুনি ভুলে গেল ব'লে

'নতুন শেখার কিছু আছে না-কি আমাদের পরিপৃক্ত সূর্যের নিচে—'

'হয়তো-বা কোনও এক আমোদিত দার্শনিক বলেছিল রক্তের আলোড়নে মেতে

ঢের আগে;— আমিও রক্তের তাতে ব'লে যাই সব

কারণ অনেক দিন— পৃথিবী ও নরকের ঘটনাচক্রের

সন্নিবেশে কান পেতে থেকে তবু নতুনকে পাই নাই টের—'

আজীবন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একাকী কবিতাচর্চা করা 'শুদ্ধতম কবি' জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা শুরু হয়েছে এভাবে। যেখানে 'আবার চেয়ার থেকে উঠে— ব'সে'- 'কোনও এক আমোদিত দার্শনিক'- নতুনকে টের না পেলেও জীবনানন্দ দাশের ব্যবহৃত একটি চেয়ারকে ৭৬ বছর ধরে আগলে রেখেছেন বরিশালের আরেক কৃতি সন্তান তপংকর চক্রবর্তী। অতি যত্নে রাখা চেয়ারটি এখনো নতুনের মতোই লাগে।

শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ প্রাপ্ত তপংকর চক্রবর্তী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের পরিবারের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের পরিবারের ছিল গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৮ সালে জীবনানন্দ দাশের বসে লেখার এই চেয়ারটি তার বাবাকে দেন কবির পিসি স্নেহলতা দাশ। সেই থেকে তারা ৭৬ বছর ধরে আগলে রেখেছেন এই চেয়ার।

তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় চেয়ারটি রাজাকাররা লুট করে নিয়ে যায়। পরের বছর তারা আবার সেটি খুঁজে পান। তখন থেকে চেয়ারটি তাদের কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের বাড়িতে সংরক্ষিত আছে।

তপংকর চক্রবর্তী বলেন, 'আমার বাবা শৈলেশ্বর চক্রবর্তী যুগান্তর বিপ্লবী দল ও তরুণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে কংগ্রেসে যোগ দেন, এমনকি বরিশাল জেলার সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমাদের পরিবারের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের পরিবারের ছিল গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৬ সালে জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় চলে যান। ১৯০৩ সালে তার জ্যাঠা হরিচরণ দাশগুপ্ত বর্তমান কবি জীবনানন্দ দাশ সড়কে (বগুড়া রোড) জায়গা কিনে ভিটে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। আমাদের জানামতে, এখানে তাদের ৫-৬ বিঘা জমি ছিল।'

'এই জায়গায় জীবনানন্দ দাশের পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত একটি খড়ের বাড়ি তৈরি করেন, যার নাম ছিল "সাধন কুটির", তিনি এখানেই থাকতেন। পরে এই জায়গাটি "সর্বানন্দভবন" নামে নামকরণ হয়। এই জায়গাতেই জীবনানন্দ দাশের পুরো পরিবার থাকতেন। জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় চলে যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে তার পিসি স্নেহলতা দাশ চেয়ারটি বাবাকে দেন', বলেন তিনি।

তপংকর চক্রবর্তী বলেন, 'চেয়ারটি দেওয়ার সময় স্নেহলতা দাশ বাবাকে বলেছিলেন, "মিলু (জীবনানন্দের ডাকনাম) এই চেয়ারে বসে লেখালেখি করতো, চেয়ারটি খালি পড়ে আছে- আমার খুব খারাপ লাগছে, তুমি এই চেয়ারটি নিয়ে যাও"।'

তিনি বলেন, 'সেগুন কাঠের চেয়ারটি একসময় কালো রঙের ছিল। ভেতরে লোহার জয়েন্টগুলো নড়বড়ে হয়ে যায়। পরে এটিকে আমরা মিস্ত্রী দিয়ে মোরামত করে লাল রঙের বার্নিশ করি।'

জীবনানন্দ দাশের পিসি স্নেহলতা দাশ দীর্ঘদিন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক গোলযোগের সময় তাকে বরিশাল ত্যাগ করতে হয়। পরবর্তীতে জীবনানন্দ দাশের পরিবারের কেউ আর বরিশালে আসতে পারেননি।

তপংকর চক্রবর্তী বলেন, '১৯৭১ সালে রাজাকাররা আমাদের বাড়িটি দখল করে নেয়। এসময় অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে তারা চেয়ারটিও লুট করে। পরে ১৯৭২ সালে বাজার রোডের একটি দোকানে আমরা চেয়ারটি আবিষ্কার করি। চেয়ারটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই একে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। আমি দোকানদারকে চেয়ারটি দিতে বললে সে জানায়, ২০ টাকায় কিনে রেখেছে। পরে ৩০ টাকায় সেটি কিনে বাসায় ফিরি। সেই থেকে চেয়ারটি আমার বাসায় সংরক্ষিত আছে।'

তপংকর চক্রবর্তী জানান, ১৯৭২ সাল থেকে চেয়ারটি তার বাড়িতে সংরক্ষিত আছে। ছবি: টিটু দাস/স্টার

'আমি চাই জীবনানন্দ দাশের কোনো স্মৃতিশালা বা ইনস্টিটিউটে চেয়ারটি দিয়ে দিতে, কিন্তু সেরকম প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় আমরা চেয়ারটি কোথাও দিতে পারছি না', বলেন তিনি।

এদিকে, রূপসী বাংলার কবির স্মৃতি-বিজড়িত চেয়ারটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন বরিশালের জীবনানন্দপ্রেমীরা।

সাহিত্যিক অরূপ তালুকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটি গবেষণা ইনিস্টিটিউট বরিশালে গড়ে উঠুক, সেটি তার জন্মভিটায় হতে পারে বা অন্য কোনো সরকারি জায়গায়। এটি হলে মানুষ জীবনানন্দ দাশের টানেই বরিশালে ছুটে আসবে।'

আজ শনিবার জীবনানন্দ দাশের ১২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সরকারি ব্রজমোহন স্কুল ও কলেজে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী 'জীবনানন্দ মেলা'। এই আয়োজনে আলোচনা, প্রদর্শনীসহ জীবনানন্দ দাশের পাঁচটি কবিতা থেকে প্রথবারের মতো গান পরিবেশিত হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

28m ago