মাহফুজ আনামের লেখা: ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও পশ্চিমাদের নৈতিক অবস্থান

গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় আহত শিশুকে বাঁচাতে এক ফিলিস্তিনির আপ্রাণ চেষ্টা। ছবি: রয়টার্স

নিরপরাধ ও বেসামরিক ইসরায়েলিদের ওপর হামাসের নৃশংসতার নিন্দা জানাই। একইসঙ্গে টানা ২১ দিন ধরে গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত যে নির্বিচার হামলা, তারও  নিন্দা জানাই।

গাজায় যা ঘটছে, তা বিবেচনার ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আর ইসরায়েল একটি রাষ্ট্র, যাদের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত নিজস্ব সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় সীমানা—দখলদারিত্বের মাধ্যমে যা তারা নিয়মিত বাড়াচ্ছে। অন্য রাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলেরও আছে নিয়মিত অর্থের যোগানসহ অন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।

কাজেই এই সংঘাত একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সংগঠনের। যখন একটি 'রাষ্ট্র' জ্ঞাতসারে নির্বিচার হামলা চালিয়ে গাজায় সাত হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশই শিশু, তাদের দায়টাই কি বেশি নয়?

দ্য ইকোনমিস্টের ১৪-২০ অক্টোবরের সংখ্যার প্রচ্ছদের শিরোনাম 'ইসরায়েলের যন্ত্রণা'। বিস্তারিত প্রতিবেদনের শিরোনাম 'আঘাত থেকে ক্রোধ' এবং অপর শিরোনাম 'হামাসের নৃশংসতা ও ইসরায়েলের প্রতিশোধ উভয় পক্ষকে চিরতরে বদলে দেবে'।

যে ঘটনাকে জাতিসংঘ মহাসচিব ইতিহাসের 'সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট' বলে অভিহিত করেছেন, সেই ঘটনায় ইকোনমিস্টের এই প্রতিবেদনে আস্থা রাখতে হলে মেনে নিতে হবে যে, হামাসই সব অপরাধ করেছে এবং ইসরায়েল শুধু জবাব দিয়েছে। সেই জবাবও ঠিক ততটুকু, যতটুকু না দিলেই নয়।

বিস্ময় নিয়ে ভাবছিলাম, এই প্রতিবেদন যারা প্রকাশক করছেন এবং আমরা কি একই গ্রহে আছি? যদি তাই হয়, তাহলে দৃষ্টিভঙ্গিতে এত পার্থক্য হয় কীভাবে? মানবিক মূল্যবোধের দিক থেকে চিন্তা করলে, হয় আমি, না হয় পশ্চিমের একটি অংশ মানবতা বিষয়টি ভুলে গেছে।

গত মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ইসরায়েল সফর করেছেন, যেদিন ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েল গাজায় বোমাবর্ষণ করে ৭০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ইসরায়েল সফর করেছেন, ততদিনে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। অথচ, এই পরিস্থিতির মধ্যে মাখোঁ ও বাইডেন তাদের বক্তব্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে কেবল অনুরোধ করেছেন যে, যেন তারা 'নিয়ম বহির্ভূতভাবে যুদ্ধ' না করে।

আমি আন্তরিকতার সঙ্গেই তাদের এই অনুরোধের মর্ম বোঝার চেষ্টা করেছি। বিষয়টা কি এমন যে তথাকথিত নিয়ম মেনে যুদ্ধ করে ফিলিস্তিনি পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করলে সেটা ঠিক আছে? মাখোঁ ও বাইডেন কি এটাই বলতে চেয়েছেন? গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজায় চলতে থাকা হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী কি পুরো বিশ্ব নয়? কোথাও কি কোনো 'নিয়ম' মেনে চলার চিহ্ন দেখা গেছে? গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দাকে খাদ্য, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া কি 'নিয়ম' মেনে চলার উদাহরণ? এমনকি ইসরায়েলকে যুদ্ধের 'নিয়ম' মেনে চলার অনুরোধ জানানো হলেও নিয়ম না মানলে কী হতে পারে, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি তারা।

চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কাছে মার্কিন ইতিহাসে সর্বোচ্চ এককালীন ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বরাদ্দ চেয়েছেন ইসরায়েল ও ইউক্রেনের জন্য।

নির্বিচারে মানুষ হত্যা, শিশু হত্যা, পুরো জাতিকে গৃহহীন করা, গণ উচ্ছেদ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন নিয়ে যদি কখনো ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হয়, তাহলেই কেবল এমন হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে 'নিয়ম' মেনে চলার আহ্বান জানানো যেতে পারে।

পশ্চিমা নেতাদের কেউই এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বা গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানাননি। এমনকি ব্রাজিলের নেতৃত্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে 'মানবিক কারণে যুদ্ধ স্থগিত'র প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু সেটা যুদ্ধবিরতি নয়। এর উদ্দেশ্য ছিল 'সাময়িকভাবে' নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ রেখে চরম দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। গত ১৮ অক্টোবর ফ্রান্সসহ নিরাপত্তা পরিষদের বাকি সব সদস্য এই প্রস্তাবে একমত হলেও যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ভেটো দেয়। এরপর গত ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে যুদ্ধ স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিলে সেখানে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া।

হামাসকে ধ্বংস করতে ইসরায়েলকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। এমনকি এর জন্য যদি ২০ লাখ বাসিন্দাসহ গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়, তাতেও তাদের সমস্যা নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে 'নিয়ম' মানার আহ্বান কেবল লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই না।

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরেও নির্বিচার হত্যা ও আটকের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। অথচ, সেখানে তো হামাস নেই। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ইসরায়েলের হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু শুধু হামাসের মতো সংগঠন নয়, বরং সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসিদের হাতে ইউরোপীয় ইহুদিদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো সার্বজনীন অধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করা হয়, জন্ম নেয় 'মানবতাবিরোধী অপরাধ'র ধারণা। এই আইনে মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় জীবন ও স্বাধীনতাকে। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে কি এগুলো প্রযোজ্য নয়?

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা এই আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সব অর্জন উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে অর্থহীন। কারণ গত ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবিগুলোও অস্বীকার করা হচ্ছে। ৭৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, যা গত দুই দশকে আরও বেশি সহিংস ও অমানবিক হয়ে উঠেছে। বিষয়টি এটাই প্রমাণ করছে যে, এখানে ন্যায্যতা মুখ্য নয়, পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিল একটি মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে। দেশটিকে ধ্বংস করার জন্য কাউকে কি জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছিল? ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। দেশগুলো অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নেমেছে, যার ফলে কেবল হাসি ফুটছে অস্ত্র শিল্পে। এ বিষয়েই ১৯৬১ সালে নিজের বিদায়ী ভাষণে সতর্ক করে গিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় 'উন্মুক্ত কারাগার' হিসেবে পরিচিত গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল বসতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। উত্তর গাজা থেকে গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে নিজেদের বাড়িঘর ও সহায়-সম্পদ ছেড়ে দক্ষিণে 'সরে যেতে' বাধ্য করা হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যেই জনবহুল দক্ষিণাঞ্চলের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। উত্তর গাজা থেকে আসা এসব শরণার্থী এখন সড়ক, পার্ক ও খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন। সেইসঙ্গে গত ৭ অক্টোবর হামাস হামলা চালানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় পানি, খাবার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সব ধরনের জরুরি চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া ভাষণে সংস্থাটির মহাসচিব বলেন, 'আমরা একটি ভয়াবহ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে আছি'। এই লেখাটি যখন পড়ছেন, ততক্ষণে হয়তো ফিলিস্তিনে শরণার্থীদের ত্রাণ বিতরণকারী জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর সব ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম শেষ। একবার ভাবুন সেসব রোগীর কথা যাদের অক্সিজেন দরকার, ইনকিউবেটরে থাকা ২০০টিরও বেশি শিশুর কথা, সেসব মানুষের কথা যারা জরুরি বিভাগে ভর্তি আছেন এবং আরও যারা আসছেন। তাদের কী হবে? অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদেরও মৃত্যু হবে। এভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে শিশুসহ অগণিত মানুষকে হত্যা যদি পরিকল্পিত গণহত্যা না হয়, তাহলে আর কোনটিকে গণহত্যা বলবেন?

এটাই হলো ইসরায়েলের 'আত্মরক্ষার অধিকার', যার নামে তারা হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার মতো অপরাধ করতে পারে। বলা বাহুল্য, ফিলিস্তিনিরা কয়েক শতাব্দী ধরে না হলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে যেসব জমির মালিক ছিলেন এবং যেখানে তারা বসবাস করতেন, সেগুলোও ইসরায়েলিরা দখল করে নিতে পারে। ইসরায়েল যেকোনো ফিলিস্তিনিকে যেকোনো অপরাধে অভিযুক্ত করতে পারে এবং যেকোনো সময় তাদেরকে কারাগারে পাঠাতে পারে। অথচ এর সবই তারা নাকি করছে তথাকথিত 'আত্মরক্ষার্থে'। গত বুধবার ইসরায়েল তাদের 'সুনির্দিষ্ট স্থানে অভিযানে' ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছে, যার অর্থ হলো স্থল হামলা শুরু হতে যাচ্ছে।

আইন, ন্যায়বিচার, সুশাসন, সহনশীলতার সংস্কৃতি ও সাংগঠনিক দৃঢ়তার কারণে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকায় পশ্চিমের দেশগুলোর বিশেষ সম্মানের জায়গায় আছে। তাদের উঁচু দালান, মহাসড়ক বা আধুনিক প্রযুক্তি এই সম্মান তৈরি করেনি। আমি নিশ্চিত নই যে, পশ্চিমের দেশগুলো এ বিষয়টি ঠিক কতটুকু বুঝতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, পশ্চিমের এসব মূল্যবোধ শুধু তাদের জন্যই প্রযোজ্য, আমাদের জন্য নয়। ঔপনিবেশিক শাসকরা আমাদেরকে 'অন্যান্য'র কাতারে ফেলে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল, যার বলিষ্ঠ উদাহরণ সেই আমলের ইতিহাস, বর্ণবাদী আচরণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী নির্মূলের ঘটনা, ধন-সম্পদ লুট ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমাদের মনে হীনমন্যতার চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটানো। কিন্তু, এত কিছুর পরও বলিষ্ঠ আইনি অবকাঠামোর জন্য তাদের কিছু সম্মান প্রাপ্য।

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব ধীরে ধীরে তাদের নৈতিক কর্তৃত্ব হারাচ্ছে। এর জন্য দায়ী তাদের অসংখ্য অন্যায্য আচরণ, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ১৯৪৮ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি করা অন্যায়। তাদের একের পর এক কপট আচরণ এক নিরাশামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এর ফলে তরুণরা, বিশেষ করে বঞ্চিত তরুণরা মরিয়া হয়ে বেপরোয়া কিছু করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই এর ফল আগামীতে নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Undergraduate admission tests under the cluster system faces uncertainty for the 2024-25 academic year, as several prominent universities have decided to withdraw and conduct their own admission tests independently. 

9h ago