সংকটে ‘ডুবছে’ জার্মানির অর্থনীতি

জার্মানির অর্থনীতি
জার্মানির অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি গাড়িশিল্পে নতুন নতুন উদ্ভাবন কম হওয়ায় বিশ্ববাজারে দেশটির গাড়ি কম বিক্রি হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

'ইউরোপের রুগ্ন মানব' বা 'সিক ম্যান অব ইউরোপ' বলতে এক সময় ওসমানীয় খেলাফতের তুরস্ককে বোঝানো হতো। কালের বিবর্তনে সেই তকমা জুটেছিল জার্মানির কপালে। চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে আবারও সেই খেতাবে ভূষিত হচ্ছে ইউরোপের প্রভাবশালী এই দেশটি।

গত ১ আগস্ট জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক সংবাদ শিরোনামে বলা হয়—জার্মানি: দ্য রিটার্ন অব দ্য 'সিক ম্যান' অব ইউরোপ?

প্রতিবেদন অনুসারে, জার্মানির অর্থনীতি আবারও 'ডুবতে' বসেছে। চলতি বছরের ২ প্রান্তিকে দেশটির উৎপাদন কমেছে। অনেক অর্থনীতিবিদ এই পরিস্থিতিকে 'কারিগরি মন্দা' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

এতে আরও বলা হয়, গত প্রান্তিকে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকের মতোই আটকে গেছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকই নিম্নমুখী।

মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেইবনিজ ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের আইফো ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ক্লেমেন্স ফুয়েস্টের ভাষ্য, 'জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে।'

প্রতিষ্ঠানটির গবেষকদের আশঙ্কা জার্মানির জিডিপি চলতি প্রান্তিকেও কমবে।

গত ১৭ আগস্ট ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট শিরোনাম করে, 'ইজ জার্মানি ওয়ান্স অ্যাগেইন দ্য সিক ম্যান অব ইউরোপ?'

এর আগেও তথা ১৯৯৯ সালের দিকে এই দেশটির কপালে এমন তকমা জুটেছিল উল্লেখ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২৫ বছর আগে দ্য ইকোনমিস্ট জার্মানিকে 'সিক ম্যান অব ইউরোপ' আখ্যা দিয়েছিল। সেসময় পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানির একত্রীকরণের প্রেক্ষাপটে চাকরির সংকট ও রপ্তানির শ্লথগতি দেশটির অর্থনীতিকে প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।

এরপর, অনেক সংস্কারের মধ্য দিয়ে জার্মানি ক্রমশ ইউরোপের শীর্ষ অর্থনৈতিক দেশ হয়ে উঠার খেতাব পায়।

জার্মানির অর্থনীতি
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে জার্মানির ৪৯ শতাংশের মত দেশটির অর্থনীতি ‘তেমন ভালো নয়’। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

প্রতিবেদন আরও বলা হয়, জার্মানির অর্থনীতি যেভাবে সংকুচিত হচ্ছে তা দেখে বলা যায় যে ২০২৩ সাল দেশটির জন্য তেমন কোনো সুখবর আনছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, আগামী ৫ বছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও স্পেনের তুলনায় জার্মানির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম হবে।

গত ১৭ জুলাই আইএমএফ'র প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্বালানি সংকট ও বৈরী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ২০২৩ সালে জার্মানির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা নেতিবাচক হতে পারে।

এতে আরও বলা হয়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জার্মানির প্রতি আইএমএফ'র পরিচালকদের পরামর্শ হলো—মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে দেশটিকে স্বল্পমেয়াদি এবং শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি আনতে মধ্যমেয়াদি নীতি গ্রহণ করতে হবে।

তবে 'সিক ম্যান অব ইউরোপ' তকমার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক আন্দ্রিয়াস পিশল। তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, 'গত ২৫ আগে জার্মানির অবস্থা আরও খারাপ ছিল। বেকারত্ব আরও অনেক বেশি ছিল।'

তার ভাষ্য, 'তবে এটা সত্য যে এখন পরিস্থিতি ভালো না। অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীর হচ্ছে। অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।'

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে জার্মানির জিডিপি ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকেও প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় থাকায় জিডিপি অপরিবর্তিত আছে।

গত ১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জার্মানির জিডিপি কমেছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

এ ছাড়াও, চলতি বছরে পরপর ২ প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতির এমন চিত্রকে 'কারিগরি মন্দা' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

গত ৭ সেপ্টেম্বর রয়টার্স জানায়, চলতি বছর জার্মানির অর্থনীতি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। আইফো ইনস্টিটিউটের পূর্বাভাষ বিভাগের প্রধান তিমো ভলমেরশাইউসের বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, 'আমাদের বর্তমান পূর্বাভাষে দেখা যাচ্ছে, জার্মানির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।'

জার্মানির অর্থনীতি

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে জার্মানির জিডিপি ছিল তিন দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এর পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮৯ ট্রিলিয়ন ডলারে। ২০২০ সালে তা অপরিবর্তিত থাকে। ২০২১ সালে তা চার দশমিক ২৬ ট্রিলিয়নে পৌঁছালেও পরের বছর তা সেখান থেকে কমে চার দশমিক শূন্য সাতে নেমে আসে।

ফেডারেল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস অব জার্মানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে জানা যায়, গত আগস্টে দেশটির মূল্যস্ফীতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ছিল ছয় দশমিক এক শতাংশ বেশি। এর আগের মাসে তা ছিল ছয় দশমিক দুই শতাংশ।

জার্মানির অর্থনীতি
আইএমএফ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জ্বালানি সংকট ও বৈরী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ২০২৩ সালে জার্মানির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা নেতিবাচক হতে পারে। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ফেডারেল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস অব জার্মানির প্রেসিডেন্ট রুথ ব্রান্ড বলেছেন, 'মূল্যস্ফীতির হার এখনো অনেক রয়ে গেছে। তিনি এর পেছনে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করেন।

গত সোমবার ইউরোপিয়ান কমিশনের বরাত দিয়ে ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর জার্মানির অর্থনীতি সংকুচিত হবে। এতে আরও বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় জার্মানির উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

যেসব কারণে অর্থনৈতিক মন্দা

গত ২৮ জুলাই রয়টার্সের প্রতিবেদনে জার্মানির অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে কারণ হিসেবে জ্বালানি সংকট, সুদের উচ্চ হার ও কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, জার্মানির এমন দুরবস্থার মধ্যে দেখা যাচ্ছে রপ্তানি ও পর্যটনের কল্যাণে ফ্রান্স ও স্পেনের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।

তবে জার্মানির ভোক্তাদের পণ্য কেনার প্রবণতা আগের মতো থাকায় একে ইতিবাচক হিসেবে রয়টার্স প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্লেষক আন্দ্রিয়াস পিশল মনে করেন, জার্মানিতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব অনেক। এখন অদক্ষ শ্রমিকেরও অভাব দেখা দিয়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

অপর বিশ্লেষক ও লেখক গ্রেগর সেবাস্তিয়ান ডয়েচে ভেলেকে বলেন, 'জার্মানির অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে গাড়িশিল্প। এই শিল্পে নতুন নতুন উদ্ভাবন কম হওয়ায় বিশ্ববাজারে দেশটির গাড়ি কম বিক্রি হচ্ছে।'

বর্তমানে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ির বাজার। সেখানে জার্মানির অবস্থান পঞ্চম। তাই গবেষণা ও উদ্ভাবনীর বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত ২৮ জুলাই জার্মান অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবিক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, 'ব্যক্তি পর্যায়ে পণ্য কেনার হার ও বিনিয়োগে ক্ষীণ ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তা যথেষ্ট নয়।'

এসব সত্ত্বেও তিনি দেশটির অর্থনৈতিক সূচকগুলোকে 'সন্তোষজনক' বলেও মন্তব্য করেন।

পরিস্থিতি উন্নয়নে অর্থমন্ত্রী হাবিক 'আর্থিক প্রণোদনা' দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।'

গত ২৫ মের প্রতিবেদনে রয়টার্স জানায়, ২০২৩ সালের শুরু থেকেই জার্মানি অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে। প্রতিবেদনে দেশটির উচ্চ মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়।

যেমন আছেন জার্মানির মানুষ

গত ২ সেপ্টেম্বর জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক তথ্যচিত্রে দেশটির ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা বলা হয়। জনগণের কষ্টের পাশাপাশি এতে তুলে ধরা হয় জেনারেটর ব্যবসার রমরমা ভাব।

'ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই দেশটিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে' উল্লেখ করে জেনারেটর বিক্রেতা আলেক্সান্ডার হারলিংহাউসেন সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'গত ২ বছর ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে। গত কয়েক মাসে তা বেড়েছে।'

তিনি জানান, আগে মানুষ জেনারেটর কিনতেন 'শখের বশে' অর্থাৎ, ঘরের বাইরে পার্টি করার সময়। এখন তারা জেনারেটর কিনছেন বাধ্য হয়ে। তিনি আরও জানান, গত ১ বছরে তার দোকানে জেনারেটর বিক্রির হার শতভাগ বেড়েছে।

হাসপাতাল থেকে শুরু করে নানান প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর কিনছে বলে জানা যায় ডয়েচে ভেলের সেই প্রতিবেদন থেকে। এর জন্য ক্রেতাদের কমবেশি ৩ হাজার ইউরো করে গুনতে হচ্ছে।

পশু চিকিৎসক কাই হার্লামের্ত সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'ভাবুন তো, আমি সার্জারি করছি আর এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। এমন অবস্থায় ইমারজেন্সি জেনারেটরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।'

'এমনটি আগে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি' উল্লেখ করে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, 'এখন অনেক অর্থ খরচ করে জেনারেটর কিনতে হয়েছে।'

গত ২ সেপ্টেম্বর ডয়েচে ভেলের অপর এক সংবাদে বলা হয়, এক জরিপে দেখা গেছে দেশটির মাত্র ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন জার্মানির অর্থনীতি 'খুবই ভালো', ২৪ শতাংশ মানুষের মতে এটি 'ভালো', ৪৯ শতাংশের মত 'তেমন ভালো নয়'।

জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা 'খারাপ' বলে মনে করেন ২৪ শতাংশ মানুষ।

জরিপে আরও বলা হয়, এখন থেকে এক বছর আগে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা 'ভালো ছিল' বলে মনে করেন দেশটির ১৩ শতাংশ মানুষ। এই বিষয়ে ৩৮ শতাংশের মত—অর্থনীতি আগে যেমন ছিল এখন 'তেমনই আছে'।

জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনগুলোয় বলা হয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের এই গুরুত্বপূর্ণ দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

Comments