ইসরায়েলি লেখকদের চোখে ফিলিস্তিন
ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের সংঘাত চলছে বহুদিন। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান- এই তিন প্রধান ধর্মের পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত এই অঞ্চলকে ঘিরে কয়েক দশক সংঘাত ও সংঘর্ষ চলছে। সবশেষ চলতি বছরের ৭ অক্টোবরে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়, যাকে যুদ্ধ বললেও কম বলা হবে না। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলমান সংঘাতে ইসরায়েলের এক হাজার ৪০০ ও ফিলিস্তিনের ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অসংখ্য নারী ও শিশু।
বহুদিন ধরে চলা এই রক্তপাত নিরসনে বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশানুরূপ কোন অবদান রাখতে পারেনি। তাই বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন কবি সাহিত্যিকরাও। এতে অবশ্য মূল্য চুকাতে হয়েছে অনেক সৃজনশীল মানুষকে। ফিলিস্তিনের লেখক গাসসান কানাফানির উচ্চারিত একটি পুরনো সাক্ষাৎকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে। যেখানে তিনি ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সংলাপের বিষয় বলছেন, 'তরবারি ও গর্দানের মধ্যে কখনো সংলাপ হয় না'। অভিযোগ আছে, পরবর্তীতে গাসসান কানাফানি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন।
তবে ফিলিস্তিনের সংকট ইসরায়েলি লেখকেরা কীভাবে দেখছেন? বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক ইসরায়েলি বংশোদ্ভুত লেখকদের যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। তাদের মধ্যে অনেকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সংকটকে দেখার চেষ্টা করেছেন। এই 'ন্যারেটিভ' ভিন্নতা ইসরায়েলি লেখকদের প্রত্যক্ষভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে নিয়ে না গেলেও, অন্তত সাধারণ ইসরায়েলি দৃষ্টিকোণের বাইরে থেকে এই সংঘাতকে আলাদা করে দেখার সুযোগ হয়েছে।
ইয়াহুদা অ্যামিচাই
গত শতকের একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসরাইলি কবি। ইয়াহুদা অ্যামিচাইয়ের কবিতা কখনো কখনো ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর এবং অভিজ্ঞতাকে ছুঁয়ে গেছে। আবার মাঝে মাঝে তিনি রাজনৈতিক এবং জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের ভাগ হয়ে যাওয়া বেদনা ও স্বপ্নের উপর জোর দিয়েছেন।
যদিও ইয়াহুদা অ্যামিচাই জন্ম নিয়েছিলেন জার্মানিতে ১৯২৪ সালে। তবে মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইসরায়লের বাসিন্দা ছিলেন। তার লেখায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের যুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের পরিবর্তে মানবতার কথাই বেশি উঠে আসতো। সংঘাতের প্রতি অ্যামিচাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির একটি স্বতন্ত্র দিক ছিল যুদ্ধের মানবিক ক্ষতি।
২০১৬ সালে দ্য টাইমস অফ ইসরাইল পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক মিচ গিংসবার্গের একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়, অ্যামিচাইয়ের প্রায় লেখায় বাইবেলের অনুচ্ছেদের উল্লেখ পাওয়া যেত। বাইবেলের এসব ঐতিহাসিক অনুচ্ছেদ বর্তমান সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে সেখানে থাকা ইহুদি-মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির একসঙ্গে বাসকরা মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ঐতিহাসিক সংযোগ ঘটাতে কাজ করেছে।
যুদ্ধের কারণে ব্যক্তি ও পরিবার যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়, তার প্রতি অ্যামিচাইয়ের অটল মনোযোগ ছিল। ইসরাইল ও ফিলিস্তিন উভয় অঞ্চলের দুর্ভোগের প্রতি সহানুভূতি জানানোর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। ইয়াহুদা অ্যামিচাইয়ের কবিতা আমাদেরকে মানবতার বিভক্তির দিকে গভীর সংযোগ এনে দিত এবং সাথে সাথে শান্তির জন্য আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার কথা বলতো।
ডেভিড গ্রসম্যান
২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ম্যানবুকার পুরস্কার জেতা সাহিত্যিক ডেভিড গ্রসম্যানের জন্ম জেরুজালেম শহরে। তিনি ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সংঘাত নিয়ে কথা বলার জন্য পৃথিবীজুড়েই বেশ পরিচিত লেখক। ২০০৮ সালে প্রকাশিত তার লেখা 'টু দ্য এন্ড অফ দ্য ল্যান্ড' উপন্যাসটিতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ঘিরে তৈরি হওয়া একটি পারিবারিক সংকটের গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
লেখালেখির বাইরে তিনি বাম ঘরানার রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য পরিচিত। গত কয়েক দশক ধরে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ের বাইরেও ইসরাইলের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যুদ্ধের বিপক্ষে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে আসছেন তিনি। ২০০৬ সালে ইসরাইলের সঙ্গে লেবাবনের যুদ্ধ চলাকালে ডেভিড গ্রসম্যান তার অন্য দু'জন লেখক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানে ডেভিড গ্রসম্যানের নেতৃত্বে ইসরাইল সরকারকে যুদ্ধের জন্য নিন্দা করা হয় এবং জোরালোভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি তোলা হয়।
কিন্তু তার মাত্র দুই দিন পর ডেভিড গ্রসম্যানের ২০ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যা করা হয়। ডেভিড গ্রসম্যান ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইল সরকারের নীতির বিরোধীতা করেছিলেন। ২০১০ সালের আগস্টে দ্য গার্ডিয়ানের কাছে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, নিজের ছেলের মৃত্যুর ঘটনাও ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের নীতির বিপক্ষে তার অবস্থান থেকে তাকে সরাতে পারবে না।
ফিলিস্তিনের জায়গা দখল করে ইসরাইলের বসতি বিস্তার ঠেকানোর দাবিতে ২০১০ সালে ডেভিড গ্রসম্যান ও তার স্ত্রী বিক্ষোভে অংশ নেন। সেসময় ইসরাইল পুলিশ তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।
অ্যামস ওজ
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত নিয়ে তার জটিল চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি বেশ প্রাসঙ্গিক। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করে চলমান সংকটের সমাধান করার পক্ষে একদম শুরু থেকেই ছিলেন তিনি। অ্যামস ওজ বিশ্বাস করতেন যে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই একমাত্র কার্যকর সমাধান হতে পারে।
১৯৩৭ সালে অ্যামস ওজ জেরুজালেম শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। লেখক, উপন্যাসিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত পাওয়া অ্যামস ওজ বিরশেবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিব্রু সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা ছিলেন। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন। সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৩ সালে ফ্রানৎস কাফকা পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
গাজায় ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের ব্যাপারে ইসরাইল সরকারের নীতির সমালোচনায় তিনি কখনো পিছুপা হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই ধরনের নীতি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের শান্তির সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং সাধারণ মানুষের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে।
এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, অ্যামস ওজের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল শান্তি, সহাবস্থান, এবং একটি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের মূল্যবোধের প্রতি তার অঙ্গীকার। তিনি একচোখা চশমায় দৃষ্টি না রেখে উভয় পক্ষের দুর্ভোগ দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে চলতে থাকা বিরোধের সমাধান এবং এই অঞ্চলের সকলের জন্য একটি ভাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য সংলাপ, সহানুভূতি এবং সমঝোতা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে তার লেখাগুলো সংঘাতের আরও সূক্ষ্ম এবং সহানুভূতিশীল আলোচনায় অবদান রেখেছে বলেই মনে হয়।
আব্রাহাম গাব্রিয়েল ইয়েহোশুয়া
এ.বি. ইয়েহোশুয়া একজন বিখ্যাত ইসরাইলি লেখক। যিনি তার লেখায় বিশেষভাবে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলি সংঘাতকে ধরার চেষ্টা করেছেন। যদিও তিনি সারাজীবন নিজেকে ইসরাইলি লেখক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু তার লেখায় গভীরভাবে ফিলিস্তিনের সংকট দেখতে পাওয়া যায়।
এ.বি. ইয়েহোশুয়ার জন্ম ১৯৩৬ সালে। তিনি একাধারে লেখক, উপন্যাসিক ও নাট্যকার। পশ্চিমা লেখক উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গে তুলনা করে তাকে 'ইসরায়েলি ফকনার' বলে এক লেখায় উল্লেখ করেছিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। সাহিত্যের জন্য ইসরাইলের জাতীয় পর্যায়ের 'ইসরাইল প্রাইজ ফর লিট্রেচার' পুরস্কারটি ২০১৭ সালে অর্জন করেন।
ইয়েহোশুয়ার লেখায় ইসরাইল সরকারের দখলদারিত্বের পরিণতি, ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জনের চ্যালেঞ্জ সহ ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের বিভিন্ন দিকের সমালোচনা উপস্থিত ছিল। ২০০৮ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ করা হয়, অন্যান্য সাধারণ ইসরাইলি লেখকদের মত পক্ষপাতিত্বের জায়গায় না গিয়ে তার রচনাগুলোতে প্রায় উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া এবং সহানুভূতির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু সেই ব্যাপারগুলো উঠে আসতো।
আব্রাহাম গ্যাব্রিয়েল ইয়েহোশুয়ার লেখার সবচেয়ে বড় স্বতন্ত্র দিক- একই শহরে দুই জাতির মিশ্রিত বসবাসকে তুলে ধরা। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে এখানে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রায় সংঘাতের প্রভাব, আনন্দ-বেদনা কিংবা সংকটগুলো কেমন- তা ইয়েহোশুয়ার একাধিক লেখায় উঠে এসেছে। এই সম্প্রদায়গুলোর জীবনের গতিশীলতা ও উত্তেজনা পাঠকের সামনে তুলে ধরে এক অমীমাংসিত প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন। যা সাধারণ পাঠকদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের সংঘাত ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দ্বন্দ্বকে ঘিরে বিশ্বের বড় দুইটি শক্তির মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো নারী ও শিশুসহ বেসমারিক মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে বারবার দাবি তুললেও খুব পরিবর্তন হয়নি। বরং সংঘাত বেড়েই চলছে। এই সংঘাত বিশ্বসাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ইসরাইলি অনেক লেখকের কলমেও ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মীতা উঠে এসেছে। তারাও সংকট মোকাবেলায় উপন্যাসের আশ্রয়ে ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি সৌহার্দ্য দেখিয়েছেন। ফিলিস্তিনি লেখকদের পাশাপাশি ইসরায়েলি লেখক-সাংবাদিকেরা স্বয়ং ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন এখনো।
তথ্যসহায়ক:
১. মিচ গিংসবার্গ, টাইমস অফ ইসরাইল, ২০১৬
২.র্যাচেল কুক, দ্য গার্ডিয়ান, ২০১০
৩.বার্নার্ড আভিসাই, দ্য নিউ ইয়র্কার, ২০১৯
৪.ইথান ব্রোনার, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২০০৮
Comments