স্ট্রোক ব্রেনের রোগ, হার্টের রোগ নয়: প্রতিরোধ জরুরি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী স্ট্রোক প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব স্ট্রোক সংস্থা প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর এ দিবসটি পালন করে। প্রতি বৎসর এ দিবসে একটি প্রতিপাদ্য থাকে, যেমন "প্রতি ৪ জনে ১ জন স্ট্রোক আক্রান্ত হবেন, সেই ১ জন যেন হতে না হয়", "জানুন স্ট্রোকের লক্ষণ, মিনিটেই বাঁচিয়ে দিন বহু জীবন", "মূল্যবান সময় বাঁচানোর গুরুত্ব"। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য- "মিনিটস ক্যান সেভ লাইভস", অর্থাৎ মিনিট বাঁচায় জীবন বা স্ট্রোকের লক্ষণ, মিনিটেই বাঁচিয়ে দেয় বহু জীবন।

২০০৬ সালে প্রথম ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন দিবসটি পালন করে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন স্ট্রোকে। এতে মৃত্যুহারও সর্বোচ্চ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে দ্বিতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে মৃত্যুর দিক থেকে হৃদরোগের পরেই স্ট্রোকের অবস্থান এবং শারীরিক অক্ষমতার জন্য স্ট্রোক সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। এ রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে বাংলাদেশেও দ্রুত স্ট্রোক বাড়ছে।

অনেকের প্রচলিত একটি ধারণা স্ট্রোক হৃৎপিণ্ডের রোগ। স্ট্রোককে অনেকে হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। বাস্তবে তা সত্য নয়, স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালীর জটিলতাজনিত রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালী বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়। শরীরের যে অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, স্ট্রোক হলে সেসব অংশের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে। মস্তিস্কের এক দিক আক্রান্ত হলে শরীরের উল্টো দিক বিকল হয়ে পড়ে। স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যান, যারা বেঁচে থাকেন তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন বা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। তারা বেঁচে থেকেও দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন।

স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। প্রতি হাজারে গড়ে তিন থেকে পাঁচ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন।

সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেলেও যে কোনো বয়সেই তা হতে পারে। বয়সী রোগীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকলেও ইদানিং তরুণ এমনকি শিশুরাও স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। ৬০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্র্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি, নারীদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কম। ফাস্টফুডে আসক্তদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও তরুণদের অনেকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্ট্রোক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

স্ট্র্রোক কেন হয়?

১. অনেক কারণেই স্ট্রোক হয়। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ।

২. ধূমপান, তামাক পাতা, জর্দা, মাদক সেবন।

৩. ডায়াবেটিস, রক্তে বেশিমাত্রায় চর্বি, অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ।

৪. অলস জীবনযাপন, স্থুলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ।

৫. কিছু কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যেমন অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

৬. ঘুমের সময় নাক ডাকা, ঘুমের সময় শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ, শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগ।

৭. যে কোনো ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন ও জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালী থাকা।

৮. অনেক সময় বংশানুক্রমে রক্তের রোগ বা আগের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালী বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ

১. শরীরের কোথাও বা একাংশ অবশ ভাব লাগা কিংবা দুর্বলবোধ করা। হঠাৎ শরীরের যে কোনো এক পাশ বা অর্ধাংশ যেমন মুখ, হাত ও পা অবশ হয়ে যাওয়া।

২. কথা বলার সমস্যা, হঠাৎ কথা বলতে এবং বুঝতে সমস্যা হওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট হওয়া ও একেবারে কথা বলতে বা বুঝতে না পারা। মুখ বেঁকে যাওয়া, হাসার সময় মুখ অন্য পাশে চলে যাওয়া। অনেক সময় মুখের মাংস পেশি অবশ হয়ে যায়, লালা ঝরা।

৩. এক চোখ বা দুই চোখেই ক্ষণস্থায়ী ঝাপসা দেখা বা একেবারেই না দেখা।

৪. হঠাৎ অতিরিক্ত মাথা ব্যাথা, মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঘোলা লাগা, হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্‌বল হয়ে পড়া, বমি বমি বোধ অথবা বমি করা।

৫. পায়ে দুর্বল বোধ করা, হঠাৎ ব্যালেন্স বা সোজা হয়ে বসা ও দাঁড়াতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘোরানো এবং হাঁটতে সমস্যা হওয়া।

৬. স্ট্রোকের মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে অজ্ঞান হওয়া, খিঁচুনি, তীব্র মাথাব্যথা ও বমি।

স্ট্রোক হলে কী চিকিৎসা

স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর থেকে প্রথম তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় খুবই ক্রিটিকাল। এই সময়ের মধ্যে বা তার আগে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে মৃত্যু-ঝুঁকি অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব। তবে এই সময়কাল একেকজন রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। অনেকের তিন ঘণ্টায় যে ক্ষতি হয়, সেটা হয়তো আরেকজনের ক্ষেত্রে আরও পরে গিয়ে হতে পারে।

১. স্ট্রোক হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল। রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। যদি খেতে না পারেন তবে নাকে নল দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রস্রাব ও পায়খানা যাতে নিয়মিত হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার দিতে হবে। চোখ, মুখ ও ত্বকের যত্ন নিতে হবে। বেডসোর প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত পাশ ফেরাতে হবে।

২.  উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

৩. পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়।

৪. অন্যান্য চিকিৎসা স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী করা হয়। যেমন-ইশকেমিক স্ট্রোকের বেলায় অ্যাসপিরিন, ক্লোপিডগ্রিল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণের কারণে স্ট্রোক হলে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।

৬. সব হাসপাতালেই থাকা উচিত একটি স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা দেবেন।

৬. একজন স্ট্রোক রোগীর প্রয়োজন হয় নিউরোলজিস্ট এবং নিউরোসার্জনের। অনেক স্ট্রোক রোগীর অপারেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

৭. অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, বেডসোর সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে।

৮. রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তুলতে রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন হয়।

৯. রোগী কথা বলতে না পারলে প্রয়োজন স্পিচ থেরাপিস্টের।

১০. স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, সমন্বিত স্ট্রোক কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবেন চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য।

যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব

"স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য রোগ"। স্ট্রোক ব্রেন বা মস্তিষ্কের কঠিন রোগ। ব্রেনের কোষগুলো একবার নষ্ট হলে পুনরায় পুরোপুরিভাবে কার্যকরী হয় না অথবা জন্মায় না। 'চিকিৎসার চেয়ে এই রোগ প্রতিরোধই উত্তম'।

স্ট্রোক হলে সুনির্দিষ্ট ও জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরে যে কোনো হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব।

১. নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

২. হৃৎপিণ্ডের রোগের চিকিৎসা, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

৩. ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য, তামাক পাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৪. চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরানি, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত।

৫.  ফলমূল, শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যে কোনো মাছ, মুরগি ও ডিম খেলে কোনো ক্ষতি হয় না।

(৬) নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিন ৩০–৪০ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে হবে। বাড়তি ওজন কমাতে হবে।

স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা

শরীরের এক পাশ অথবা অনেক সময় দুই পাশ অবশ হয়ে যায়, মাংসপেশীর টান প্রাথমিক পর্যায়ে কমে যায় এবং পরে আস্তে আস্তে টান বাড়তে থাকে, হাত ও পায়ে ব্যথা থাকতে পারে, হাত ও পায়ের নড়াচড়া সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে কমে যেতে পারে, মাংসপেশী শুকিয়ে অথবা শক্ত হয়ে যেতে পারে, হাঁটাচলা, ‌ওঠাবসা, বিছানায় নড়াচড়া ইত্যাদি কমে যেতে পারে, নড়াচড়া কমে যায় যার, ফলে চাপজনিত ঘা দেখা দিতে পারে, শোল্ডার বা ঘাড়ের জয়েন্ট সরে যেতে পারে ইত্যাদি।

এমন অবস্থায় অবিলম্বে নিকটস্থ কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে স্থানান্তর জরুরি। অন্যথায় জীবন সঙ্কটাপন্ন হতে পারে।

স্ট্রোক থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিজেকে আরও সক্রিয় ও সুস্থ রাখা এবং আরও বেশি করে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অঙ্গীকার করুন এই দিনে। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, "প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। স্ট্রোক হলেও বাঁচবে জীবন, না করলে সময় ক্ষেপণ"।

 

(লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক)

Comments

The Daily Star  | English

Netanyahu approves Lebanon ceasefire deal ‘in principle’: media

Israeli Prime Minister Benjamin Netanyahu approved the emerging ceasefire deal with Hezbollah "in principle" during a security consultation with Israeli officials on Sunday night, a source familiar with the matter said

28m ago