একাত্তরের উত্তাল সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যেকোনো কিছুই বিশেষ অর্থ বহন করে। কারণ যুদ্ধ মানেই একটি বিশেষ সময়ের সমষ্টি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জন্ম নেওয়া শিশু, উদযাপিত ঈদ যেমন বিশেষ স্মৃতির, তেমনি সে সময়ে প্রকাশিত বই‌ও বিশেষ কিছু।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যেকোনো কিছুই বিশেষ অর্থ বহন করে। কারণ যুদ্ধ মানেই একটি বিশেষ সময়ের সমষ্টি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জন্ম নেওয়া শিশু, উদযাপিত ঈদ যেমন বিশেষ স্মৃতির, তেমনি সে সময়ে প্রকাশিত বই‌ও বিশেষ কিছু। মুক্তিযুদ্ধের সেই অস্থির, ভয়াবহ সময়েও ব‌ই প্রকাশ করা চাট্টিখানি কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে প্রকাশিত বই নিয়েই এই আলোচনা।

বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাসে প্রকাশনা সংস্থা 'মুক্তধারা'র অবস্থান কিংবদন্তীতুল্য। কিন্তু চমৎকৃত হওয়ার মতো তথ্য হলো, এই প্রকাশনা সংস্থাটির জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই; কলকাতায়। কলকাতায় উপস্থিত হয়ে 'মুক্তধারা'র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলাদেশের লেখকদের বলেছিলেন, 'যারা লেখক আছেন, আপনারা লিখুন, চিত্রশিল্পীরা আঁকুন, প্রকাশক হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে সেসব ছাপানো।' তার এই দায়িত্বশীল আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা শুরু করেন লেখকরা। এই প্রকাশনা সংস্থার ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে আহমদ ছফা লেখেন 'জাগ্রত বাংলাদেশ' ; আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেন 'তিনমাসের দিনলিপি' ; সত্যেন সেন লেখেন 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ'।

কলকাতা থেকে এমন আরও অনেকের ব‌ই প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। আর মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত সেসব ব‌ইয়ের মধ্যে আলাদা জায়গা দখল করেছিল দুটি সংকলন— ১. রক্তাক্ত বাংলা; ২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

একাত্তরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় 'রক্তাক্ত বাংলা' নামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন। এর ভূমিকা লেখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আজিজুর রহমান মল্লিক। ওই ভূমিকায় তিনি বলেন, '"রক্তাক্ত বাংলা" সংকলনে দেশের একটা সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখকেরা। মুক্তিযুদ্ধের ও যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের যে-বিবরণ এতে দেওয়া হয়েছে, তা চিত্তস্পর্শী।' আহমদ ছফা, আসাদ চৌধুরীর মতো তরুণ থেকে শুরু করে শ‌ওকত ওসমান ও সৈয়দ আলী আহসানের মতো অগ্রজদের প্রবন্ধ ঠাঁই পেয়েছিল ও সংকলনে। ব‌ইটির শুরুতে ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির লিখিত বিবরণ এবং শেষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে 'মুক্তধারা' থেকেই ১৯৭৪ এবং ১৯৮৯ সালে পুনর্মুদ্রণ করা হয় বইটি।

ওই সংকলনের প্রতিটি লেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। চিত্তরঞ্জন সাহা 'বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা' লেখায় দেখিয়েছেন কীভাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। জহির রায়হান 'পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ' প্রবন্ধে লিখছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই কীভাবে বিভিন্ন ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের জন্ম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। আনিসুজ্জামান লিখেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক নিয়ে। 'বাংলাদেশ স্বীকৃতি চায়' শিরোনামের প্রবন্ধে রামেন্দু মজুমদার প্রমাণের চেষ্টা করেন—মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল। এ লেখায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং জাতিসংঘের নির্বাক অবস্থানকে চিহ্নিত করেন নেতিবাচকভাবে। মতিলাল পাল 'বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত' লেখায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র আঁকেন। অনুপম সেন 'বাংলাদেশ সংগ্রামের সামাজিক পটভূমি'-তে দেখান, কীভাবে যুগের পর যুগ বাঙালি মুসলমান সামাজিকভাবে শাসক থেকে বিচ্ছিন্ন হ‌ওয়ার ফলে জুলুমের শিকার হয়েছে। তিনি এই জুলুমের অবসান কামনা করেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে। আহমদ ছফা 'পাকিস্তানের শিক্ষানীতি' শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, কীভাবে শাসকশ্রেণী 'ইসলামী' পরিভাষা ব্যবহার করে বাস্তব, যুগোপযোগী শিক্ষা থেকে বাঙালি মুসলমানকে দূরে রেখেছে এবং যুগোপযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিকভাবে তারা থেকে গেছে আগের অবস্থানেই। 'বাংলাদেশ আন্দোলন: সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র' প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসান ফুটিয়ে তোলেন বাংলাদেশের আন্দোলন কীভাবে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকভাবে দানা বাঁধছে। এককথায় বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা নিয়ে এমন গবেষণাধর্মী সংকলনের কথা চিন্তাও করা যায় না কিন্তু এমন অচিন্তনীয় কাজ করে দেখিয়েছেন চিত্তরঞ্জন সাহা। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর‌ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন সংকলন বিরল।

একাত্তরের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' নামে আরেকটি প্রবন্ধ সংকলন। এটি 'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি' কর্তৃক সম্পাদিত। সম্পাদনা করেন যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। লেখক হিসেবে ছিলেন আহমদ ছফা, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সুকুমার বিশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা। ভূমিকা লেখেন অন্নদাশঙ্কর রায়। 'প্রকাশকের নিবেদন'-এ চিত্তরঞ্জন সাহা বলেন, 'ওপার বাংলার সঙ্গে এপার বাংলার সমঝোতাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা সাধ্যমত বাংলাদেশের সমস্ত ধরনের প্রগতিশীল লেখা প্রকাশে ব্রতী হয়েছি।'

'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি' থেকে প্রকাশিত এই সংকলনটিও রচনাগুণে সমৃদ্ধ। এতে 'বৈষম্যের রূপ' শিরোনামে প্রথমেই সারণি দিয়ে দেখানো হয় পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র। ড. বঙ্গেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় ও মীরা গঙ্গোপাধ্যায় সম্মিলিতভাবে লেখেন 'বাংলাদেশের গোড়াপত্তনের ইতিহাস'। ড. মুহাম্মদ ইউনূস 'বাংলাদেশ—অর্থনৈতিক পর্যালোচনা' প্রবন্ধে তৎকালীন বাংলার নাজুক অর্থনীতির স্বরূপ তুলে ধরেন। 'ঢাকায় যা দেখেছি যা শুনেছি' নামক স্মৃতিকথায় আহমদ ছফা বর্ণনা করেন, কলকাতায় প্রস্থানের পূর্বে দেখা ঢাকার জনমানুষের উপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের নির্মম চিত্র। ২৩ পৃষ্ঠার ওই স্মৃতিকথা মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার এক তরতাজা সাক্ষী। ব‌ইয়ের সমাপ্তি ঘটে সুকুমার বিশ্বাসের একটি প্রশ্ন দিয়ে—'এখনো রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, শহরে শহরে, হাঁটে মাঠে গঞ্জে গেয়ে বেড়াচ্ছি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, আর ভাবছি, কবে ফিরবো আমার সেই সোনার বাংলায়? কবে?"

এই সমৃদ্ধ সংকলনটি ছাড়াও সেসময় 'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি' আর‌ও ছয়টি ব‌ই প্রকাশ করে। যেমন: ১. ঐতিহাসিক ভাষণ—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ৭ই মার্চের ভাষণ; ২. ছয় দফা দাবী—শেখ মুজিবুর লিখিত; ৩. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ; ৪. Bangladesh The Truth; ৫. Conflict in East Pakistan, Background and Prospects; ৬. Bangladesh, Through The Lens.

জানামতে, একাত্তরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত 'মুক্তধারা' থেকে প্রকাশিত হয় ৩৩টি ব‌ই। তন্মধ্যে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের সংকলন ছাড়াও ছিল একক গ্রন্থ। তবে সবগুলোই ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। চিত্তরঞ্জন সাহা 'মুক্তধারা' প্রতিষ্ঠাই করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এখান থেকে প্রকাশিত ব‌ইয়ের রেফারেন্স পৃষ্ঠায় 'মুক্তধারা'র সঙ্গে ব্রাকেটে লেখা থাকতো 'স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ'। এ থেকেই উক্ত প্রকাশনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

সেসময় কলকাতার পাশাপাশি ঢাকা থেকেও আনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোট আটটি ব‌ই। তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। তার অধীনে বাংলা একাডেমি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত আটটি ব‌ইয়ের তালিকা:

১. দুনিয়া ও মানুষের গল্প: লুৎফুন্নেছা হবিবুল্লাহ, জুলাই, ১৯৭১

২. আলী বাবা: বেগম জেবু আহমদ, আগস্ট, ১৯৭১

৩. অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও অনুন্নত এলাকা: নিজাম‌উদ্দিন আহমেদ অনুদিত, সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

৪. টমাসমানের সেরা গল্প: মুজাফফর আহমদ অনুদিত, অক্টোবর, ১৯৭১

৫. রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম: সিকান্দার আবু জাফর অনুদিত, অক্টোবর, ১৯৭১

৬. হবীবুল্লাহ বাহার রচনাবলী: বাংলা একাডেমী সংকলিত, নভেম্বর, ১৯৭১

৭. জলছবি: নেয়ামত হোসেন, নভেম্বর, ১৯৭১

৮. লোকসাহিত্য (৮ম খণ্ড): বাংলা একাডেমী সংকলিত, আগস্ট, ১৯৭১

ব‌ইগুলোর নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এগুলো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নয়। এবং এটিই কলকাতা এবং ঢাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রকাশিত ব‌ইয়ের বড় পার্থক্য। এটা স্বাভাবিক‌ও বটে, কারণ ঢাকায় তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এত দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ব‌ই প্রকাশ তো দূরের কথা, একটি প্রবন্ধ প্রকাশের‌ও উপায় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'বিপ্লবী' ব‌ইয়ের বিপদ বোঝা যায় সিকানদার আবু জাফরের 'বাংলা ছাড়ো' কাব্যগ্রন্থের ঘটনা থেকে।

কবি সিকানদার আবু জাফরের স্ত্রী নার্গিস জাফর লিখেছেন: 'বাঙলা ছাড়ো' কবিতার ব‌ইটি সিকানদার আবু জাফর নিজেই সংকলন ও সম্পাদনা করেন। সম্ভবত ১৯৭০ সালে ব‌ইটির মুদ্রণকাজ‌ও সমাপ্ত করেছিলেন তিনি নিজে। কিন্তু সেই মুদ্রিত কপিগুলো বাঁধাই করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি, কারণ '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আচরণ এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সঠিক চিত্র তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে বাঙালী তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে 'অভিযোগ' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। এটা যখন কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, তখন কবিকে ধরার জন্য তৎপরতা চালালে তড়িঘড়ি করে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। নানা ব্যস্ততা এবং কিছুটা শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর তিনি ব‌ইটির মুদ্রিত কপিগুলো আর উদ্ধার করতে পারেননি।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

8h ago