নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ কী, খেজুর গুড় বা রস ফুটিয়ে খেলেও কি এটি ছড়ায়

নিপাহ ভাইরাস
ছবি: সংগৃহীত

শীতের আগমন মানেই খেজুরের রস খাওয়ার মৌসুম। খেজুরের কাঁচা রস থেকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, এটি এখন কমবেশি সবাই জানেন। কিন্তু আরও কীভাবে এটি ছড়ায় এটি অনেকেরই জানা নেই।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেনের কাছ থেকে জেনে নিন নিপাহ ভাইরাসের বিস্তারিত।

নিপাহ ভাইরাস কী

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নিপাহ ভাইরাস একটা প্যারামিক্সো ভাইরাস ভাইরোলজির সঙ্গা অনুযায়ী। এনভেলপড ভাইরাস অর্থাৎ কোভিডের মতোই এর চারদিকে আবরণ থাকে, যেটা তৈলাক্ত।

১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। শুকরের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল। আর নিপাহ ভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। প্রথম মেহেরপুরে অজ্ঞাতনামা মস্তিষ্কের প্রদাহরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে ফরিদপুরে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।

২০০৫ সালে টাঙ্গাইলে আউটব্রেক হয়। তখন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, খেজুরের কাঁচা রস বাঁদুড়ের মাধ্যমে দূষিত হয় এবং সেই কাঁচা রস যদি মানুষ খায় তাহলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জাল বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখলেও বাদুড়কে নিবৃত্ত করা যায় না। বাদুড় তা সরিয়ে  প্রস্রাব করে আর তা রসে মিশে যায়। গাছের যে অংশটা কাটা হয় সেখান থেকে রস তৈরি হয় বাঁদুড় সেখানে চাটলে রস দূষিত হয়। কোনভাবেই রস নিরাপদ থাকে না।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মানুষ থেকে মানুষে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঘটনাও বাংলাদেশে পাওয়া গেছে।

কীভাবে ছড়ায়

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই বাঁদুড়ের দেহে নিপাহ ভাইরাস থাকে। কিন্তু তারা নিজেরা আক্রান্ত হয় না। এই ভাইরাস কোনোভাবে মানুষের মধ্যে আসলে মানুষ আক্রান্ত হয়।

বাঁদুড়ের লালা ও প্রস্রাব থেকে ভাইরাস আসে খেজুরের কাঁচা রসে, সেখান থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায় নিপাহ ভাইরাস।

খেজুরের কাঁচা রস ছাড়াও কোনো ফল যদি বাঁদুড় খায় সেই আধা খাওয়া ফল মানুষ খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। বাঁদুড় ছাড়াও কোনো পাখি বা প্রাণীর আধা খাওয়া ফলই খাওয়া উচিত নয়।

বনাঞ্চল কেটে উজার করে ফেলা হয়েছে। আবাস ও খাবারের উৎস নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কষ্টে থাকে বাঁদুড়। ফলে বাঁদুড়ের দেহ থেকে নিপাহ ভাইরাস বেশি নিঃসৃত হয়। জাল দিয়ে খেজুর রসের জায়গা ঢেকে দেয়ার কারণে বাঁদুড়কে কষ্ট ও পরিশ্রম করে রস খুঁজতে হয়,এতে বাঁদুড়ের লালা ও প্রস্রাব থেকে ভাইরাস নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্কের প্রদাহ ঘটে। মস্তিস্ক সংক্রমিত হয়।

প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথা ব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মুখ দিয়ে লালা ঝরা, আবোলতাবোল কথা বলা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে কাশির লক্ষণ পাওয়া গেছে। কাশিসহ যে লক্ষণ নিপাহ ভাইরাসে আক্রমণ সেটা বাংলাদেশে নতুন। এর মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে হাঁচি কাশির মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে আশঙ্কার কথা জানান ডা. মুশতাক হোসেন।

খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার পর সর্বোচ্চ ২১ দিন নিপাহ ভাইরাসের সুপ্তিকাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রস খাওয়ার পর ৩ থেকে ৭ দিন বা ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। আবার কখনো রস খাওয়ার ২১ দিন পরেও কেউ কেউ সংক্রমিত হয়েছেন।

নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুঝুঁকি ও চিকিৎসা

বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত শতকরা ৭১ জন অর্থাৎ ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জন মারা গেছেন বলে জানান ডা. মুশতাক হোসেন। মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি, আক্রান্তের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মানুষই মারা যায়।

নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিভাইরাল কোন ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। কোনো ভ্যাকসিনও তৈরি হয়নি। মস্তিষ্কের তীব্র প্রদাহের যে চিকিৎসা নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিতদেরতদের জন্য একই চিকিৎসা। আইসিইউ সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে রোগীকে। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হবে এবং লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

খেজুরের গুড় খেলে বা রস ফুটিয়ে খেলে নিপাহ ভাইরাস থাকে কি?

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ৭০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় নিপাহ ভাইরাস নষ্ট হয়। খেজুরের গুড় তৈরির সময় অনেক বেশি তাপমাত্রায় রস জ্বাল দিতে হয়, তাতে ভাইরাস থাকার কোন আশঙ্কা থাকে না। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি পিঠা পায়েসও নিরাপদ। তবে সঠিক তাপমাত্রায় জ্বাল দিয়ে খেতে হবে।

প্রতিরোধে করণীয়

১. খেজুরের রস কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যাবে না, একবারে নিষেধ।

২. খেজুরের কাঁচা রসের সংস্পর্শে আসলে হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে।

৩. মানুষে থেকে মানুষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি কাশির মাধ্যমে, সেজন্য কোভিডকালীন যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও দূরত্ব বজায় রাখা তা অনুসরণ করতে হবে।

৪. কোনো ফাটা বা আধা খাওয়া ফল খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে এ ব্যাপারে বাচ্চাদের দিকে নজর রাখতে হবে, যাতে কুঁড়িয়ে পাওয়া আধাখাওয়া পাকা ফল যেন না খায়।

৫. যেকোনো ফল, সবজি খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।

৬. খেজুরের গাছ কাটার সময় ঝুঁকি থাকে না, রস নামানোর সময় কিছুটা ঝুঁকি থাকে। যেহেতু রস নাড়াচাড়া করেন গাছিরা. সেজন্য ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, মুখে কাপড় বেঁধে নিতে হবে।

৭. ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাঁচা রস খাওয়ার প্রচলন ছাড়াও শীতকালে বিভিন্ন স্থানে রস উৎসব হয়। অনলাইনে রস বিক্রি হয় ভুল তথ্য দিয়ে যেমন নিরপাদ উপায়ে খেজুর রস সংগ্রহ, জাল দিয়ে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা। এসব বন্ধ করা উচিত।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নিপাহ ভাইরাসে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আইইডিসিআরের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। শীতের সময় খেজুরের রস খেয়ে কেউ মারাত্মক অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য বাতায়ন হটলাইনে যোগাযোগ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

4h ago