শতবর্ষ

মৃত্যুহীন সুলতান শোষকের এক প্রতিচ্ছবি

এস এম সুলতান মনের আনন্দে ঘুরতেন, মানুষের সঙ্গে মিশতেন, কথা বলবেন। তার ছিল সখ্যপ্রিয়তা। হাটে-ঘাটে, প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে তাঁর ছিল সহজ বিচরণ। তিনি ছিলেন সহজমানুষ। অথচ প্রকাশে মার্গীয়।  
নড়াইলে শিল্পী এস এম সুলতানের বাসভবন । ছবি: লেখক

সম্প্রতি নড়াইলে শিল্পী এস এম সুলতানের সংগ্রহশালা দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়িটা দেখেই প্রশান্তি অনুভব করলাম। বাড়ি ঘেঁষে চিত্রা নদী। কী সম্মোহনী পরিবেশ। পড়ন্ত বিকেল তেজহীন রূপালি রোদ আঁচড়ে পড়েছে এস এম সুলতানের বারান্দায়। প্রথমে চোখ গেলো মহানশিল্পীর উঠোনের দিকে। কবর বরাবর। ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত এক দ্যুতিময় সোপান। অমরত্বের শ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন এস এম সুলতান।

মৃত্যু কেবল বিচ্ছেদের অনুষঙ্গ নয়, সংযুক্তির পেলবও বটে। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম এ মৃত্যু অজেয়। এস এম সুলতানের চেয়ে মৃত্যু বড় নয়। তিনি মৃত্যুবীজ বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন। এস এম সুলতান এক মৃত্যুহীন প্রাণের নাম। যখন বাসভবনের ডেরায় পৌঁছলাম তখন প্রবেশের সময় শেষ হলো। এতো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মহানশিল্পীর পাদপীঠ স্পর্শ করতে পারব না তা তো হয় না। এস এম সুলতানের প্রতিবেশীদের অনুরোধ করলাম। তাদের পরামর্শে শিল্পী নয়নের (শিল্পীর নাতি তবে রক্তসম্পর্কে নয়) সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকার ঘরে প্রবেশের অনুমতি পেলাম।

বাড়ির চৌহদ্দি একেবারে ছোট নয়। বাড়ির সামনে শিশুদের জন্য গড়ে তোলা শিশুস্বর্গ ও চারুপাঠ বিদ্যালয়। বাড়িসংলগ্ন চিত্রা নদী। চিত্রার নিস্তরঙ্গ জলে আজও নারীরা আঁচল ভেজান। নদীর ঘাটে বাঁধা এক বজরা নৌকা। প্রাচীর পরিবেষ্টিত বাড়ি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। যদিও এ আধুনিকতার ব্যাপারে শিল্পীর তির্যক মনোভঙ্গি ছিল। তিনি আধুনিক রেসিপি পূজারি নন, খাঁটি বাঙলা সালুনের সাধক।

এস এম সুলতানের স্থানের প্রতি পক্ষপাত ছিল। অর্থাৎ তিনি যে স্থান পছন্দ করতেন সেখানে থিতু হতেন, কখনও ফিরে আসতেন, আবার যেতেন। তার আচরণে মধ্যে ঘোরাঘুরির নেশা ছিল। অনেকপথ ঘুরে চূড়ান্তভাবে থিতু হয়েছিলেন নড়াইল শহর সংলগ্ন মাছিমদিয়ায়। সকল মহৎ হৃদয়ের ভেতর স্থানের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়। হয়তো স্থানের পরতে পরতে থাকে অনুভবের সূক্ষ্ম বুনন। স্থানকে ঘিরে এ বুনন মাকড়শার জালের মতো হয়ে উঠে। মাকড়শা নিজে জাল বুনে কিন্তু তাতে আটকায় না। কারণ, সে জানে আটকে যাওয়া মানেই মৃত্যু।

এস এম সুলতান আটকে যাওয়ার বান্দা ছিলেন না। তিনি সব সময় প্রকাশে ও গ্রহণে সজীব সত্তা। সময়কে উতরে যাওয়া মানুষ। বোহিমিয়ান বা ভবঘুরে স্বভাবের। তিনি মনের আনন্দে ঘুরতেন, মানুষের সঙ্গে মিশতেন, কথা বলবেন। তার ছিল সখ্যপ্রিয়তা। হাটে-ঘাটে, প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে তাঁর ছিল সহজ বিচরণ। তিনি ছিলেন সহজমানুষ। অথচ প্রকাশে মার্গীয়।
 
শিল্পীর গতিশীলতা উদ্দেশ্যহীন ছিল না। তিনি জনজীবন সেচে মুক্ত সংগ্রহ করতেন। এস এম সুলতান মানুষপাঠী ছিলেন। মানুষ ও স্থান ছিল তার টেক্সট। মানুষ, সম্পর্ক, প্রাণপ্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গ্রামজীবন, কৃষকজীবন, সংগ্রাম, বেঁচেবর্তে থাকার প্রচেষ্টা তাঁর শিল্পহাতে ব্যঙ্গময় হয়ে উঠেছে।

শিল্পের জন্য রসদ লাগে, লাগে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। এস এম সুলতান রসদ সংগ্রহ করেছেন বাঙলার চিরায়ত শেকড় থেকে। এ শেকড় সন্ধানে মনোযোগ তাকে মহৎ করেছে। তিনি শিল্পকলার উচ্চতর বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও নিবিষ্ট  থেকেছেন মাটির প্রতি, মানুষের প্রতি এবং প্রাচীনত্বের প্রতি। তিনি প্রাচীনপন্থী নন। ভীষণ গতিশীল প্রপঞ্চ এস এম সুলতান।

এমন শিল্পীর জিওগ্রাফির কেন্দ্রে রয়েছে চিরায়ত বাংলামানসের বিনির্মাণ। এতে তিনি পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রান্তিক মানুষের বেঁচেবর্তে থাকা, লড়াই-সংগ্রাম অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। তিনি স্থানিক চরিত্র এঁকেছেন। কিন্তু স্থানিক চরিত্রগুলো বলিষ্ঠ, অর্থপূর্ণ এবং সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ মায়েস্ত্রো।

বাংলা পৌরাণিক বিষয় তিনি বাস্তব হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। চিত্রকর্মে তার মিথের ব্যবহার স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। মিথগুলো জীবন্ত-সত্তা হিসেবে চিত্রকর্মে স্বমহিমায় হাজির হয়েছে। এস এম সুলতান সাধক হাসনাত আব্দুল হাই তা স্বীকার করেছেন। এস এম সুলতানের ফিগার যুতসইভাবে বসানো। ফিগারগুলোর মধ্যে তিনি বাঙালির বেঁচে থাকার জীবনীশক্তির লড়াকু মনোভঙ্গি এঁকেছেন। যা আত্মসমর্পণমূলক নয়। ইতিহাসবোধ এস এম সুলতানের মূল জ্বালানি।

এস এম সুলতান সংগ্রহশালার সামনে লেখক

প্রতিবাদী, প্রতিরোধের সংঘবদ্ধ জোট তার চিত্রকর্ম। এস এম সুলতানের শিল্পকর্ম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের স্পর্ধিত স্মারক। আহমদ ছফা তাঁর প্রবন্ধ বাংলার চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা-তে উল্লেখ করেছেন- ''কোনোরকম ভণিতা না করেই বাংলাদেশের চিত্র-দর্শকদের উদ্দেশ্যে অমোঘ নির্দেশবাণী উচ্চারণ করেছে আমাদের দেখো। বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে এবং মজেছে। রঙের পরশ দৃষ্টিপট ভেদ করে মনের পটে অক্ষয় হয়ে স্থির ইন্দ্রধনুর মতো ফুটে গেছে। গ্রাম বাংলার এই চলমান ইতিহাস প্রবাহের সঙ্গে দর্শকের তন্ময় সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। তারা নিজেদের অস্তিত্বকেও এসকল কান্তিমান, আয়ুষ্মান চিত্রের অংশ হিসেবে মনে করতে বাধ্য হয়েছে।'' আহমদ ছফার আরেকটি কথা ধার করে বলতে হয় তিনি তার চিত্রকর্মে আবহমান বাংলাকে নাচিয়ে তুলেছেন।

এস এম সুলতান এক শোষকের প্রতিচ্ছবি। এ শোষক অন্যের ধনসম্পদ লুটের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল নয়। মাটির নির্যাস-শুষে নেয়ার অবাধ্য সাধক। তাঁর শিল্পকর্মে কাঁচা ঘামের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। দেখা যায় কাজের প্রতি ব্র্যাতজনদের নিবিষ্টতা। কাজ ও পেশি শক্তি মধ্যে দাবড়ানি-দাবড়ানি খেলা। চর দখল, সংঘাত আর সংঘর্ষ ও জীবনের তাগিদ ফুঁটে উঠে আঁকাআঁকিজুড়ে। 

এস এম সুলতানের শিল্পকর্মের স্বাদ আশ্বাসদন এক অনিঃশেষ ব্যাপার। এ শিল্পের কোনো মার্জিন নেয়। কেবল রয়েছে এক লম্বা দিগন্তরেখা। এ দিগন্তরেখায় দাঁড়ালো যুথবদ্ধচরিত্র দেখা যায়। এস এম সুলতানের শিল্পকর্ম আবহমান বাঙলার সৌন্দর্য্যের পাহাড়পুর বা ময়নামতি। রঙতুলির উত্থান -পতনের এক বিশেষ হুংকার। 

কৃষি ও কৃষকের প্রতি তার পক্ষপাতের পেছনে হয়ত কাজ করেছে পূর্বপুরুষের পেশাপরিচিতি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেমনটি বলেছেন-মানুষের ইমেজিনেশন তৈরি হয় তার রেসের ভেতর দিয়ে। জাপানী লেখক মুরাকামির ভাষায়-আমরা তা বহন করি বংশ পরম্পরায়। এস এম সুলতান ইমেজিনেশনকে রিয়েল করে উত্তরপ্রজন্মের কাছে হাজির করেছেন। 

এস এম সুলতান বৈচিত্র্যবোধের আধার। তার কোনো সংস্কার ছিল না। তিনি উন্মুক্ত ও সাহসী। জেন্ডার বিষয়ে দারুণ নিউট্রাল। আঁকাআঁকিতে নারী-পুরুষের মিশেল ঘটিয়েছেন বিশেষ পারঙ্গমতায়। তার নির্মিত পুরুষ যেমন সুঠাম, শক্তিমান, তেজস্বী, নারীরাও ঠিক তেমনি। তিনি শাড়ি পরতেন, পায়ে আলতা দিতেন, নাচতেন। প্রচলিত জেন্ডার রোলের বাইরে তার অনেক তৎপরতা ছিল। খাদ্যাভাবে ছিলেন খুব সাদামাটা ছোট মাছ ও শাক খেতে পছন্দ করতেন। তিনি প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক চর্চা করতেন। শিশুদের ভালোবাসতেন। তাদের জন্য চারু শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এস এম সুলতান বেঙ্গল এক্সপ্রেশনে এক প্রাঞ্জল পুরুষ। শতবর্ষে স্মরণ, সুলতানের কীর্তিতে শ্রদ্ধা অবিরাম। 

Comments

The Daily Star  | English

Tk 127 crore owed to customers: DNCRP forms body to facilitate refunds

The Directorate of National Consumers' Right Protection (DNCRP) has formed a committee to facilitate the return of Tk 127 crore owed to the customers that remains stuck in the payment gateways of certain e-commerce companies..AHM Shafiquzzaman, director general of the DNCRP, shared this in

16m ago