মৃত ব্যক্তিকে ‘দৌড়ে পালাতে’ দেখেছে পুলিশ

Bangladesh Police

মৃত আমিন উদ্দিন মোল্লাকে কবর দেওয়া হয়েছিল দুই বছর ১০ মাস আগে।

কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর রাতে গাজীপুরে পুলিশের একটি 'টহল দলকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়' আমিন উদ্দিন মোল্লাসহ আরও ২১ জনকে দেখতে পান কাপাসিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সালাউদ্দিন।

এ ঘটনায় পরদিন সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে পুলিশ হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে আমিন উদ্দিনসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন।

মামলার এজাহারে সালাউদ্দিন উল্লেখ করেন, সেদিনের ঘটনাটি ঘটেছিল রাতে সাড়ে ১১টার দিকে; তারগাঁও মেডিকেল মোড় এলাকায়। অন্ধকার রাতে রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সন্দেহভাজনদের 'স্পষ্ট' দেখতে পেয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি (ইউনিয়ন পরিষদ) সদস্য মোস্তফা কামালের ভাষ্য, 'পুলিশ আমিন উদ্দিনকে দেখেছে, নাকি তার ভূত দেখেছে তা আমার জানা নেই। অথবা এমনও হতে পারে যে, আমিনউদ্দিন সেই রাতে কবর থেকে উঠে এসেছিলেন।'

আমিন উদ্দিনের জামাই মোজাম্মেল হক ও তার প্রতিবেশী খিরাটি গ্রামের সাইফুল্লাহ বলছেন, ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।

আর ইউপি সদস্য মোস্তফার বক্তব্য অনুসারে, আমিন উদ্দিনের মৃত্যুর পর সে সময়ে করা একটি মামলার জন্য পুলিশ এমনকি তার মৃত্যুসনদও সংগ্রহ করে।

স্থানীয় তিনজন বাসিন্দা ও জামায়াতের এক নেতা বলছেন, আমিন উদ্দিন নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যোগ দেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কাপাসিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবু বকর মিয়া বলেন, তারা বিষয়টি দেখবেন।

বিএনপি-জামায়াত নেতারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন, সরকার তাদের নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বিরোধী দলকে দমন করতে পুলিশসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে।

গত এক দশকে মৃত ব্যক্তি, অভিবাসী শ্রমিক, হজযাত্রী এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের ঘটনা বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছে।

এর আগেও নির্বাচন ঘিরে করা এমন সব মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসামি করা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের; যা 'গায়েবি মামলা' নামে পরিচিতি পেয়েছে।

এই মামলাগুলোর বিশেষত্ব হলো, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কথিত অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কোথাও ছিলেন না।

গত ২৮ অক্টোবর পুলিশি অ্যাকশনে পণ্ড হওয়া বিএনপির সমাবেশের পর থেকে এমন গায়েবি মামলা দায়েরের প্রবণতা আবার ফিরে এসেছে।

বিএনপির দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৪৭৫টি মামলায় তাদের ১৮ হাজার ৯০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জামায়াতের হিসাবে, ২৫ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১০৪টি মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা দুই হাজার ৮৪৫ জন।

জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার সম্পাদক মুহাম্মদ আতাউর রহমান সরকার বলেন, গত কয়েক বছর ধরে জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মী এ ধরনের মিথ্যা মামলা ও গুমের শিকার হয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, গায়েবি মামলা দায়েরের এমন ঘটনা রাষ্ট্রের নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এই আইনজীবী বলেন, 'দেশের বিচারব্যবস্থায় মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।'

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্য, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন করতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আইনি ব্যবস্থার অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দায়ের করে যাচ্ছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ছাত্রদল নেতা শেখ মোহাম্মদ শামীম এমনই একজন ভুক্তভোগী, যার বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধের কোনো সম্পর্ক নেই।

গত ২৬ অক্টোবর টঙ্গী থেকে তাকেসহ ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শামীমের পরিবার ও আদালত সূত্র বলছে, পরে শামীমকে কারাগারে পাঠানো হয়।

কিন্তু এ ঘটনার চারদিন পর ৩১ অক্টোবর টঙ্গী থানা পুলিশের দায়ের করা মামলায় শামীমের বিরুদ্ধে ৩০ অক্টোবর টঙ্গীতে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া ও বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ আনা হয়।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে টঙ্গী পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) তাইম উদ্দিন জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলতে চান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার জামায়াত সমর্থক আল আমিন সরকার এমন আরেকজন।

গত ২ নভেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের চার দিন পর স্থানীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক পলাশ বিএনপি-জামায়াতের ৫৭ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে 'চারটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর, মারধর ও দুই লাখ ছিনিয়ে নেওয়ার' অভিযোগে মামলা করেন।

এজাহার অনুসারে, ৩০ অক্টোবর সোমবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে কসবা পৌর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

কিন্তু আল আমিনের ইমিগ্রেশনের কাগজপত্রে দেখা যায়, তিনি ১৯ অক্টোবর সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে ওমরাহ পালন শেষে ৩০ অক্টোবর সকাল ৬টায় তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঢাকা বিমানবন্দর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে এবং প্রায় চার ঘন্টার যাত্রাপথ।

আল আমিনের স্ত্রী উম্মে হাবিবা ফাতেমা জানান, ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তার স্বামী বিমানবন্দর থেকে বের হন। ওই দিন রাতে ও পরের দিন ঢাকায় এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করে ৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফিরে আসেন তারা। ৫ নভেম্বর কসবা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

একই মামলায় আসামি করা হয় এমদাদুল নামে পরিচিত দ্বীন ইসলাম ভূঁইয়াকে, যিনি তখন কারাগারে ছিলেন।

দ্বীন ইসলামের ছেলে তানভীর ভূঁইয়ার ভাষ্য, গত ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তার ৭০ বছর বয়সী বাবাকে। তার পর থেকে তিনি জেলেই আছেন।

এ ব্যাপারে কসবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলছেন, মামলাটি করেছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। তদন্ত করে তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।

গত ১ ও ৩ নভেম্বর মালয়েশিয়া ও বাহরাইনে অবস্থান করলেও রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে মাগুরায় দুই জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে পুলিশ।

এদের মধ্যে একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ী মাগুরার শালিখার আলামিন কাজী, অন্যজন বাহরাইন প্রবাসী রাজীব সিকদার।

তাদের ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে এবং পরিবারের সদস্য এবং অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ঘটনা সংঘটনের তারিখগুলোতে তাদের কেউই দেশে ছিলেন না।

বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, '২০১৩ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যাতে তারা রাস্তায় নামতে না পারে। পুলিশ নির্বিচারে আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। জনগণ যেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তারা এ ধরনের কৌশল নিচ্ছে।'

মানবাধিকার কর্মী নূর খানের মতে, নিরপরাধ মানুষকে নির্যাতিত করার জন্য জবাবদিহিতা না থাকায় পুলিশ এ ধরনের মামলা দায়ের করা অব্যাহত রেখেছে।

নূর খান বলেন, 'সারা দেশে দায়ের করা মামলা থেকে এটা স্পষ্ট যে অভিযুক্তরা বিরোধী দলের সমর্থক। তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, সরকার রাজনৈতিকন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করছে।'

একইসঙ্গে বিষয়টি পুলিশের অদক্ষতারও প্রমান দেয়—এমন মন্তব্য করে এই মানবাধিকার কর্মী আরও বলেন, 'পুলিশের কাছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তালিকা আছে। তাই যখনই তারা কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই মামলা দায়ের করে তখন তারা এই নেতাকর্মীদের নাম ব্যবহার করে।'

পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করার আগে মামলা সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করার জন্য স্থানীয় পুলিশের প্রতি কঠোর নির্দেশনা আছে।

আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ যদি মৃত ব্যক্তি বা কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে, তবে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ভুল ও অন্যায়। আমরা সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে তদন্ত করতে বলব এবং এ ধরনের মামলা দায়েরের জন্য কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার অভিমত, এ ধরনের মামলা বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা কেড়ে নিতে পারে। তিনি বলেন, 'এটা উদ্বেগের বিষয়। আমি মনে করি, এ ধরনের মামলা বিচারব্যবস্থার জন্য সুস্পষ্ট হুমকি।'

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

8h ago