‘মামলা-হামলা সয়ে গেছে, নতুন কিছু আমাদের দমাতে পারবে না’
টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের মাথার ওপর ঝুলছে লাখো মামলার খড়গ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে কেবল ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২৩৪টি মামলা হয়েছে।
বিএনপির হিসাবে, গত বছরের ২৮ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ১৮২টি মামলায় দলের মোট ২৭ হাজার ৫০৭ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এক লাখের ওপর নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
আর ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ২৫ জুলাই পর্যন্ত বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখনো দলটির মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে কারাগারে আছেন। একই অবস্থা জেলা-উপজেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীর। আবার গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকে এখনো আত্মগোপনে আছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে সহিংসতা সংক্রান্ত মামলায় আগাম জামিন চেয়ে বুধবার শত শত মানুষকে হাইকোর্টে ভিড় করতে দেখা গেছে, যাদের বেশিরভাগই বিএনপি নেতাকর্মী।
এ অবস্থায় নির্বাচনের পর শুক্র ও শনিবার প্রথম কোনো কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে বিএনপি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হাজার হাজার মামলা ও 'দমন-পীড়নের' ভয় মাথায় নিয়ে বিএনপি 'কালো পতাকা মিছিলের' এই কর্মসূচি কতটা সফল করতে পারবে? এ ছাড়া, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলটির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাই বা কেমন হবে?
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ও যুগ্ম-মহাসচিব এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে।
দলের কেন্দ্রীয় এই নেতারা বলছেন, মূলত নেতাকর্মীদের ভয়-আতঙ্ক কাটানোর পাশাপাশি তাদের উজ্জীবিত করতেই নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এই পথ ধরেই তারা সামনে এগিয়ে যেতে চান। নেতাকর্মীদের বোঝাতে চান, দমন-পীড়নের এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যেতে হবে।
এ বিষয়ে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, 'আমাদের পার্টির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং অনেক নেতা… আমি নিজেও জেলে ছিলাম। অসুস্থতার কারণে হাইকোর্ট আমাকে জামিন দিয়েছেন। এখনো আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলখানায়। এ ছাড়া, অনেকের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত পরশু কিছু নেতাকর্মী জামিন পেয়েছেন। আগামী সপ্তাহে আরও অনেকের জামিন নিতে হবে।'
'নেতাকর্মীদের অনেকে এখন পর্যন্ত ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা পুলিশকে আমাদের নেতাকর্মীদের বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা নেতাকর্মীদের আবার নতুনভাবে উজ্জীবিত করার জন্য, সক্রিয় করার জন্য, আন্দোলন-সংগ্রামের সেই আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য, তাদের সাহস দেওয়ার জন্য এই কর্মসূচি নিয়েছি।'
শামসুজ্জামান দুদুর ভাষ্য, নির্বাচন ঘিরে এখন পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যেভাবে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে সরকার, তা নজিরবিহীন। স্বাধীনতার পর বিরোধী মত ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনের জন্য এমন উদাহরণ কেউ তৈরি করতে পারেনি।
এরপরেও আশাবাদের কথা জানিয়ে বিএনপির এই রাজনীতিক বলেন, 'আমরা আশা করি যে, নির্বাচনের আগে প্রত্যেকটা কর্মসূচিতে যেভাবে নেতাকর্মীদের সাড়া পাওয়া যেত, সেই সাড়া এবারও পাওয়া যাবে।'
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর গত রোববার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দাম, কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং 'অবৈধ সংসদ বাতিলের' দাবিতে শুক্র ও শনিবার কালো পতাকা মিছিলের ঘোষণা দেন।
শুক্রবার কালো পতাকা মিছিল হবে সকল জেলা সদরে এবং পরদিন শনিবার মিছিল হবে সকল মহানগরে।
এর পরবর্তী কর্মসূচি কেমন হবে জানতে চাইলে দুদু বলেন, 'পার্টির প্ল্যানিং কমিটি আছে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেই পার্টির চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এভাবে পার্টির হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন।'
শামসুজ্জামন দুদু আরও বলেন, 'আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিশ্বাস করি। গণতান্ত্রিক উপায়েই আমরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি যে, গণতান্ত্রিকভাবে এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমেই আমরা সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করব। এটাই আমাদের লক্ষ্য। ভয়-ভীতি-আতঙ্ক কাটিয়ে আবারও আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।'
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের অভিমতও একইরকম। তিনি বলেন, 'এমন হামলা-মামলার মধ্যেও আমাদের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত ছিল। তারা মাঠে ছিল, ভোট বর্জন করেছে, সবই করেছে। গত ১৬ ডিসেম্বরও বড় জমায়েত হয়েছে।'
'যেসব দেশে একনায়ক থাকে, স্বৈরাচার থাকে সেসব দেশে এমন মামলা হবে, গ্রেপ্তার হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই মনে হয় নতুন করে এমন কিছু আমাদের জন্য বাধা হতে পারবে না', যোগ করেন তিনি।
শুক্র ও শনিবারের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি থাকার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে খোকন বলেন, 'আমাদের ফোকাস একই। এক দফা, এক দাবি। পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে, ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।'
এ ছাড়া, ঢাকাসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তার জন্য সারাদেশে পাঁচ শতাধিক আইনজীবী কাজ করছেন বলেও জানান খোকন।
তিনি বলেন, 'তারা (আইনজীবীরা) নেতাকর্মীদের টাকা-পয়সা দিচ্ছেন ঢাকায় আসার জন্য। খাওয়াচ্ছেন। দলের লোকজনও সাহায্য করছেন। জেলা পর্যায়ের আইনজীবীরা দায়িত্ব নিয়েছেন।'
খোকন আরও বলেন, 'যেখানে স্বৈরাচার থাকে, একনায়ক থাকে তারা এরকম করেই। আমরা তো এগুলো গত ১৫-১৬ বছর ধরেই মোকাবিলা করছি। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এগুলো আমাদের সয়ে গেছে। নতুন করে কোনোকিছু আমাদের দমাতে পারবে না।'
Comments