খাদ্যপণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক পরিবার

খাদ্যপণ্য, মূল্যস্ফীতি, টিসিবি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট, বাংলাদেশের অর্থনীতি,
প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের ট্রাক থেকে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে দেখা যায় মানুষকে। ছবিটি রোববার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে তোলা। ছবি: আমরান হোসেন/স্টর

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা আছিয়া বেগম। অনেকদিনের মতো গতকাল রোববার ভোরেও শুরু হয় তারা লড়াই। এই লড়াইটা আর্থিক অনটনের সঙ্গে, পরিবার নিয়ে জীবনযাপনের সঙ্গে। গতকাল ভোরে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আছিয়া বেগম। তার লক্ষ্য সংসারের সামগ্রিক খরচ বহনে কিছু টাকা সাশ্রয় করা।

ভোরের শীত ও কুয়াশার মধ্যে প্রায় ১০ মিনিট হেঁটে রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ী মোড়ে পৌঁছান আছিয়া বেগম। সেখানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ওএমএস কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করা হয়।

৭৫ বছর বয়সী এই নারী বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। তবুও একটু দ্রুত হাঁটছিলেন। কারণ তার আশঙ্কা হয়তো লাইটি দীর্ঘ হবে এবং তার সিরিয়াল আসার আগেই সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাবে।

আছিয়া বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সকালে বেশ শীত ছিল। তবুও আমি সকাল সাতটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। আর্থিক সংকটে না পড়লে এই বয়সে শীতের সকালে কেউ এত তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়াত না।'

দীর্ঘ লাইনে আছিয়া বেগমের সিরিয়াল ছিল ৩৩। এর পরের ১০ মিনিটের মধ্যে লাইনটি অন্তত ৮০ জনের হয়ে যায়। অবশেষে প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে পণ্য কিনতে পারেন।

এই গল্পটা শুধু আছিয়া বেগমের নয়, ঢাকা শহরের জন্য খুবই সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে। যদিও গত তিন মৌসুমে বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে ধান উৎপাদিত হয়েছে।

দেশের শত শত পরিবার প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে লড়াই করছে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও জীবনযাত্রার ব্যয় তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষ।

বিশ্লেষকদের মতে, খাদ্যশস্যের অভাবে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা এজন্য দেশের দুর্বল বাজার ব্যবস্থাকেও দায়ী করেছেন।

২০২৩ সালের আগস্টে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

ডাব্লিউএফপির জরিপে দেখা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা ৪৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার, নয় শতাংশ মধ্য-আয়ের পরিবার এবং তিন শতাংশেরও কম উচ্চ আয়ের পরিবার।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও চলতি বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে।

২০১৮-২০২২ সালের মধ্যে দেশে ধানসহ খাদ্যশস্যের উৎপাদন চার বছরের গড় ৬ দশমিক ০৯ কোটি টন হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে দেশের মোট ধান উৎপাদন রেকর্ড ৫ কোটি ৯০ লাখ কোটি টন হওয়ার পূর্বাভাস আছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, 'উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তবে দেশের কৃষি বিপণনে দুর্বলতা আছে।'

তিনি বলেন, উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে যখন কোনো পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছায়, তখন এর দাম বহুগুণ বেড়ে যায়।

'সমস্যাটা সবাই জানে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না,' বলেন তিনি।

তিনি সরবরাহ ও চাহিদার জন্য বাজার নিয়ে দরকারি তথ্যের ঘাটতিকেও দায়ী করেছেন। তিনি জানান, 'উৎপাদন ও বাজারের চাহিদার তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষি বিপণন বিভাগকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।'

করোনা মহামারি ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষের আয় কমেছে, তাই তাদের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। যা নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়েছে।

তিনি বলেন, 'এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজার ম্যানিপুলেটরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই।'

তিনি মনে করেন, বাজার স্থিতিশীল করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্র পরিচালিত ওএমএস কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য হলো, ক্রমবর্ধমান খাদ্যপণ্যের দাম যেন নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর না পড়ে।

রাজধানীর ১১০টি স্থানসহ সারাদেশে ৯৬৪টি ওএমএসের দোকান পরিচালনা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যারা মুদি দোকান বা কাঁচাবাজারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে চাল এবং আটা বিক্রি করে।

আছিয়া বেগমের মতো গতকাল সকালে ওএসএসের সিরিয়ালে দাঁড়িয়েছিলেন তানজিলা আক্তার। রাজধানীর লালবাগ এলাকার বাসিন্দা তানজিলা আক্তার সকাল ৯টার দিকে আজিমপুরের অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে ওএমএস ট্রাকের লাইন ধরেন।

২৭ বছর বয়সী এই নারী তার নয় মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে পায়ে হেঁটে সেখানে যান। কিন্তু, পৌঁছানোর পর দেখতে পান ৪৩ জন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন।

তিনি বলেন, 'শীতের সকালে ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো খুব কঠিন। কিন্তু খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ওএমএসের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছি।'

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমিরেটাস অধ্যাপক আবদুস সাত্তার মন্ডল মনে করেন, তানজিলা আক্তার ও আছিয়া বেগমের মতো মানুষকে খাদ্যপণ্যের জন্য এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

তিনি বলেন, 'চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমি মনে করি, খুব শিগগির এই চাপ কমবে না।'

'যদিও আমরা খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বলছি। তবে আমরা রাসায়নিক, বীজ ও ডিজেলের মতো কৃষি উপকরণের মূল্যস্ফীতিও দেখেছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এগুলো সামগ্রিক দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে,' বলেন তিনি।

তিনি সরকারকে বেতন স্কেল বৃদ্ধি ও মজুরি সমন্বয় করার আহ্বান জানান। যেন মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করতে পারেন। এছাড়া তিনি বাজার ব্যসস্থায় সুশাসনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে বলেছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, বন্যার মতো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া বাংলাদেশে খাদ্য অভাবের কোনো সম্ভাবনা নেই।

'তবে, বাণিজ্যনীতিসহ বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে যেকোনো পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তাই হঠাৎ করে কোনো পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে সরকারকে সজাগ থাকার পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'সেক্ষেত্রে কাঁচাবাজারে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকার আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ ঘাটতি পূরণ করতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

10h ago