আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩

স্পিনরাজ্যে পেসাররা রাজত্ব করলেন যেভাবে

এক দলের পেসারদের দুর্দান্ত কৌশলের কাছে আরেক দলের ব্যাটাররা নতজানু হয়েছে। কোনো রকমের প্রতিবাদ ছাড়াই!

স্পিনরাজ্যে পেসাররা রাজত্ব করলেন যেভাবে

ছবি: এএফপি

ধরে নিন, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ আপনি দেখেননি। আপনাকে বললাম, পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে ২৪৫ রানে আটকে গেছে এক দল, খেলা হয়েছে চেন্নাইয়ে। ক্রিকেটের ভালোরকম অনুসারী হলে আপনি ধরেই নিবেন, স্পিনারদেরই বুঝি সর্দারি চলেছে! চেন্নাইয়ে যে স্পিন রাজত্বের কথাই সকলে জানে!

সূচি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের ভেন্যু যখন দেখেছেন চেন্নাই, বাংলাদেশের ভক্ত হলে, স্পিন দিয়ে দুই পয়েন্ট বাগিয়ে নেওয়ার কল্পনা করেছিলেন হয়তো আপনি। চেন্নাইয়ে ভারত-অস্ট্রেলিয়া শেষ ম্যাচ দেখে থাকলে আরেকটু বেশি হয়তো। কেউ কেউ বলেছেন, নিউজিল্যান্ডেরও শক্তিশালী স্পিন আক্রমণ আছেন, সেটা ভুলে গেলে চলবে না! কিন্ত শেষমেশ তাদের, আমাদের— কোনো স্পিনারেরই দাপট দেখা যায়নি। চেন্নাইয়ে গতকাল শুক্রবার চলেছে পেসারদের রাজত্ব।

চেন্নাইয়ের মাঠে বল এদিক-সেদিক বড় বড় বাঁক খাবে। ব্যাটার বড় টার্ন দেখে মুখ হাঁ করবেন। এমনটাই তো হওয়ার কথা। এদিন কী হলো, লোকি ফার্গুসনের একের পর এক গতিময় বাউন্সার সাঁই সাঁই করে আসছে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মাথার দিকে। ট্রেন্ট বোল্ট-ম্যাট হেনরিও বলতে গেলে সমানতালেই বাউন্সার করে গেছেন।

এমনটা করার কারণ— উইকেটের চরিত্রের ভিন্নতা। বিশ্বকাপের স্বাগতিক হিসেবে ভারত সুযোগ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে স্পিনবান্ধব ২২ গজে ঘায়েল করার। কিন্তু একই মাঠে হলেও বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের পিচ ছিল আলাদা, সেটা আবার পেসারদের উপযোগী।

ওভারে দুইটা বাউন্সার যে করা যায়, সেটা পূর্ণরূপেই যেন কাজে লাগান কিউই পেসাররা। মনে হচ্ছিল, প্রত্যেক ওভারেই বরাদ্দে থাকা ওই দুই বাউন্সার অন্তত করে গেছেন তারা। ধারাভাষ্যকক্ষে সঞ্জয় মাঞ্জরেকার পরে বলছিলেন, বাংলাদেশের ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের পেসাররা ৫৬% বল শর্ট লেংথে করেছেন। বুঝতে পারছেন কতটা নিয়মিত মাথা তাক করা বাউন্সারের পাশাপাশি বুক বরাবর শর্ট বলও করে গেছেন তারা? ইএসপিএনক্রিকইনফোর মারফতে জানা গেছে, ফার্গুসন যে ৬০ বল করেছেন, তার মধ্যে ৪৫টি বলই ছিল শর্ট অথবা শর্ট অব অ্যা গুড লেংথে। ভাবা যায়, ৪৫ বল!

আচ্ছা ১২তম ওভারে ফিরে যাই চলুন। সে ওভারের দ্বিতীয় বল বাউন্সার, এরপরের বল অতিরিক্ত বাউন্সে ওয়াইড। এক বল পর আবার বাউন্সার করলেন ফার্গুসন। মেহেদী হাসান মিরাজ ফাঁদে পড়ে গেলেন, ক্যাচ দিয়ে দিলেন ফাইন লেগে। মুশফিকুর রহিমের সামনেও বাউন্সার করে যাওয়া হয়েছে। মুশফিক দুর্দান্তভাবেই সেসব ছেড়ে দিচ্ছিলেন, একটি করে ছক্কা-চারও মেরেছিলেন। তাওহিদ হৃদয়ও বাউন্সার ভালোভাবে সামলে সিঙ্গেল বের করতে পেরেছিলেন। তবে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান শিকার বনে গেছেন ওই শর্ট বলেরই। পাশাপাশি অন্য লেংথের ডেলিভারির মিশ্রণটাও দুর্দান্তভাবে কার্যকর করে তুলেছিল নিউজিল্যান্ড।

আর বাংলাদেশের ভালোই দুর্বলতাও আছে শর্ট বলে। ইএসপিএনক্রিকইনফো বলছে, শেষ দুই বছরে শর্ট বলে বাংলাদেশের স্ট্রাইক রেট ৮৫, এর চেয়ে কম স্ট্রাইক রেট আর কোনো দেশেরই নেই! বিশ্বকাপে খেলা দেশগুলোর মধ্যে শর্ট বলে ব্যাটিং গড়েও বাংলাদেশ নিচের তিন দেশের একটি। 

তাহলে কী পূর্ব-পরিকল্পনা? ম্যাচ শেষে প্রেজেন্টশনে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন বলেছেন, শর্ট বলের প্ল্যানে যাওয়ার কথা তারা মাঠেই পাওয়ারপ্লের মাঝপথে নিয়েছিলেন। ফার্গুসনও বলেছেন, হায়দরাবাদের (নিজেদের আগের ম্যাচটি তারা খেলেছিলেন হায়দরাবাদে) তুলনায় চেন্নাইয়ে বাউন্স বেশি ছিল। কন্ডিশন বুঝে সেই অনুযায়ী কার্যকর পথ খুঁজে বের করা, কিউই পেসারদের ও অধিনায়কের প্রশংসা না করলে হয়!

নিউজিল্যান্ড পেসাররা মিলে ৩১ ওভারে ১৬৩ রান দিয়ে নেন ৭ উইকেট। তাদের বোলিং গড় ছিল ২৩.২৮। শেষ ১০ বছরে চেন্নাইয়ে পেসাররা অন্তত ৫ উইকেট নিয়েছেন যেসব ম্যাচে, তার মধ্যে সেরা বোলিং গড় এখন তাদের।

বাংলাদেশের পেসাররা যেমন দিন পার করেছেন, চেন্নাইয়ে অতটাও দুর্দিনও যায় না পেসারদের। ২৩.৫ ওভারে তারা ১৩৫ রান দিয়ে পান মোটে ১ উইকেট। চেন্নাইয়ে কমপক্ষে ২০ ওভার পেসাররা বোলিং করেছেন যেসব ম্যাচে, তাতে সবচেয়ে বাজে গড় বাংলাদেশিদের এই ১৩৫! তবে বাংলাদেশি পেসাররা ইনিংসের শুরুতে সুইং পেয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন। প্রথম ১৪ ওভার বোলিং করে ৬৫ রান খরচায় উইকেটও নিয়েছিলেন। 

চেন্নাইতে এদিন পেসারদের জন্য ভালো সহায়তা মজুদ ছিল। আর তাদের যে রাজত্ব চলেছে, সেটা পুরো ম্যাচের পরিসংখ্যানের হিসাবে বোঝাতে দিচ্ছে না আসলে বাংলাদেশি পেসারদের বোলিংটাই! তবে কিউই পেসারদের পরিসংখ্যানই বোঝাতে যথেষ্ট, কতটা দাপুটে ছিলেন তারা।  উইকেট ভিন্ন হওয়ায় স্পিনাররা তা পারেননি। দুই দলের স্পিনাররা মিলে ৩৮ ওভারে ১৯৩ রান দিয়ে শিকার করেন ৩ উইকেট। ৬৪.৩৩ ছিল এদিন স্পিনারদের বোলিং গড়। চেন্নাইয়ের মাঠে কমপক্ষে ৩৫ ওভার স্পিন বোলিং হয়েছে যেসব ম্যাচে, তাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরুচে বোলিং গড় এটি।

চেন্নাইয়ের পিচ আসলে এদিন চমক নিয়েই হাজির হয়েছিল দর্শকদের জন্য। তবে দুই দলই সেটার ভাষা আগে থেকে পড়তে পেরেছিল। তা বলা যায় তাদের একাদশ নির্বাচন দেখে। নিউজিল্যান্ড যেমন পেসার কমিয়ে অতিরিক্ত স্পিনার খেলায়নি, বাংলাদেশও স্পিনার কমিয়ে অতিরিক্ত ব্যাটারই রাখে। তবে শেষ পর্যন্ত খেলাটা দুই দলের পেসারদের মধ্যে হয়নি। এক দলের পেসারদের দুর্দান্ত কৌশলের কাছে আরেক দলের ব্যাটাররা নতজানু হয়েছে। কোনো রকমের প্রতিবাদ ছাড়াই!

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

4h ago