বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ: ‘আর নষ্ট করার সময় আমাদের নেই’
ভোগৌলিকভাবে দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। অঞ্চলটি সিসমিক্যালি অ্যাক্টিভ। গত ২ মাসে বাংলাদেশ ও এর আশপাশে মৃদু মাত্রার প্রায় ৩৪টি ভূমিকম্প হয়েছে, যা আভাস দিচ্ছে বড় ধরনের বিপর্যয়ের।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশের অবস্থা তুরস্ক-সিরিয়া কিংবা মরক্কোর চেয়েও খারাপ হতে পারে।
ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস নেই। কোথাও ভূমিকম্প হলে সবার আগে সে তথ্য জানায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস)। ভূমিকম্প বিষয়ক তথ্য আদান-প্রদানে ইউএসজিএস বা ইন্ডিয়া মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) সঙ্গে সংযোগ নেই বাংলাদেশের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের গবেষণা বলছে, বড় ধরনের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের ৯টি মেগাসিটির অধিকাংশ ভবনই টিকবে না। ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
ভূমিকম্পপ্রবণ বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র নিয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাঈয়্যাত কবির, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ড. দিলারা জাহিদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাঈয়্যাত কবির বলেন, 'ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরোশিয়ান প্লেট- এ দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। আসামে এ দুটো প্লেটের একটি সাবডাক্ট হয়েছে, যা নেপাল থেকে বিস্তৃত হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত এসেছে, যাকে আমরা আসাম ফল্ট (চ্যুতি) বলি। এ ছাড়া, আমাদের এখানে সিসমিক গ্যাপ আছে, ডাউকি ফল্ট আছে, আমাদের ঠিক উত্তর-পূর্বে মিয়ানমারের যে অঞ্চল, সেখানে সেগাইং ফল্ট আছে। স্বাভাবিকভাবেই গোটা অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ।'
গত ২০০ বছরে এ অঞ্চলে বেশ বড় মাত্রার ভূমিকম্পও হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'হরহামেশাই ছোট মাত্রার (৫-৫.৫ মাত্রা) ভূমিকম্প হয়। গত ২ মাসে বাংলাদেশে ৬টির মতো ভূমিকম্প হয়েছে। আমরা জানিয়েছি, এই ভূমিকম্পগুলো আমাদের দেশের ভেতরেই হয়েছে। এই যে ছোট ছোট ভূমিকম্প, আমি বলব না এগুলো বড় কিছুর ইনডিকেশন। তবে এ অঞ্চলটি যে সিসমিক্যালি অ্যাক্টিভ, সেটা একটা ইনডিকেশন যে, এখানে ভূমিকম্প হয় এবং যেকোনো সময়ই হতে পারে কম বা বেশি মাত্রার।'
'অনেক সময় মাটির নিচে সঞ্চিত শক্তি রিলিজ করতে গিয়েও ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশের ভেতরে অনেক বছর ধরে আমরা বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হতে দেখিনি। তবে গত ২ মাসে যে ভূমিকম্পগুলো অনুভূত হয়েছে, সাধারণত এরকম বাংলাদেশে একটু কম হয়', বলেন এই ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণবিদ।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৩টি স্টেশনের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ করে। অধিদপ্তরের অফিসে সম্প্রতি একটি জিপিএস সিস্টেম বসানো হয়েছে।
রুবাঈয়্যাত কবির বলেন, 'ইউএসজিএসের নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী, তারা বিভিন্ন দেশে সেন্সর বসিয়েছে এবং অনেকের সঙ্গেই তাদের কোলাবোরেশন হয়। আমরা কোনো নেটওয়ার্কের সঙ্গেই যুক্ত না। ভারতীয়দের সঙ্গেও না। তবে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সুবিধা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সরকারি সিদ্ধান্ত।'
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট নামে ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনে একটা সাব-সয়েল মাইক্রোজোনেশন ম্যাপ তৈরি করেছি, যা আমাদের ছিল না। অপরদিকে ঢাকা শহরের সয়েল রিকোয়ালিফিকেশন- ভূমিকম্পে মূলত মাটিতে কম্পনের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে মাটির লেয়ার যদি সরে যায়, তাহলে ভবন আস্তে আস্তে দেবে যাবে। ঢাকা শহরে যেসব জায়গায় বালু ফেলে ভরাট করে ভবন বানানো হয়েছে, সেসব জায়গায় সয়েল রিকোয়ালিফিকেশন ইফেক্ট করার সম্ভাবনাই বেশি।'
ঢাকায় রাজউকসহ আরও ৭টি পৌরসভা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো এলাকার চেয়ারম্যানও এই অনুমোদন দিচ্ছেন। সেজন্য ঢাকা শহরে কতগুলো ভবন সত্যিকার অর্থে দুর্যোগ সহনীয় করে তৈরি হয়েছে, আর কতগুলো ভবন দুর্যোগপ্রবণ, তার সঠিক কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই।'
'রাজউকের গত ৩ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৮-১০ হাজার ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে দেখা যায় নির্মাণাধীন ভবনের সংখ্যাই ২০-২৫ হাজার। দ্বিগুণেরও বেশি অনুমোদন ছাড়া। রাজউক থেকে অনুমোদন নেয় না, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমোদন নিচ্ছে বা অনেকে অনুমোদন নিচ্ছেই না। সেই জায়গাটাই আমাদের আশঙ্কার কারণ', বলেন রাজউকের এই কর্মকর্তা।
সাব-আরবার্ন এরিয়া- বিশেষ করে সাভার, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, কালীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ মোস্ট ভালনারেবল উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পিএমও থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল। যেসব এলাকায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে, সেসব এলাকায় পৌরসভা কর্তৃপক্ষ থাকলেও তারা যেন ভবন নির্মাণের অনুমোদন না দেয়।'
আশরাফুল ইসলাম বলেন, '২০১৮ সালে ড্যাপের জরিপে শুধু সরকারি ভবনগুলোকে (বিশেষ করে স্কুল, হাসপাতাল) আইডেন্টিফাই করা হয়েছিল। কেননা এগুলো দুর্যোগের সময় প্রাইমারি শেল্টার হিসেবে কাজ করে। এই জরিপে কোনো ব্যক্তিগত ভবনকে নেওয়া হয়নি। এসব তো হাতেগোনা সংখ্যা, বেশিরভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন। ঢাকা শহরে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ভবন ভূমিকম্প সহায়ক কি না, এ পর্যন্ত এমন কোনো জরিপ করা হয়নি।'
যে ভবনগুলো ইতোমধ্যে হয়ে গেছে সেগুলোর জন্য রাজউকের ৮টি জোনে একটি চেকলিস্ট করে দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সেই চেকলিস্টের অধীনে কতগুলো কনসাল্টিং ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ভবনের (বিশেষ করে ছয়তলা বা তার বেশি) ভিজ্যুয়াল ইন্সফেকশন করে দেখবে। প্রয়োজনে রেট্রোফিটিং, সম্ভব না হলে ডেমুলেশন করে পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব দেব। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এতদিন আমরা শুধু স্থাপত্য নকশা (আর্কিটেকচারাল ড্রয়িং) দেখতাম, কাঠামো নকশা (স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং) বা সাব-সয়েল কন্ডিশন জমা নেওয়া হতো না। এখন জোন-৩ ও ৪-এ পাইলটিং আকারে শুরু করেছি, এ দুটি জোনে কাঠামো ও স্থাপত্য উভয় নকশা জমা দিলেই কেবল ভবন নির্মাণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে।'
রাজউকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'যেহেতু একের পর এক কম্পন অনুভূত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমরা এই উদ্যোগটা গ্রহণ করেছি। একেকটি ভবনের সমীক্ষা চালাতে ৩-৪ লাখ টাকা লাগবে। সব তো রাজউক বা সরকার দেবে না। আমরা হয়ত মালিকদের টেকনিক্যাল জনবল ও সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করব। সেই টাকা হয়ত রাজউক দেবে। আমরা ইতোমধ্যেই একটি প্রাইমারি ড্রাফট করেছি। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই নগর উন্নয়ন কমিটি বরাবর উপস্থাপন করা হবে। তারা এনডোর্স করলে স্টেকহোল্ডার কনসাল্টেশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অফিশিয়ালি কার্যক্রমটা শুরু করব।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ড. দিলারা জাহিদ বলেন, 'মোটামুটি নিশ্চিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে স্বতঃসিদ্ধ যে, আমরা ভূমিকম্প জোনের মধ্যে আছি এবং ভূমিকম্প হবেই। এটা ধরে নিয়েই আমাদের এগুতে হবে। তবে যেভাবে হাইরাইজ ভবন করা হয়েছে, কোনো তদারকি নেই। একটি বড় ভূমিকম্প হলে মরক্কো, তুরস্ক বা এর থেকেও খারাপ অবস্থা হতে পারে।'
'ভূমিকম্পের পাশাপাশি যে ঘটনাগুলো ঘটবে, গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ, আগুন লাগা, এতেও প্রচুর মানুষ মারা যাবে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আমরা দেখেছি, একটা ভবন ধসে পড়লেই সেটাকে সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নেই। আমাদের প্রস্তুতির অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। আমরা রেগুলার ড্রিলিং করি না। সেসময় মানুষ প্যানিকড হয়ে কী করবে না করবে, কীভাবে নিজেকে সেভ করবে, কীভাবে ভবন থেকে নেমে আসবে, এই জিনিসগুলো এখানে শেখানো হয় না। ভূমিকম্প হলে করণীয় কী, সে বিষয়ে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই', বলেন তিনি।
এই গবেষক বলেন, 'বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে আমরা একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ে যাব। ইতোমধ্যে ৯টি মেগাসিটিতে আমাদের রিস্ক অ্যাসেস করা আছে। অধিকাংশ ভবনই সেখানে টিকবে না। পুরো ঢাকা শহর সম্পর্কে বলা আছে, ৫৩ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা বিনষ্ট হয়ে যাবে। আরও বলা আছে, যে পরিমাণ ধ্বংসস্তুপ এখানে তৈরি হবে, তা সরিয়ে নিতে ২৫ টনের একটি ট্রাককে ১২ লাখ বার যাতায়াত করতে হবে।'
'এগুলো আমাদের বানিয়ে বলা কথা না। এগুলো সবই গবেষণার রিপোর্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব গবেষণা করা হয়েছে। সব রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে আছে। অকাঠামোগত ও অবকাঠামোগত যে প্রস্তুতি, আমাদের দুটোর অবস্থাই খুব খারাপ। জাপানে বছরে কমপক্ষে ৬ হাজার ভূমিকম্প হয়, তারা কি ভবন তৈরি করেনি? হাইরাইজ ভবনে থাকছে না? সেই প্রযুক্তি এনে, একেকটা জোন ধরে ধরে কাজ করতে হবে। কারণ আমাদের গবেষণায় রেড জোন, ইয়োলো জোন, গ্রিন জোন ভাগ করাই আছে। আমাদের অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার', বলেন তিনি।
এজন্য পদ্মা সেতুর মতো বড় ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার উল্লেখ করে ড. দিলারা জাহিদ বলেন, 'সরকারের উচিত ভূমিকম্প সহনশীল ভবনের দিকে নজর দেওয়া। ভূমিকম্প সহনশীল যে জাতিগুলো আছে, তারা আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। তাদের পরামর্শ এবং সহায়তা নিয়ে অতি দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।'
তিনি বলেন, 'ভূমিকম্প বলে-কয়ে আসবে না। ভূমিকম্পের সাইকেল অতিক্রম করছেই, আমাদের মাটির নিচে এনার্জি রয়েই গেছে, এটা রিলিজ হয়নি। এখানে আর কোনো সময় নষ্ট করার সময় আমাদের নেই।'
Comments