আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩

ইংল্যান্ডকে রেকর্ড ব্যবধানে গুঁড়িয়ে বাংলাদেশকে হুঙ্কার দক্ষিণ আফ্রিকার

২২৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হারল বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা, যা ওয়ানডে ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে বড় হার।

ইংল্যান্ডকে রেকর্ড ব্যবধানে গুঁড়িয়ে বাংলাদেশকে হুঙ্কার দক্ষিণ আফ্রিকার

ছবি: এএফপি

বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সর্বনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ড ৯৩ রানের। দক্ষিণ আফ্রিকার ছুঁড়ে দেওয়া ৪০০ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৬৮ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলল তারা। ওই রেকর্ডটা নতুন করেই লেখার সম্ভাবনা জেগেছিল তখন। তবে লেজের ব্যাটারদের বদৌলতে সেই বিব্রতকর অভিজ্ঞতা থেকে বাঁচতে পারলেও আরেকটি ভীষণ তেতো অভিজ্ঞতা হলো তাদের। ২২৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হারল তারা, যা ওয়ানডে ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে বড় হার। রেকর্ড গড়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের গুঁড়িয়ে পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশকেও হুঙ্কার দিয়ে রাখল প্রোটিয়ারা।

শনিবার মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে দেখা মিলেছে চরম একপেশে লড়াইয়ের। ব্যাটারদের তাণ্ডবে বিশাল পুঁজি পাওয়ার পর পেসারদের তোপে ইংল্যান্ডকে হেসেখেলে হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে জস বাটলারের দলের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ। তারা খেলতে পারে মোটে ২২ ওভার। বোলিংয়ের সময় অস্বস্তিতে ভোগা রিস টপলি আর না নামায় ৯ উইকেট পড়ার পরই তাদের ইনিংসের ইতি ঘটে।

চার ম্যাচের তিনটিতে হেরে ইংলিশদের যে নাজুক অবস্থা এখন, তাতে আলাদা করে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন যে তারা বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। শিরোপাধারীদের এভাবে বিধ্বস্ত হওয়া রীতিমতো অবিশ্বাস্যই। বল হাতে বিবর্ণ ইংল্যান্ড একশ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সব দল মিলিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারের শঙ্কাই তখন তাদের পেয়ে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ২৭৫ রানের হারকে ছাড়িয়ে যাওয়া এড়াতে পারলেও ইংল্যান্ডের সঙ্গী হয়েছে ভীষণ হতাশা।

লক্ষ্য তাড়ায় নেমে ইংলিশ ওপেনার জনি বেয়ারস্টোর মাথায় একমুখী চিন্তাই ছিল আক্রমণ। কিন্তু ফ্লাডলাইটের আলোর নিচে সুইং উপযোগী কন্ডিশনের সহায়তা পেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলাররাই উল্টো আক্রমণাত্মক হন। তৃতীয় ওভারেই লুঙ্গি এনগিদিকে ফ্লিক করতে গিয়ে বেয়ারস্টো ফিরে যান বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিয়ে। ১৮ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ভরসার প্রতীক জো রুটকেও ইংল্যান্ড হারিয়ে ফেলে ২৩ রানেই। ব্যাটিংয়ে আলো ছড়ানো মার্কো ইয়ানসেন বল হাতে রুটকে এক অঙ্কে ফেরানোর পর ডাভিড মালানকেও একই পথ ধরিয়ে হ্যাটট্রিকের মুখেও চলে যান।

চোট থেকে ফেরা বেন স্টোকস চলতি বিশ্বকাপে এদিন নামেন প্রথমবারের মতো। কাগিসো রাবাদার দুর্দান্ত ফিরতি ক্যাচের শিকার হয়ে যদিও তাকে ফিরে যেতে হয় ৫ রানেই। পঞ্চাশ পেরুনোর আগেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। চাপের মধ্যে অধিনায়ক বাটলার-হ্যারি ব্রুকও তাদের জুটিটা ২৯ রানের চেয়ে বড় করতে পারেননি। জেরাল্ড কোয়েটজির বলে উইকেটরক্ষকের গ্লাভসবন্দি হয়ে থামেন আগ্রাসী মেজাজে থাকা বাটলার, ৭ বলে ১৫ করে। এক বল পরই ব্রুকও তার পথ ধরলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ইংল্যান্ড। কোয়েটজির বলে এলবিডাব্লিউ হয়ে ব্রুক ফেরেন ১৭ রান করে। ইংল্যান্ডের প্রথম ছয় ব্যাটারের মধ্যে সেটাই তখন ছিল সর্বোচ্চ!

ব্রুকের ইনিংস আর সর্বোচ্চ থাকেনি বলে বিশ্বকাপে রানের হিসেবে সবচেয়ে বড় হার এড়াতে পারে ইংল্যান্ড। চমক জাগিয়ে নবম উইকেটে গাস অ্যাটকিনসন আর মার্ক উড মিলে গড়েন ৩২ বলে ৭০ রানের জুটি! কিন্তু স্রেফ হারের ব্যবধান কমানোর পাশাপাশি দর্শকদের বিনোদন পাওয়াই যেন তখন ছিল মুখ্য! উড অপরাজিত থেকে খেলেন ১৭ বলে ৪৩ রানের ঝড়ো ইনিংস। কেশব মহারাজ ও ইয়ানসেনকে তিনি মারেন পাঁচটি নিখুঁত ছক্কা। বিধ্বস্ত ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুমে একটুখানি হাসির খোরাকও যোগায় উডের মারকাটারি ব্যাটিং। অন্যপ্রান্তে অ্যাটকিনসন একই ওভারে চারটি চার মেরে দেন রাবাদাকে। দুজনের জুটি পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যায় ২৭ বলেই। সাত চারে ২১ বলে ৩৫ রানের ইনিংস খেলে অ্যাটকিনসন বোল্ড হলে থামে ইংলিশদের দুর্দশার ইনিংস।

এর আগে টস জিতে বোলিং নিয়ে হাই-স্কোরিং মাঠে মনের মতো শুরু পেয়ে যায় ইংল্যান্ড। যদিও দিনের বাড়তি তাপমাত্রায় বাটলারের ফিল্ডিং বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত অবাক করে অনেককে। দ্বিতীয় বলেই ভয়ঙ্কর কুইন্টন ডি ককের বিদায় ঘটে যায়। টপলি ও ডেভিড উইলি সুইং পেয়ে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন। ৪ রানে প্রথম উইকেট হারানো দক্ষিণ আফ্রিকা খোলসে আটকে যায়। ৬ ওভার শেষে তাদের রান থাকে ১৮। নিয়মিত অধিনায়ক টেম্বা বাভুমার অসুস্থতায় ওপেনিংয়ে সুযোগ মিলে রিজা হেন্ড্রিকসের। শুরুতে হেন্ড্রিকস বেশ অস্বস্তিতে থাকলেও অন্যপাশে রাসি ফন ডার ডুসেন স্বচ্ছন্দ্যেই খেলে যান।

সপ্তম ওভারের পাঁচটি বল করেই টপলিকে মাঠ থেকে বের হয়ে যেতে হয় আঙুলে চোট পেয়ে। এরপরেই হেন্ড্রিকস ও ডুসেন দুজনেই সমানতালে চড়াও হন ইংলিশ বোলারদের উপর। মেজাজে ভিন্নতা এনে প্রথম পাওয়ার প্লের ১০ ওভারেই ৫৯ রান আনে দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৬তম ওভারেই পেরিয়ে যায় একশ। ডুসেন ৪৯ বলেই পেয়ে যান ফিফটি, এরপর হেন্ড্রিকস তার ফিফটি পূর্ণ করে ফেলেন ৪৮ বলে। দুজনেই যদিও ফিফটিকে বড় ইনিংসে রূপান্তর করার আগেই আউট হয়ে যান। ১১৬ বলে ১২১ রানের জুটির পর ডুসেন আউট হন ৮ চারে ৬১ বলে ৬০ রানের ইনিংস খেলে। হেন্ড্রিকস ফিরে যান যখন ৯ চার ও ৩ ছয়ে ৭৫ বলে ৮৫ করে। দক্ষিণ আফ্রিকা তৃতীয় উইকেট হারিয়ে ফেলে ১৬৪ রানে। দুজনকেই ফেরান লেগ স্পিনার আদিল রশিদ। সুইপে ক্যাচ দেন ডুসেন, ইনসাইড এজে বোল্ড হন হেন্ড্রিকস।

ক্লাসেন ও বাভুমার জায়গায় নেতৃত্ব পাওয়া এইডেন মার্করাম মিলে প্রোটিয়াদের দুইশ পার করান ৩১তম ওভারেই। তাদের ব্যাটে ঝড়ের আভাস মিলতে শুরু করেছিল। কিন্তু ৪২ বলে ৪৪ রানেই থামতে হয় মার্করামকে। মাঠে ফেরা টপলি মার্করামের পর বিপজ্জনক ডেভিড মিলারকেও টিকতে না দিলে প্রোটিয়ারা কিছুটা ধাক্কা খায়। কিন্তু তখনও ক্লাসেনের কারিশমা যে বাকি!

শেষ দশ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবেশ করে ২৫৬ রান নিয়ে। শুরু হয় 'ক্লাসেন শো'। একের পর এক বাউন্ডারি বের করতে থাকেন তিনি। উড যত জোরে বল করছিলেন, ক্লাসেন আরও জোরে তা বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছিলেন। শক্তির সঙ্গে বুদ্ধি মিলিয়ে ইংল্যান্ডের বোলারদের শাসন করতে থাকেন তিনি। ৪০ বলে ফিফটি পূর্ণ করার পর ৬১ বলেই শতক হাঁকিয়ে ফেলেন ক্লাসেন। দ্বিতীয় ফিফটি করতে তার লাগে মাত্র ২১ বল! মুম্বাইয়ের অসহ্য গরমে ধুঁকছিলেন, লড়তে হচ্ছিল নিজের শরীরের সঙ্গেও। তারপরও ১২ চার ও ৪ ছয়ের বিধ্বংসী ৬৭ বলে ১০৯ রানের ইনিংস খেলে যখন ম্যাচসেরা ক্লাসেন ফেরেন, দল তখন দাঁড়িয়ে রানের পাহাড়ের চূড়ায়। ইয়ানসেন শুরুতে ক্লাসেনকে যথার্থ সঙ্গ দেন দেখেশুনে খেলে। পরে তিনিও  যোগ দেন তাণ্ডবে। ৩৫ বলেই হাঁকান ফিফটি। ৩ চারের সঙ্গে মারেন ৬টি ছক্কা! ৪২ বলে ৭৫ রানের ইনিংস খেলে অপরাজিত থেকে যখন ইয়ানসেন মাঠ ছাড়েন, দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করতে থাকে ৩৯৯ রান।

আগের তিন ম্যাচের দুটিতে হেরে বেকায়দায় ছিল ইংল্যান্ড। সবশেষটি ছিল তুলনামূলক দুর্বল আফগানিস্তানের বিপক্ষে। বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের কোণঠাসা অবস্থা আরও ঘনীভূত হওয়ার পরিস্থিতি দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের পরই তৈরি হয়েছিল। শেষমেশ সেই শঙ্কাই সত্যি হলো, তবে আরও তীব্রভাবে। এতে সেমিফাইনালের পথ কঠিন হয়ে গেল তাদের। এখনও ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের মুখোমুখি হতে হবে তাদের।

বিপরীত হাওয়া বইছে প্রোটিয়াদের ডেরায়। নেদারল্যান্ডসের কাছে সবশেষ ম্যাচে অঘটনের শিকার হওয়ার পর কী দারুণভাবেই না তারা ঘুরে দাঁড়াল! চার ম্যাচে তৃতীয় জয়ের এই উচ্ছ্বাস সঙ্গী করেই আগামী মঙ্গলবার ফের মুম্বাইতে খেলতে নামবে তারা। সেদিন তাদের প্রতিপক্ষ টানা তিন হারে বিপর্যস্ত হয়ে আলোর খোঁজে থাকা বাংলাদেশ।

Comments

The Daily Star  | English

Govt relieves Kuet VC, Pro-VC of duties to resolve crisis

A search committee will soon be formed to appoint new candidates to the two posts

1h ago