সাক্ষাৎকার

শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজে খরা চলছে : ওয়াকিল আহমদ

লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ওয়াকিল আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনায় ছিলেন দীর্ঘদিন। চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম গবেষণা । বিভিন্ন বিষয়ে তার বই রয়েছে অর্ধশতাধিক। সাহিত্য গবেষণা কীর্তির জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক। ১৯৪১ সালের ৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার আজাদনগরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। তার গবেষণা, আমাদের শিক্ষা সমাজ ভাবনাসহ সাম্প্রতিক বিষয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভেতরে বিষয়টা এক ধরনের দোলাচল তৈরি করেছে। এক প্রবন্ধে আপনি বলেছেন – 'দুর্বল ও অপরিকল্পিত শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষাদান ও শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আলোকিত মানুষ তৈরি হচ্ছে না।' আজকের প্রেক্ষাপটে  আপনার মতামত জানতে চাই।

ওয়াকিল আহমদ: আমাদের দেশের শিক্ষার অতীত ইতিহাস খুঁজলে প্রথমে মঠ-মন্দির-মক্তব-মাদ্রাসাশিক্ষার ও পরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কথা বলতে হয়। প্রথম ধারা প্রাচীন ও মধ্যযুগের; ধর্মীয় ও বৈষয়িক শিক্ষার মিশ্রণ ছিল। দ্বিতীয় ধারার শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয় ইংরেজ আমলে। আর আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি ছিল ইহজাগতিক, বৈষয়িক ও বৈশ্বিক।  স্বাধীনতা-উত্তর আধুনিক যুগেও এর ধারাবাহিকতা বজায় আছে। প্রথমে এটি  ছিল 'কেরানি' তৈরি করার শিক্ষা, এখন তা সর্বজনীন ও বিচিত্রমুখী হয়েছে। পরিসর বেড়েছে অনেক, মান ও গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বিস্তর। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাকার্যক্রম কতটা  উন্নত ও মানসম্মত? উন্নত না, এক বাক্যে বললে, বলা যায় এই শিক্ষানীতি হতাশা তৈরি করছে।

সাধারণ ধারণা– বইখাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে গেলাম, শিক্ষক শিখালেন এবং নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান দিলেন,পরীক্ষা হলো, পাশ করে সার্টিফিকেট পেলাম। তারপর একটা চাকরি জোগা হলেই হলো– এতেই জীবন ধন্য, আয়ু পার! গড়পড়তা এ ছাড়া আর কি স্বপ্ন আছে বলুন? অন্যদিকে বিদ্যালয়ের দেখভাল করার জন্য শিক্ষাবোর্ড  এবং  পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও কার্যক্রম বোর্ড রয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করার জন্য মঞ্জুরি কমিশন আছে। সবার উপরে আছে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রী। এদের ভূমিকা কি? কিছুই চোখে পড়ে না। কারণ হতে পারে আমাদের দেশে যোগ্যলোক যোগ্যস্থানে নেই। ছাত্ররা শিক্ষাকে বোঝা মনে করে, শিক্ষার সাথে আনন্দের যোগসূত্র নেই। উন্নত দেশগুলিতে ছাত্ররা শিক্ষালাভে আনন্দ পায়। আমাদের সেই ভাবনা নেই।

গণমাধ্যমে প্রায় সংবাদ আসে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। আমাদের শিক্ষা আনন্দহীন বলে? 

ওয়াকিল আহমদ: 'সুন্দর ভুবনে' কে মরতে চায়! তারপরও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। জীবনের প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে যে কোন মানুষ মৃত্যুর পথ বেছে নেয়।  বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ও কুন্দনন্দিনী বিষপান করে আত্মহত্যা করে। রবীন্দনাথের 'জীবিত ও মৃত' ছোটগল্পে কাদম্বিনী বাড়ির পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আর 'বিসর্জন' নাটকে জয়সিংহ বক্ষে ছুরিকাবিদ্ধ আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে অধিকাংশ আত্মহত্যা গলায় ফাঁসি দিয়ে ঘটে থাকে।  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রধানত হতাশা থেকে  আত্মহত্যা করে থাকে, যার উৎস ব্যর্থপ্রেম, স্বপ্নভঙ্গ, বঞ্চনা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, মাদকাসক্তি  ইত্যাদি  হতে পারে বলে আমার অনুমান। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেঁচে থাকার প্রেরণা কম! 

আপনি এক সময় শিক্ষা-সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। আজকের এই অবস্থার জন্য কোনো অনুতাপ অনুভব করেন?

ওয়াকিল আহমদ: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। তখন দেশের, সমাজের  অবস্থা যে ভাল ছিল, এমনটি নয়। ১৫ বছরের ব্যবধানে  অবস্থার উন্নতি দূরের কথা, আরও অবনতির দিকে গেছে। শিক্ষার কথাই বলি; এক সময় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষার হলে নকল চরমরূপ ধারণ করে। সেটার কিছু উত্তোরণ ঘটে।

'সেশন জট' ছিল চোখে পড়ার মতো ছিল। দলীয় ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গনে সংঘাত-সংঘর্ষ  প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে 'ফোর মার্ডারে'র  মতো হত্যাকাণ্ডও  ঘটেছে। এস এম হলের 'পাঁচপাত্তুর' কাণ্ড, হলে অছাত্রদের অবস্থান,  হলে হলে অস্ত্র, মলে ও রাস্তায় বন্ধুকযুদ্ধ, ভিসির ভবনে ককটেল-বোমা নিক্ষেপ, ছাত্রদের দ্বন্দ্বসংঘর্ষের কারণে যখন তখন বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধঘোষণা ইত্যাদি ঘটনাও ছিল। তারপরও বলবো, শিক্ষায় ও প্রশাসনে কিছু মূল্যবোধ ছিল। অনেক নামীদামী শিক্ষক ছিলেন, যারা শিক্ষার মান ধরে রেখেছিলেন।

এখনকার দৃশ্যপটটি ভিন্ন। আগের মতো ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মিটিং, মিছিল, শ্লোগান নেই, ছাত্ররাজনীতি বন্ধপ্রায়। দলীয়করণের ব্যাপারটা এখন নগ্নরূপ ধারণ করেছে। একদলীয় শাসন-তর্জন-গর্জনে সবকণ্ঠ চাপা পড়ে গেছে। শিক্ষকদের মধ্যে মেরুকরণ এমন হয়েছে যে, ভালমন্দ বিচার না করে তাঁরা ভাষণ-বিবৃতিতে রাজনীতির সুরে কথা বলেন। সমাজ একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠান, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। এই গতির ও পরিবর্তনের উত্থানপতন আছে। উত্থানে আনন্দ, পতনে বেদনা - একজন সচেতন সামাজিকের মতো আমারও হয়।  এরূপ  স্বাভাবিক সত্য  মেনে নিলে অনুতাপের কিছু থাকে না।

মানুষকে শুদ্ধ করে এমন গান-কবিতা রচিত হচ্ছে বলে মনে করেন?

ওয়াকিল আহমদ: বর্তমানে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজে খরা চলছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিশ শতকের প্রথম ও মাঝারি শ্রেণির কবি-কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার যারা ছিলেন, তাঁরা একে একে প্রয়াত হলে সে স্থান পূরণ করার মতো নতুন মুখ কমই চোখে পড়ে। সংগীতের ক্ষেত্রেও একই দশা– সম্ভাবনাময় নতুন গায়ক-গীতিকার-সুরকারের বেশ অভাব; স্থান দখল করছে পপগান জাতীয় মঞ্চকাঁপানো নাচ-গীত-বাদ্য। দেশে সংগীতশিক্ষানিকেতন রয়েছে, প্রতিশ্রুতিবান শিল্পীর আবির্ভাব নেই। 

টেলিভিশনে ঘটা করে গানের প্রতিযোগিতা হয়, অনেকে পুরস্কারও পায়।  টেলিভিশনের সস্তা নাটকও ছেয়ে গেছে, মঞ্চের নাটক নেই বললেই চলে। উপন্যাস-ছোটগল্প টিমটিম করে জ্বলছে। কবিতা ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে; এমন দুর্বোধ্য যে পাঠকের মনে একপ্রকার ভীতির সঞ্চার হয়। সংস্কৃতি হলো একটি জাতির দর্পণ; সেটা হারিয়ে গেলে ভালমন্দ বোঝার  কিছু  থাকে না। 

দেখা যায়, আমাদের জীবনে অনেক অস্থিরতা। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদাল- সব জায়গায় অস্থিরতা। এমন অস্থিরতা ও সমাজকে কোনদিকে নিয়ে যায়? 

ওয়াকিল আহমদ: মানুষ গতি ও  দিক হারিয়ে ফেললে অস্থিরতা দেখা দেয়। আবার স্থবির অবস্থায় ভিত দুর্বল হয়ে পড়লে  অস্থিরতা প্রকাশ পায়। আমাদের যাপিত জীবনে উভয় কারণে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে, তাই  বসে থাকতে পারি না, আবার গতি ও লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছি বলে চলতেও পারি না। আমাদের এখন দ্বিশঙ্কু অবস্থা। দেশের রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে এরূপ অস্থিরতা দৃশ্যমান। 

কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন – "অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।" এখন বিমানের খোলে চড়ে স্বদেশ যাচ্ছে ভিনদেশে। সমাজে অপরাধ জগৎটা বড় বাড়াবাড়ি করছে। ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, প্রতারক, মাদকসেবক তো আছেই, তার ওপর ভূমিদস্যু, বালুখোর, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী, কিশোরগ্যাং যোগ হয়ে  জোর-জুলুম-জালিয়াতির ক্ষেত্র প্রসারিত করে চলেছে। এদিকে একটা নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে; নাম তার 'স্যাংসন' বা নিষেধাজ্ঞা। ভাষানীতি, শ্রমনীতি, বাণিজ্যনীতি নামে নিষেধাজ্ঞার খড়গ ঝুলছে কখন কার ঘাড়ে পড়ে! দেশের অস্থিরতার আর কত নমুনা দিব? এগুলি এতই জাজ্বল্যমান যে খালি চোখে  নিত্যই দেখা যায়।  এ অস্থিরতা সমাজ গোল্লায় বা রসাতলে যাবে। আর আমরা অচিরে নষ্টজাতিতে পরিণত হবো; বাংলাদেশ হবে ব্যর্থরাষ্ট্র। 

এখন কী লিখছেন, পড়ছেন? কীভাবে সময় কাটে?

ওয়াকিল আহমদ: সারাজীবন লেখাপড়া করেছি, আজও করি। লেখাপড়ার সুবিধা হলো – সময় কাটানোর সমস্যা হয় না; বরং সময় পাওয়া যায় না। তবে বয়সের কারণে বেশি সময় দিতে পারি না। শরীর-মন  যতটুকু সয়, বিরতি দিয়ে তাই করি। বড় কাজের পরিকল্পনা নেই, ফরমায়েশি লেখা লিখে  থাকি। 

সম্প্রতি মৎপ্রণীত 'লালন গীতি সমগ্র' গ্রন্থের 'পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত' সংস্করণ সম্পন্ন করলাম। পূর্বের গ্রন্থ-ভুক্ত ৭৪০টি লালন গানের স্থলে ১০০০টি গান সন্নিবেশিত করেছি; এতে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে গ্রন্থের নাম পাল্টিয়ে 'লালন গীত সহস্র'  করা হলো।  পূর্বের সংস্করণে লালনগীতির শুদ্ধপাঠ, রূপরীতি, প্রকাশভঙ্গী ইত্যাদি বহিরাঙ্গনে বিচরণ করেছি, তত্ত্বের ভিতরে প্রবেশ করতে পারি নি। এবার লালনের শিল্পিতভাষার রূপক-প্রতীকের রহস্যভেদ করে  গানের  অর্থোদ্ধারের  চেষ্টা করেছি। তাও খুব জটিল ও শ্রমসাধ্য কাজ। তবু করে চলছি।

Comments

The Daily Star  | English

Steps taken to bring killings, disappearance cases to international courts: Yunus

Yunus reaffirmed the administration's commitment to justice, stating that legal action would be pursued for all acts of violence

2h ago