‘রাজা যায় রাজা আসে’ কবির প্রাসঙ্গিকতা

সাহিত্যে আজকাল নাকচ করে দেয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। একজন লেখকের রচনাকে মূল্যায়ন না করেই আলটপকা মন্তব্য করা হচ্ছে, অমুকের কবিতা কিছুই হয়নি কিংবা দুর্বল। হালে আবার বলা হচ্ছে উনি ওভাররেটেড কবি ইত্যাদি। একজন কবি বা লেখকের লেখা নিয়ে যথাযথ ব্যবচ্ছেদ বা মূল্যায়ন করে যে কোনো ধরণের উপসংহারে আসতেই পারেন একজন সমালোচক; তাই বলে এক লাইনের ভূমিকাতেই সংহার করা? এরকমের এক প্রেক্ষাপটেই আবুল হাসানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে লিখতে ইচ্ছা হয়েছিল। প্রসঙ্গে কে কী ভাবছেন সেটা তুলে ধরবো।

কবি তুষার দাশ বললেন, প্রকৃত কবি প্রাসঙ্গিকতা হারায় না। ইরাজ আহমেদ বললেন, চিন্তার গহীন ছুঁয়ে যাওয়া কবি আবুল হাসান আজও প্রাসঙ্গিক। সরদার ফারুক বললেন, কয়েকটি প্রজন্ম এখনো গভীর অনুরাগে তাঁর কবিতা পাঠ করে, ভবিষ্যতেও করবে। একজন কবি তো এভাবেই থাকে। হামিদ হোসেন বললেন, কবি আবুল হাসানের পরে তার মতো ভালোবেসে মমতায় আর কেউ কবিতা লিখতে পারেনি। জয়ন্ত রায় বলেছেন, চিন্তায় চেতনায় সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে তিনি নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবেন।

নিজে যদি এরকম একটা জরীপে অংশ নিতাম তাহলে বলতাম, আবুল হাসানের মৃত্যুর এক দশক পরে 'কবিজন্ম' নেয়া আমি যে তাকে তার মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পড়ছি, আর অন্য কাউকে নয়– তাকে নিয়েই লিখছি, এখানেই তো একালে তার প্রাসঙ্গিকতা! মন্তব্যগুলো অনুধাবন করে মনে হল, আমার আর একটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লেখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তারপরেও যেহেতু একটা ভাবনা এসেছে, সেটাই লিখি।

ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কবি আবুল হাসানের আবির্ভাব। দেশ তখন ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভ সময়ে চঞ্চল এক ভ্রূণ : চূড়ান্ত মুক্তির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এর পরে আসবে স্বাধীনতা, আসবে স্বাধীনতা উত্তর অস্থিরতা আর সন্ত্রাস। আসবে দুর্ভিক্ষ। আসবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মতো নির্মম ঘটনা। আবির্ভাবের পর আবুল হাসান এইটুকু সময়ের মধ্য দিয়েই যাবার সুযোগ পেয়েছেন। আর তার অভিজ্ঞতায় এসেছে দারিদ্র, প্রেম আর অসুখ। এই কবি বাংলাদেশের সবচেয়ে টালমাটাল সময়টির সাক্ষী, কিন্তু 'জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি'র মতো সুকান্তীয় পরিপ্রেক্ষিত থাকলেও তিনি সে পথে গেলেন না। তার সহচরবৃন্দ অনেকেই সে পথে গেছেন।

ষাটের দশকের কবিরা প্রথমার্ধে ছিলেন শিল্পপ্রবণ, দ্বিতীয়ার্ধে ছয় দফা, ছয় দফা উত্তর এগারো দফার ছাত্র আন্দোলন বাহিত হয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আবহে কেউ কেউ হয়ে ওঠেন সংগ্রামী। হাসান সংগ্রামী পরিপার্শ্ব আত্মস্থ করে শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাই লিখে যাবার ব্রত নিয়েছিলেন। বন্ধুদের কবিতায় তাৎক্ষণিক হাততালি তাঁকে বিচলিত করেনি তা বলা যাবে না; কিন্তু নিজের সাথে সেই দ্বন্দ্বের বোঝাপড়া করেছেন গদ্যে।

আবুল হাসানের সমকালীন কবিরা সময়ের প্রয়োজনে চড়া সুরে দ্রোহের কবিতা লিখেছেন। এসবের বিপরীতে হাসানের স্বর মোটেও উচ্চকিত ছিল না; তিনি ছিলেন শিল্পে নিমগ্ন। অন্যদের কবিতায় ছিল বারুদ, হাসানের কবিতায় ছিল বাষ্পরুদ্ধ দ্রোহ। - তা কখনো অবমুক্ত হতো, সেই নিদর্শন আমরা পেয়েছি। চারপাশে মারী, মন্বন্তর, যুদ্ধ আর বিবিধ অস্থিরতাকে আত্মস্থ করে হাসান নিমগ্ন থেকেছেন কবিতার শিল্পিত উদযাপনে, নিজের সৃষ্টিতে। এই দেশে আবুল হাসানের কবিত্ব ও জীবন প্রবাদপ্রতিম। কোলাহলের ঊর্ধ্বে তিনি নিজেকে নিয়ে সন্তের মতো উচ্চারণ করেছেন-

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,

মায়াবী করুণ-
কিংবা, শেষ বইয়ের শেষ লাইনে –
আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীবন!
মুক্তিযুদ্ধের পর 'উদিত দুঃখের দেশে' কবির মনে এক গভীর বিষাদ-
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
স্বাধীনতা উত্তর অস্থিরতা, অরাজক অবস্থা নিয়ে লিখেছেন,
আমার নাভিতে রক্ত – আমি জানতাম আমি ঠিকই জানতাম
আমি মানুষের এই রোষ থামাতে পারব না, উন্মত্ততা থামাতে
পারবো না।

একই সময়ে প্রতিকূল পরিবেশে তিনি ব্যজস্তুতির আড়ালে বললেন চারপাশের সব কিছুই তার 'ভালো লাগছে, রহস্যময় লাগছে!'

কিংবা,
আমি কার কাছে যাবো কোনদিকে যাবো?
অধঃপতনের ধুম সব দিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুণ্ডার মতো
মতবাদ; রাজনীতি শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে।
'অসভ্য দর্শন' কবিতায়  লিখেছেন -  
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি...
বোন তার বেণী খুলছে, যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে- তাও রাজনীতি

একই সময়ে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণের হুলিয়ার প্রথম ড্রাফটখানি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, বন্ধুত্বের অধিকারবোধে আর কবিতা নিয়ে নিজস্ব ভাবনার সাথে মিল না খুঁজে পেয়েই। বলেছিলেন, সময়ের কবিতা হতে হবে 'অসভ্য দর্শনে'র মতো। রাজনীতি সচেতন হয়েও তিনি শ্লোগানের মতো কবিতা লিখতেন না। তিনি তার সময়কে ধরেছেন-  কবি হিসেবে, সাংবাদিক  হিসেবেও।

মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখেছেন, লিখেছেন যুদ্ধের ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা, দুর্ভিক্ষের পদশব্দ পেয়ে সেই ভয়াবহতা নিয়ে লিখেছেন। আমাদের কবিতায় কেন কীভাবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চিত্র এলো না, সেকথাও ব্যাখ্যা করে লিখে গেছেন দৈনিক পত্রিকার কলামে। তাঁর 'ওরা কয়েকজন' কাব্যনাট্যের রেলযাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যের মতো হাসানের সতীর্থ কবিদেরও গন্তব্য এক নয়—কিংবা কেউবা গন্তব্যহীন, আয়নায় নিজেরই মুখোমুখি।

শেষাবধি 'রাজা যায় রাজা আসে' থেকে 'পৃথক পালঙ্ক' পর্যন্ত তিনি এক স্বতন্ত্র ভুবন গড়ে গেছেন। তার মৃত্যুর পর হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, 'পৃথক পালঙ্কে হাসান কবিতার যে শিখরে পৌঁছেছেন, তার সাথের কেউই সেই উচ্চতায় উঠতে পারেননি।' খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মতে, 'হাসানের ত্রয়ীকাব্য আজ পর্যন্ত অনতিক্রান্ত; তার ঐ সামান্য কর্মপঞ্জির মধ্যে যে একটি নিটোল জগত তাঁর প্রতি-তুলনাও আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি।' তাই তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম পঠিত হচ্ছেন। অনেক তরুণের গল্পই হচ্ছে, আবুল হাসানের তিনটি ক্ষীণকায় কবিতার বই ছিল তাদের যাত্রায় অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী। আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, 'সব প্রজন্মের তরুণরাই গভীর ভালোবাসায় গ্রহণ করেছেন তাকে, বরণ করে নিয়েছেন নিজেদের পরমাত্মীয় হিসেবে। আর নেবেনই না কেন, আমাদের সকল বিষাদ-বিপন্নতা আর নিমগ্নতার ছবি যে তিনি এঁকে গেছেন ওই অল্প বয়সেই।'

আবুল হাসান ছিলেন একজন জাত বোহেমিয়ান। তার মাঝে এক ধরনের সন্ন্যাসও ছিল। তার প্রেমের কবিতায় এসেছে এক ধরণের বৈরাগ্য। জীবনের প্রতি তার যেমন আসক্তি ছিল, তেমনি ছিল নির্লিপ্তি। আসক্তির কারণেই জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছেন; আর নির্লিপ্তির কারণেই ২৮ বছর বয়সে নিজের আসন্ন মৃত্যুকেও নিয়েছেন সহজভাবে;  জীবন আর মৃত্যুকে দেখেছেন একই আগ্রহ আর সাহস নিয়ে। মোরগের কর্তিত শির যেভাবে ঘাসের ভেতর ছটফট করে, তার মধ্যে নটরাজের নৃত্যকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, আর পাঠক দেখছে কবি নিজের মৃত্যু যন্ত্রণাকে কীভাবে উপমিত করলেন!  লিখে গেছেন নিজের এপিটাফ –

যতদূরে থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ
যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।
মিলে যায় – পৃথিবী আকাশ আলো একদিন মেলে!

সাজ্জাদ শরিফ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অকাল প্রয়াত কবিদের ইমেজে এক ধরণের সূর্যাস্তের আলো এসে আলোকিত করে যায়। মৃত্যু না এলে তিনি হয়ত আরও পরিণত হতে পারতেন, কিন্তু মৃত্যু এসে তার চক্রটাকে পূর্ণ করে দিয়েছে এবং আমরা তার সমগ্রতা নিয়ে বসতে পারি এবং অনেক বছর ধরেই তাঁকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আসছি; তিনি তবু পুরনো হচ্ছেন না। কারণ, তাঁর কবিতা চির সবুজ।

মৃত্যুর পর সেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বর– ডিসেম্বর মাসে আবুল হাসানকে নিয়ে সেকালের সাহিত্য অঙ্গনে যে আলোচনাগুলো হয়েছিল, সে সব আজও ধরা দিবে। তার মৃত্যুর পর শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, স্বল্প সংখ্যক তরুণ কবির মধ্যে যিনি বিশিষ্ট আমরা তাকে হারালাম।

আল মাহমুদের কথাতেও একই প্রতিধ্বনি- মৃত্যুর কথা জেনেও কবিতা লেখা একমাত্র কবির পক্ষে সম্ভব- আবুল হাসান তার প্রমাণ। আহসান হাবীব বললেন, হাসানের মৃত্যু আমাদের সাহিত্যকর্মীদের জন্য যেমন পরমাত্মীয় হারানোর দুঃসহ আঘাত, কবিতানুরাগীদের জন্যে তেমনি বহন করে এনেছে এক অপূরণীয় ক্ষতির সংবাদ। শহীদ কাদরী বললেন, কবিতার প্রতি তার বোহেমিয়ান প্রেম আমাদেরকে আপ্লুত করত। তার কবিতার মেজাজ ও তেজ আমাদের চিরকাল শাণিত করে যাবে। মহাদেব সাহার উক্তিতে হাসান তাঁদের 'সময়ের সেরা কবি। সিকদার আমিনুল হক বললেন, বলতে দ্বিধা নেই, হাসানের মতো আসক্তি নিয়ে জন্মানো কবি আমি আর দেখিনি।

ত্রয়ী কাব্যের পর, আবুল হাসানের 'অগ্রস্থিত কবিতা'ও হাসানেরই এক বর্ধিত ভুবন। সেই ভুবন স্মৃতিময়, সেই ভুবন জাতিস্মর বাউলের। হাসানের সম্পূর্ণ কাব্যিক ভ্রমণ শেষাবধি তাঁর নিজেরই আত্মজীবনী। অল্প সংখ্যক কবিতা তাঁর; কিন্তু তার অধিকাংশ কবিতাতেই আছে স্মরণযোগ্য পঙক্তি। এটা একজন জনপ্রিয় ও শক্তিমান কবির বৈশিষ্ট্য। হাসানের মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও এ কথা সত্য। যে কবিতাগুলো তিনি তার আয়ুর বিনিময়ে লিখেছেন তা আমাদের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর বিধুরতম কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক হীরে- মানিকের খনি: তাই  আমাদেরকে বারবার এখানেই শরণাগত হতে হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

13h ago