বীরদের বিজয়ের হাসি আজও অমলিন

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়

বিজয় তো ঘটেছিল ১৬ ডিসেম্বর একাত্তরে। অতবড় পরাক্রমশালী, সুসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, চতুর্দিকে আনন্দের ধ্বনি, ছুটছে গুলি, বন্ধু জড়িয়ে ধরছে বন্ধুকে। মস্ত বড় সত্য সেটা। কিন্তু ইতিহাসের আরেক ধারাও তো উপস্থিত ছিল। ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছে বহুজন। সেই ঘাতকরা অন্য কেউ নয়, এই বাংলাদেশেরই সন্তান। এবং বিজয় শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে লুণ্ঠন। সঙ্গে সঙ্গেই। এক অন্ধকার মিশে গেছে আরেক অন্ধকারের সঙ্গে।

বিষণ্ণ পায়ে ফিরে এসেছি ঘরে। নানান রকম খবর চতুর্দিকে। পাড়ার ছেলেরা যুদ্ধে গেছিল, তাদের কেউ কেউ ফিরে এসেছে। তারা গল্প বলছে নানাবিধ। বীরত্বের, কৌতুকের, কোনোমতে বেঁচে-যাওয়ার। একটু পরে দেখি মিছিল বের হয়েছে একটা। ঠিকই, সেই রাজাকারেরাই। সত্যি সত্যি। জিন্দাবাদ দিচ্ছে। শেখ মুজিবের ছবি সংগ্রহ করেছে ইতিমধ্যে। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীরও। গলায় তাদের জোরের অভাব নেই।

রাতে আরেক দৃশ্যের বিবরণ পেলাম। দেখেছে দু'জন তরুণ। দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। আগের দিন, পনেরই ডিসেম্বর তখনকার স্টেট ব্যাংকের ভোল্ট থেকে টাকা বের করে বহ্নুৎসব বসিয়েছিল পাকবাহিনী। পুড়ে ছাই করে দিয়েছিল টাকার স্তূপ। কিন্তু সবটা পোড়েনি। কিছু ছিল অর্ধ দগ্ধ, কিছু প্রায় অক্ষত। লুঙ্গিতে ভরে বেশ কিছু টাকার নোটের বস্তা বানিয়েছে এক তরুণ; সেই বস্তা মাথায় চাপিয়ে ছুটছে। উন্মাদের মতো। লুঙ্গিটা তার পরনের। পরনের লুঙ্গি খুলে বস্তা বানিয়েছে। লজ্জা সংকোচের কোনো বালাই নেই। ছুটছে। খেয়াল নেই যে সে দিগম্বর, কেননা মাথায় তার টাকার বোঝা।

ষোল তারিখে চতুর্দিকে গুলির শব্দ। থামছে না। সবটাই আনন্দের, উল্লাসের, বিজয়ের। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, রোগ কেটে যাওয়া মানেই স্বাস্থ্য ফিরে আসা নয়। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সময় লাগবে। নেতৃত্বও প্রয়োজন হবে। সেই নেতৃত্ব পাওয়া যাবে কি, যে নেতৃত্ব পারবে এত সব বিশৃঙ্খলা ও পরস্পরবিরোধী শক্তিকে একত্র করতে, মানুষ ও সম্পদের যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তা পূরণের ব্যবস্থা নিতে। ওই প্রশ্নের জবাব অবশ্য পাওয়া গেছে। গত বায়ান্ন বছর ধরেই।

১৬ ডিসেম্বর আমার অনুভূতিটা ছিল রোগমুক্তির। যেন একটা কঠিন রোগে পেয়েছিল, দুরারোগ্য ব্যাধি। রোগটা সমষ্টিগত আবার ব্যক্তিগতও। আমরা সবাই ভুগছিলাম, এক সাথে এবং আলাদা। বোধটা সামান্য নয়। সাতচল্লিশে আমরা আরও একবার স্বাধীন হই, তখন স্বাধীনতা এসেছিল স্টিমারে করে। সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্ট দুপুর বেলা যে জাহাজটি এসে থামে, গোয়ালন্দ থেকে পদ্মাপাড়ের ভাগ্যকুলে সেটিকে আমাদের মনে হয়েছিল স্বাধীনতার জাহাজ। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের মস্ত একটা পতাকা পতপত করে উড়ছিল, সদম্ভে। সারা জাহাজ সুসজ্জিত ছিল ছোট ছোট অসংখ্য পতাকায়। স্টিমার ঘাটে পন্টুনে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে ওই জাহাজের প্রতীক্ষায়, যার মধ্যে আমিও ছিলাম। একটি কিশোর। আমার হাতেও নিশান। সেই নিশান নাড়িয়েছি আমরা, জিন্দাবাদ দিয়েছি। জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়ানো যাত্রীরাও দিয়েছে, সমান উৎসাহে। স্বাধীনতার জাহাজ পরে আটকা পড়ে গেছে, চরায়। পাকিস্তান একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে আমাদের জন্য, যার লক্ষণ ও পীড়া স্পষ্ট হচ্ছিল, ক্রমাগত। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ। বাঁচার প্রয়োজনে।

একাত্তরে রোগমুক্তি যে আসন্ন সেটা বোঝা যাচ্ছিল। আমরা জিতবো কি জিতবো না—এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নিশ্চয়ই, কখনো কখনো, কারো কারো মনে। অনেকের মতো আমিও নিশ্চিত ছিলাম জিতবোই। প্রশ্ন ছিল কবে, কিভাবে, কতোটা যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সেটা ঘটবে। হয়তো সময় লাগবে, ক্ষতি হবে, কে থাকবে কে থাকবে না কে জানে, কিন্তু রোগটা থাকবে না। যাবেই চলে।

পঁচিশে মার্চের পর থেকে আমার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা ছিল না। নানা জায়গায় থাকতাম। আমি তখন সকলের সঙ্গে সংলগ্ন, সকল পীড়িত মানুষের সঙ্গেই একত্র; কিন্তু আবার বিচ্ছিন্নও, রোগীরা যেমন হয়। আমার বিচ্ছিন্ন ভাসমানতার কারণ ছিল একটি নয়, দু'টি। প্রথম কারণ আমি বাঙালি, দ্বিতীয় কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর হানাদাররা বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত ছিল, ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগের দরুন। পাকিস্তানিরা ধরে নিয়েছে ছাত্রদের বিপথগামিতার পেছনে শিক্ষকদের উস্কানি কাজ করেছে। সেটা আদৌ সত্য ছিল না। ছাত্ররা কারো উস্কানির জন্য অপেক্ষা করেনি। নিজেরাই বের করে নিয়েছে নিজেদের পথ। প্রাণের দায়ে, বাঁচার প্রয়োজনে। হানাদাররা শিক্ষকদের মধ্যে যে-কয়জনকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছিল তাদের মধ্যে আমিও একজন।

চৌদ্দ তারিখে কারফিউয়ের ভেতরে আল-বদর শিক্ষকদের অনেককে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়া জুড়ে আহাজারি। আমাকে দেখা যায়নি, কারণ আমি ছিলাম না সেখানে, আমার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না ওই নয় মাস, না দেখে কারো কারো ধারণা হয়েছে আমিও হয়তো বেঁচে নেই, আমাকেও হয়তো বা ধরে নিয়ে গেছে। যাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না তাঁদের একটি তালিকা শুনিয়েছিল ওই তরুণ। পথের পাশে দাঁড়িয়ে। শুনে বিজয়ের আনন্দ যেটুকু ছিল নিঃশেষ হয়ে গেল। কেবল বেঁচে যে আছি এই স্বার্থপর চিন্তাটা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি তখন সেই মুহূর্তে ছিল কি আমার? মনে পড়ে না।

তবে স্মরণ করতে পারি যে, মনে হয়েছিল একটু আগে যে কয়েকটি লাশ দেখে এসেছি পথে তারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আমার অত্যন্ত আপনজন হয়ে উঠেছে তারা। আরও অনেক মানুষ, যারা হারিয়ে গেছে তারাও চলে এসেছে। যেন মৃত্যুই সত্য, বিজয়ের পরে। অল্প কয়েক পা এগিয়ে আরেকটি দৃশ্য দেখেছিলাম সেদিন। সেটাও বিজয়ের নয়, পরাজয়ের। আলোর নয়, অন্ধকারের। গভর্নর হাউস তখন শত্রুমুক্ত। পাহারাদার বলতে কেউ নেই। সেই ফাঁকে কিছু লোক ঢুকছে আর বের হয়ে আসছে। যারা বের হচ্ছে তাদের মনে হচ্ছে বিজয়ী বীর। এই মাত্র শত্রু হত্যা করেছে। যে যা পেরেছে, পেয়েছে হাতের কাছে নিয়ে বের হয়ে আসছে। কারো হাতে টেবিল ফ্যান, কেউ তুলে নিয়েছে সিঙ্গার মেশিন, কেউ গুছিয়ে নিয়ে চলেছে বিছানার চাদর। মুখে বীরের হাসি। বিজয়ীর। ওই সকল বীরের হাসিতো দেখে যাচ্ছি বায়ান্ন বছর ধরে।

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

2h ago