বিজ্ঞানীদের সঠিক সময়ে পুরস্কার দিতে হিমশিম খাচ্ছে নোবেল কমিটি

ছবি: রয়টার্স

এমআরএনএ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য এ বছর যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কাতালিন কারিকো ও ড্রু ওয়েজমান।

এমআরএনএ নিয়ে এই দুই গবেষকের যৌথ গবেষণা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ২০০৫ সালে। তাদের ওই গবেষণায় উঠে এসেছিল কীভাবে এমআরএনএতে নির্দিষ্ট নিউক্লিওসাইডের পরিবর্তন এনে শরীরে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করা যায়।

সে সময় তাদের গবেষণা খুব একটা মনোযোগ না পেলেও, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শুরু হলে তাদের ওই গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই টিকা উদ্ভাবনের দিকে এগিয়ে যায় টিকাপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও মডার্না। আর তাই এই ২ গবেষককে নোবেল এনে দেয়।

প্রতি বছরই নোবেল ঘোষণায় দেখা যায়, অনেক বছর আগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা উঠে আসছে, গবেষকদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে।

যেমন: সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি) যে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বকে সমর্থন করে এই আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্যার রজার পেনরোজ। কিন্তু এই যুগান্তকারী গবেষণাপত্রটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৬৫ সালে। অর্থাৎ মূল আবিস্কারের ৫৫ বছর পর ৮৯ বছর বয়সে এসে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই কিংবদন্তী পদার্থবিদ।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নোবেলপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীরা তাদের বয়স গড়ে ৩০ এর কোটায় থাকা অবস্থাতেই নোবেল পেয়েছিলেন, যা বর্তমানে বিরল দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিজ্ঞানীদের কোনো বৈপ্লবিক আবিষ্কার এবং সেই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে নোবেলপ্রাপ্তির সময়ের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। আবিষ্কার ও নোবেলপ্রাপ্তির সময়ের এই ব্যবধানকে ইংরেজিতে বলে 'নোবেল ল্যাগ'।

বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বৈজ্ঞানিক পুরস্কার হচ্ছে নোবেল। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জন্য এই পুরস্কারপ্রাপ্তির পথটি ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। বর্তমানে অধিকাংশ বিজ্ঞানী তাদের নোবেল-পুরস্কারযোগ্য আবিষ্কারের পর থেকে নোবেলপ্রাপ্তি পর্যন্ত ২০ বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করেন।

বিজ্ঞানের যে ৩টি শাখায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় সেগুলো হলো—রসায়ন, পদার্থ ও চিকিৎসা। গত দশকের নোবেল পুরস্কারের তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, রসায়নের ক্ষেত্রেই এই 'নোবেল ল্যাগ' সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩০ বছর। আর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত 'নোবেল ল্যাগ' চিকিৎসাশাস্ত্রে, ২৬ বছর।

সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল তার উইলে উল্লেখ করেছিলেন, মানবজাতির জন্য অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কারটি দেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটেশনাল সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট স্যান্টো ফর্টুনাতো ২০১৪ সালে একটি গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেছেন, যাতে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল বিজয়ীদের আবিষ্কারগুলো উল্লেখ ছিল। তার গবেষণায় দেখা গেছে, নোবেল-পুরস্কারযোগ্য গবেষণা ও পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্যে সময়ের ব্যবধান ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ১৯৬০ এর দশক থেকে এই ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

তবে এর পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন নিউ ইয়র্কের কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটেশনাল সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট ইয়ান ইন। তিনি বলেন, 'প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের পরিমাণ বাড়ছে। নোবেল পুরস্কার কমিটি স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যদের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না। তবে এটাও ঠিক যে কিছু কিছু আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে জনসাধারণের কয়েক দশক লেগে যায়।

এছাড়া, নোবেল-পুরস্কারযোগ্য আবিষ্কার থেকে পুরস্কার পাওয়া পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান বাড়তে থাকায় আরেকটি লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সেটি হচ্ছে বিজ্ঞানে 'বৈপ্লবিক' আবিষ্কারের সংখ্যা কমেছে। 'বৈপ্লবিক' আবিষ্কার বলতে বোঝায় এমন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বা আবিষ্কার যা তাদের ক্ষেত্রের পুরোনো ধারণাকে বদলে দেয়।

এটা সত্যি যে বিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কারের সংখ্যা কমছে। ফর্টুনাতোর মতে, যুগান্তকারী আবিষ্কার হলে তা দ্রুত স্বীকৃতি পায়। যেমন, জিনোম এডিটিংয়ের পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনিফার ডাউডনা এবং ফ্রান্সের এমানুয়েল শারপন্টিয়ের। তারা তাদের আবিষ্কারটি করেছিলেন তার মাত্র ৮ বছর আগে।

ফর্টুনাতো উল্লেখ করেন, যদি 'নোবেল ল্যাগ' বাড়তে থাকে, তাহলে নোবেল কমিটির মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান না করার নিয়মের কারণে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা এই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। অবশ্য মরণোত্তর নোবেল না দেওয়ার সিদ্ধান্তে ব্যাঘাত ঘটেছিল ২০১১ সালে। সে বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে যৌথভাবে নোবেল পান রালফ স্টেইনম্যান, যিনি পুরস্কার ঘোষণার মাত্র তিন দিন আগে মারা গিয়েছিলেন।

ফর্টুনাতো বলেন, মরণোত্তর পুরস্কার প্রদানের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করলে আরও বেশি মানুষ তাদের কাজের যোগ্য স্বীকৃতি পাবে।

তবে শুধু যে বিজ্ঞানের শাখাগুলোতে বিজ্ঞানীদের পুরস্কার পেতে দেরি হচ্ছে তা নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও একই অবস্থা। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য অর্থনীতিতে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছিলেন অভিজিৎ ব্যানার্জী, এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার। তাদের গবেষণা অনেক দিন ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।

১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতেও এই ৩ জনের গবেষণার বাস্তব সাফল্য দেখা গিয়েছিল। তবু তারা নোবেল পেয়েছেন দীর্ঘ সময় পর।

সূত্র: নেচার, ইকোনোমিস্ট

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English

123 individuals 'pushed in' from India

BGB sends protest note to BSF; border on high alert

59m ago