১০০ বছর আগে ঢাকার হরতাল

সময় যত বাড়ছে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের সুযোগ তত সঙ্কুচিত হচ্ছে। ইতিহাস এমন এক বিষয়, যাকে নিয়ে আফসোস করা যায় কিন্তু ফিরে যাওয়া যায় না
প্রতীকি ছবি

শাসকের সঙ্গে দ্বিমত বা সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জনগণের পক্ষ থেকে হরতাল পালন পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ধারা। আমরা যদি শুধু ঢাকায় হরতালের ইতিহাস খুঁজি তাহলে অন্তত ১০০ বছরের একটি চিত্র পাওয়া যায়।

অর্থাৎ, অন্তত গত ১০০ বছর আগেও ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল পালিত হয়েছে। কেন ঢাকায় সে হরতাল পালন?  প্রেক্ষাপট ও পদ্ধতিটা কেমন ছিল, তাই জানাবো লেখায়। 

প্রেক্ষাপট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের উসমানী খেলাফত যোগ দিলো জার্মানির পক্ষে, ব্রিটেন তথা  ইংরেজের বিরুদ্ধে। ইংরেজ সরকার ভারতের জনগণকে আহ্বান জানালো তাদের পক্ষে সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিতে। ভারতীয় মুসলমানরা পড়লো দ্বন্ধে। একদিকে শাসকের আদেশ, অপরদিকে খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ— জলে কুমির ডাঙায় বাঘের দশা। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করলো, যুদ্ধে বিজয়ী হলে তুরস্কের খেলাফত ও খলিফার স্বার্থ রক্ষা হবে। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে অনেক মুসলমান যুবক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বলে রাখা ভালো, ইংরেজের পক্ষে কাজী নজরুল ইসলামের যুদ্ধে যোগদানের প্রেক্ষাপট‌ও এটাই। যাই হোক, ১৯১৮ সালে পরাজিত হয় তুরস্ক। কিন্তু ইংরেজ যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো খেলাফত ও খলিফার স্বার্থ রক্ষা করবে তেমনটা হলো না, বরং উল্টো খেলাফত যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় তার পরিকল্পনা করা হলো। ইংরেজের এমন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে ফুঁসে উঠলো ভারতীয় মুসলমানরা।

ফলে ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে ১৯১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর লখনৌতে "অল-ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স" অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কনফারেন্সে ১৭ অক্টোবর, ১৯১৯ তারিখে পুরো উপমহাদেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়।

ঢাকায় হরতাল পালনের চিত্র

"অল-ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স" থেকে ঘোষিত ১৭ অক্টোবরের হরতাল পালিত হয়েছিল ঢাকায়। ঢাকার মুসলিম সমাজের সংগঠন 'ইসলামিয়া আঞ্জুমান'র সেক্রেটারি খাজা আবদুল করীম স্বাক্ষরিত বিবরণ থেকে জানা যায়, সেদিন ঢাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল— মুসলমানদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু দোকানদারও দোকান খোলেননি। মুসলমানরা সেদিন রোজা রেখেছিলেন এবং দেখাদেখি কিছু হিন্দু অনশন-ব্রত পালন করেন। হরতালের দিন বিকাল চারটায় পুরানো পল্টন ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন ন‌ওয়াবজাদা খাজা আবদুল করীম; হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপালিটির ভাইস চেয়ারম্যান ধীরেন্দ্র চন্দ্র রায়, ডাক্তার রাজকুমার চক্রবর্তী। ধারণা করা হয় উক্ত সভায় ২০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে এবং অনেক মুসলিম মহিলা বোরকা পরে সভায় হাজির হয়েছিলেন।

১৯২০ সালের ২৮-২৯ ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক খেলাফতের উদ্যোগে "খেলাফত সম্মেলন" অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে ২৯ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে শেরে বাংলা একেএম ফজলুল হক প্রস্তাব করেন: "আগামী ১৯ মার্চ শুক্রবার দিনটিতে মুসলমানদের সকল কাজ বন্ধ রাখতে হবে।" সেই অধিবেশনে সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ঘোষণা করেন, ১৯ মার্চ সমগ্র দেশব্যাপী হরতালসহ খিলাফত দিবস পালিত হবে। সেই প্রথম সমগ্র বাংলাদেশে "হরতাল"র ঘোষণা হয়। এর আগে আর কখনো সমগ্র দেশব্যাপী হরতালের ঘোষণা হয়নি।

১৯২০ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার হরতালের চিত্র তুলে ধরেন ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল্লাহ: "১৯ মার্চ (১৯২০) শুক্রবার সারাদেশে হরতালসহ ২য় খিলাফত দিবস পালিত হয়। ঐদিন ঢাকা শহরের ছোট-বড় সব দোকান ও হাট-বাজার বন্ধ ছিল। ভোর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের কোন রাজপথে ভাড়াটিয়া মটর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ি দেখা যায়নি। শহরবাসী যেসব বড়লোকের নিজস্ব মটরগাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি ছিল, তাঁদের মধ্যেও মাত্র ২/১ জন ছাড়া কাউকে সেদিন কোনরূপ যানারোহণে শহরে বের হতে দেখা যায় নি। ভাড়াটিয়া গাড়িগুলো বন্ধ থাকার দরুন ঐদিন স্থানীয় ইডেন হাই স্কুলটি বন্ধ রাখতে হয়েছিল। রাজমিস্ত্রি ও কুলি-মজুর প্রভৃতি শ্রমিকগণও ঐ দিন কাজ বন্ধ রেখেছিল। এক কথায়, ঢাকা নগরে হরতাল পূর্ণ-সাফল্য লাভ করে। কিন্তু ঐ হরতালের কারণে কোথাও কোনরূপ গোলযোগ ঘটেনি। আনন্দিত মনে হরতাল পালন করেন।

বলা হয়, ঐদিন ঢাকা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কেউ না-কি নতুন দলিল রেজিস্ট্রি করাতে আসে নি। ঐদিন শুধু পূর্বে দাখিলকৃত দু'খানি পুরনো দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। আরও বলা হয়, পাটুয়াটুলির তিনটি পুস্তক-দোকানের মালিক ঐ হরতালে যোগ দেন নি। আরও প্রকাশ, ঐ তিনটি দোকানের মধ্যে একটি দোকানের মালিক ছিলেন স্থানীয় মিউনিসিপালিটির কমিশনার। অপর দু'টি দোকানের মালিকদের মধ্যে একজন বি.এ. ডিগ্রী উপাধিধারী ঐ বছর গাঁজার দোকানের পাট্টা নিয়েছিলেন। পাছে ঐ হরতালে যোগ দিলে তাঁর বইয়ের দোকান ও গাঁজার পাট্টা কেড়ে নেয়া হবে—ঐ ভয়েই না-কি তিনি দোকান খোলা রেখেছিলেন। তৃতীয় দোকানটি কেন যে খোলা ছিল, তার কারণ ছিল অজ্ঞাত। প্রকাশ, ঐ তিনটি দোকান ঐদিন খোলা থাকা সত্ত্বেও কোনরূপ বেচাকেনা হয় নি।" (আবদুল্লাহ:১৯৯৬, ৪০) উল্লেখ্য যে, তিনি এই বিবরণ দিয়েছেন সাপ্তাহিক 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকার ৮ চৈত্র ১৩২৬ (২১ মার্চ ১৯২০) সংখ্যার বরাতে।

১৯২০ সালের ১-২ জুন এলাহাবাদে হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধীকে যুক্ত করে একটি কমিটি গঠন হয় এবং সেই কমিটির তরফ থেকে ১ আগস্ট, ১৯২০ তারিখে সারা ভারতে হরতাল পালনের নির্দেশ প্রদান করা হয়। পূর্বের ন্যায় এবারও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মোতাবেক ঢাকায় তৃতীয়বারের মতো হরতাল পালিত হয়। সাপ্তাহিক 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকার ২৩ শ্রাবণ ১৩২৭ (৮ আগস্ট ১৯২০) সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বলা হয়, "ঐদিন ঢাকা নগরের বিভিন্ন স্থানে অনেক দোকান-পাট বন্ধ ছিল।

স্থানীয় খিলাফত কমিটির আহ্বানে সেদিন অপরাহ্ন সাড়ে ৫টার সময় করনেশন পার্কে প্রায় ৬ হাজার হিন্দু-মুসলমান শহরবাসী এক বড় সভায় মিলিত হন। সভাপতি ছিলেন খাজা আব্দুল করীম। ঐ সভায় নিম্ন প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়: সেন্ট্রাল খিলাফত কমিটির আন্দোলনের সাথে এই নগরবাসীদের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। যতদিন পর্যন্ত তুরস্ক-সন্ধি শর্তের আবশ্যকীয় পরিবর্তন না করা হয়, ততদিন যতদূর সম্ভব স্বদেশজাত দ্রব্য গ্রহণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ‌ওয়া এবং সরকার প্রদত্ত উপাধি বর্জন ও অবৈতনিক সরকারি কার্য হতে ইস্তফা দেয়ার জন্য এই সভা দেশবাসীকে অনুরোধ করছে।"

উল্লেখ্য যে, হরতালের দিন নবাব পরিবারের সদস্য খাজা আবদুল করীম দাবী অনাদায়ের কারণ দেখিয়ে অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটের পদ থেকে পরিত্যাগ করেন। শুধু নবাব পরিবারের আব্দুল করীম‌-ই নয়, মহাত্মা গান্ধীও সেদিন ইংরেজ সরকারের তরফ থেকে দেওয়া পদক ও উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে, মুসলমানদের খেলাফতের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অবজ্ঞার কারণে সরকার প্রদত্ত 'কাইসার-ই-হিন্দ' স্বর্ণপদক ফেরত দিতে চান।

বলা যায়, শতবর্ষ পূর্বে ঢাকায় খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে তিনদিন হরতাল ঘোষিত হয়েছিল সব‌ই শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক অপূর্ব সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছিলো হরতালকে কেন্দ্র করে। এবং যথারীতি জনসভাও হয়েছিল ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান এবং করোনেশন পার্কে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আয়োজিত ঢাকার সেই জনসভায় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করলেও কাউকে গ্রেফতারের সংবাদ পাওয়া যায়নি। বলা যায়, সময় যত বাড়ছে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের সুযোগ তত সঙ্কুচিত হচ্ছে। ইতিহাস এমন এক বিষয়, যাকে নিয়ে আফসোস করা যায় কিন্তু ফিরে যাওয়া যায় না।

সহায়ক গ্রন্থ:
১. বাঙলায় খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন : ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬
২. তুরস্কের খিলাফতের বিপর্যয়ে ভারত তথা বাংলার মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া : মোঃ রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ২০১০ 
 

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

16h ago