দুই কব্জি হারিয়েও হার মানতে নারাজ

ছবি: হাবিবুর রহমান

১৯৯৮ সাল। যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধুলগ্রামের বাসিন্দা এসএম কামরুল ইসলাম বাবুর জীবনে ঘটে হৃদয়বিদারক এক ঘটনা। মাছের ঘেরে শ্যালো মেশিন দিয়ে কাজ করার সময় তার দুই হাতে গুরুতর আঘাত লাগে।

সেই দুর্ঘটনার পরের চিকিৎসা প্রক্রিয়া ছিল দীর্ঘ ও জটিল। তবে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের কাছে কোনো বিকল্প উপায় থাকেনি। বাবুর দুই হাতের কব্জি থেকে নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়।

দেশের খুলনা অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে শৈশব থেকেই জড়িত বাবু। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ড্রাগন কারাতে ক্লাব থেকে মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্টও অর্জন করেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেসময় তাকে ভীষণ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল।

এরপর ২৫ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি বাবুকে। তিনি এখন অভয়নগর বাজারে অটোরিকশা-টেম্পুর ক্রম ও সময় নির্ধারণের কাজ করেন। এভাবেই তার পাঁচজনের সংসার চলে, যেখানে তার স্ত্রী, মা ও দুই মেয়ে রয়েছেন।

কব্জি ছাড়াই সাইকেল ও মোটরসাইকেলের পাশাপাশি গাড়ি চালাতে পারায় গর্ববোধ করেন বাবু। তিনি আরও শিখেছেন কীভাবে লিখতে হয়, মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হয় এবং দৈনন্দিন সমস্ত কাজকর্ম করতে হয়।

বাবুর অদম্য প্রাণশক্তি নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা জাগানিয়া। তবে তাকে যে বিষয়টি বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে তা হলো, খুলনা ও আশেপাশের জেলায় ফুটবল ম্যাচে রেফারিংয়ের জন্য তিনি সব সময় তৈরি থাকেন।

খুলনা জেলা ফুটবল রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বাবু অন্যান্য জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে ম্যাচে রেফারির দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব পেয়ে থাকেন। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পরও খেলাধুলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা হারিয়ে যায়নি। এক সময় তিনি নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। আরেকটি খেলার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল— ক্যারাম।

দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদককে তিনি বলেছেন, 'আপনি ইচ্ছাশক্তির জোরে যে কোনো কাজ আয়ত্ত করতে পারেন। মানুষের পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। অল্প চেষ্টাতেও অনেক কিছু অর্জন করা যায়।'

পাইওনিয়ার ফুটবল লিগের পাশাপাশি খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগে ম্যাচ পরিচালনায় থাকেন বাবু। লাইন্সম্যান হিসেবে তার টাচলাইনে দৌড়ানো একটি নিয়মিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ ধরনের রাবার দিয়ে তার হাতে পতাকা বাঁধা থাকে।

রেফারি হিসেবে বাবুর পথচলা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। নিজের গ্রামে একটি ফুটবল ম্যাচ পরিচালনার পর তার পরিচিতি বেড়ে যায়। এতে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে খেলা পরিচালনা করার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক পেতে শুরু করেন।

খুলনা জেলা স্টেডিয়ামে ২০১৪ সালে খুলনা জেলা ফুটবল রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহসানুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে বাবুর। রেফারিংয়ের প্রতি বাবুর প্রচণ্ড আগ্রহের বিষয়টি ধরে ফেলতে সময় লাগেনি এহসানুলের। তিনি বাবুর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

শারীরিক প্রতিকূলতাকে জয় করে চলা দুর্বার বাবুকে নিয়ে এহসানুল বলেছেন, 'বাবু সব বাধা অতিক্রম করেছেন। তিনি সাবলীলভাবে লিখতে পারেন। তাই চতুর্থ রেফারির দায়িত্ব পালনেও তার কোনো সমস্যা হয় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি নিজেকে প্রতিবন্ধী হিসেবে বিবেচনা করেন না।'

অল্প সময়ের মধ্যেই বাবু 'ক্লাস থ্রি' রেফারি সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। এরপর ২০১৭ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আরেকটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে 'ক্লাস টু' সার্টিফিকেট লাভ করেন তিনি।

বাবু জানান, সাবেক ফিফা রেফারি মনসুর আজাদ এবং প্রয়াত ফিফা রেফারি ও বাংলাদেশ ফুটবল রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম নেসার তাকে 'ক্লাস টু' রেফারি হওয়ার সাফল্যমণ্ডিত যাত্রায় সর্বাত্মক সহায়তা করেন।

বাবু কখনোই চান না যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দিয়ে তাকে মাপা হোক, 'যে ব্যক্তির দুই হাত নেই সে অনেক কিছুই করতে পারে না। তবে আমি নিজে থেকে সবকিছু করার চেষ্টা করেছি। স্রেফ আমি যখন আটকে গেছি, তখনই অন্যদের সাহায্য নিয়েছি।'

স্বপ্ন পূরণের পথে ভীষণ কঠিন বাধা অতিক্রম করা বাবু একটি সরল অথচ শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে— যারা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করছেন, 'চেষ্টা করলে সবকিছুই সম্ভব। কঠোর পরিশ্রম কাউকে বঞ্চিত করে না। আপনি যদি কাজ করতে শিখেন, তাহলে আপনি ফল পাবেনই। যা কিছুই ঘটুক না কেন, কখনো আশা হারাতে নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Foreign adviser’s china tour: 10 extra years for repaying Chinese loans

Beijing has agreed in principle to extend the repayment period for Chinese loans and assured Dhaka it will look into the request to lower the interest rate to ease Bangladesh’s foreign debt repayment pressure.

6h ago