‘আমি খুব ভালো অভিনেতা হয়তো নই, কিন্তু আমার পরিশ্রম নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না’
ক্যারিয়ারের শুরুতে তার অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাই ছিল রিমেক, নতুন বলতে ছিল কেবল গান। গান দিয়েই বাজিমাত করেছেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক দেব।
কিন্তু শুধু রিমেক সিনেমা আর 'হিট' গান দিয়ে সিনেমার রানওয়েতে অভিনয়ের ক্যারিয়ার প্লেনের নিরাপদ টেক অফ বা ল্যান্ডিং সম্ভব নয় এটা তিনি জানতেন। তাই 'পাগলু' দেব পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন 'চ্যাম্প' এর বক্সার শিবাজী, 'ককপিট' এর পাইলট দিবেন্দু রক্ষিত কিংবা চাঁদের পাহাড়ের 'শঙ্কর'।
আজ ২৫ ডিসেম্বর দুই বাংলায় জনপ্রিয় এই চিত্রনায়কের জন্মদিন। ১৯৮২ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরে জন্ম নেন তিনি। সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনা ও রাজনীতিতেও সক্রিয় তিনি।
সিনেমা জগতে দীপক অধিকারী ওরফে দেবের যাত্রা শুরু হয় আব্বাস মাস্তানের সহকারী হিসেবে, ২০০৫ সালে। ২০০৭ সালে রবি কিনাগী পরিচালিত দেব অভিনীত প্রথম ব্যবসাসফল 'আই লাভ ইউ' সিনেমা মুক্তি পায়।
এরপর প্রায় ১৪ মাস সিনেমায় কাজ করা থেকে দূরে ছিলেন তিনি। এই সময়টায় তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ে। সেখানে এজাজ গুলাবের কাছে নাচ ও ফাইটিং শেখেন। ২০১০ সালে স্টার আনন্দ সেরা নতুন প্রতিভা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন দেব। এরপর থেকেই একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা দিয়ে টলিউডে অনন্য হয়ে ওঠেন তিনি।
২০০৯ সালে মুক্তি পায় দেব-শুভশ্রী জুটি প্রথম সিনেমা 'চ্যালেঞ্জ'। এ সিনেমার গানগুলোও এখনো মনে রেখেছে দর্শক। সিনেমাটি বক্সঅফিসে ৭ কোটি ৫৬ লাখ রুপি আয় করে। এরপর জুটি বেঁধে একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করেন দেব-শুভশ্রী।
এরপর 'পাগলু', 'পরাণ যায় জ্বলিয়া রে', 'খোকাবাবু', 'খোকা ৪২০', 'রোমিও'র মতো বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা দিয়ে বক্সঅফিসে নিজের আসন ধরে রাখেন দেব।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'শিরায় শিরায় রক্ত, আমরা দেব'দার ভক্ত' স্লোগানটি মূলত দেবের গানের জনপ্রিয়তারই প্রমাণ। তবে শুধু প্রশংসা নয় ক্যারিয়ারের দীর্ঘ সময়জুড়ে ট্রলেরও শিকার হয়েছেন দেব। তার অভিনয়, উচ্চারণ এবং তার প্রযোজিত সিনেমায় ব্যবহৃত ভিএফএক্স দৃশ্য নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।
তবে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানতেন দেব। তাই গান আর ফাইটিং দিয়ে সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ার পরেও তিনি শুধু ওইটুকুতেই আটকে থাকেননি, অভিনয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ২০১৭ সালে কলকাতায় প্রকাশিত সংবাদপত্র 'এই সময়'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেব বলেন, 'আমার মনে হয় এখন আর তেমন দিন নেই যে ১০টা ভালো গান আর ১০টা ফাইট দিয়ে সিনেমা উতরে যাবে। এগুলোর সঙ্গে ভালো গল্পও চান দর্শকরা। আর এটাও দেখেন অভিনেতা হিসেবে তিনি চরিত্রকে কতখানি জাস্টিফাই করতে পেরেছেন।'
সুজয়নীলের সঙ্গে এক আড্ডায় দেব অকপটে বলেছিলেন, 'এই রিমেকগুলো বেশিদিন চলবে না, তুমি যদি নিজেকে না পাল্টাও, দর্শক তোমাকে পাল্টে অন্য কাউকে বসিয়ে দেবে।'
টলিউডে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার ব্যাপারে দৃঢ় ছিলেন দেব। তাই অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাও শুরু করেন তিনি।
আরেক সাক্ষাৎকারে দেব বলেন, 'আমি যেমন সিনেমা করতে আগ্রহী তেমন সিনেমা পাচ্ছিলাম না। তাই নিজেই প্রযোজনায় আসি।'
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রযোজনা সংস্থা 'দেব এন্টারটেনমেন্ট ভেনচারস্' থেকে একের পর এক ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে কাজ করেন তিনি এবং প্রশংসিতও হন।
সমালোচনার বিষয়ে দেব বলেন, 'যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ করেন তাদের কথা আমি খুব একটা আমলে নেই না। কিন্তু যারা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে সমালোচনা করে, আমি তাদেরকে কাজের মাধ্যমে উত্তর দিতে পছন্দ করি।'
দেব বলেন, 'আমি খুব ভালো অভিনেতা হয়তো নই, যদিও আমি বিশ্বাস করি আমি ভালো অভিনেতা..কিন্তু আপনার আর আমার হয়তো একটা কমন প্লেস আছে, কোনো একটা জায়গায় আমরা হয়তো একমত হবো আর সেটা হচ্ছে পরিশ্রম। আমার পরিশ্রম নিয়ে আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। আমি প্রচন্ড খাটি, পরিশ্রম করি আর ভাবি যে আর নতুন আমি কি করলাম!'
জনপ্রিয় অভিনেতা দেব একইসঙ্গে রাজনীতিতেও সক্রিয়। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মমতা বঙ্গোপাধ্যায়ের তৃণমূল থেকে ভোটে জিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। তবে আগামী বছর তিনি রাজনীতি থেকে সরে এসে পুরোপুরি সিনেমাতেই ফোকাস করবেন এমনটা শোনা যাচ্ছে।
টালিউডে ১৬ বছরের অভিনয় জীবন দেবের। শুরু থেকেই শুভশ্রীর সঙ্গে প্রেম নিয়ে চর্চায় ছিলেন তিনি। এ জুটি এখনো জনপ্রিয়। তাদের দুজনের প্রেমের গল্প বেশ জোরালো হলেও বিচ্ছেদের কারণ এখনো জানা যায় না। ২০১৮ সালে পরিচালক রাজ চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন শুভশ্রী। দেব এখনো বিয়ে করেননি তবে রুক্মিণী মৈত্রের সঙ্গে প্রেমের কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
বর্তমানে অভিনয়ের পাশাপাশি জোর দিচ্ছেন সিনেমায় প্রযুক্তির ব্যবহারে। বিনিয়োগ করছেন নতুন নতুন গল্পে, সুযোগ করে দিচ্ছেন নবাগত অভিনয় শিল্পীদের। দেব নিজেকে নায়ক থেকে একজন প্রকৃত সিনেমা অনুরাগী মানুষ হিসেবে গড়ে চলছেন প্রতিনিয়ত। রিমেক সিনেমার ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি বরং বাংলা সিনেমার ঝুলিতে তিনি রাখতে চেষ্টা করছেন নতুন নতুন সৃষ্টি।
Comments