বিবৃতির রাজনীতি এবং পক্ষ-বিপক্ষের মাঝখানে বিপন্ন জনগোষ্ঠী
গত ২৮ আগস্ট দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম: 'ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত করতে প্রধানমন্ত্রীকে শতাধিক নোবেলজয়ীর চিঠি'। এর আগের দিন দেশের ৩৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক একই বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা হয় এই চিঠিতে। নোবেলজয়ীদের ওই চিঠি এবং বাংলাদেশের ৩৪ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতির ভাষাও কাছাকাছি। তবে শতাধিক নোবেলজয়ীর চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলগুলোকে 'বিচারিক হয়রানি' বলে উল্লেখ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা স্থগিতেরও আহ্বান জানানো হয়। এর পরপরই এই চিঠি ও বিবৃতির পাল্টা বিবৃতি আসতে থাকে দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের তরফে।
এর আগেও শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে নোবেলজয়ী, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবসহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত অনেক ব্যক্তি বিবৃতি ও চিঠি দিয়েছেন। তার 'ন্যায়বিচার' নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও বাংলাদেশ সরকারের তরফে বরাবরই দাবি করা হয়েছে যে, এখানে বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের যেহেতু কোনো সুযোগ নেই, অতএব ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো স্থগিত করার এখতিয়ারও সরকারের নেই।
গত ২৯ আগস্ট গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনেও ড. ইউনূসের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বরং নোবেলজয়ীসহ যে বিশিষ্টজনরা মামলা স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের প্রতি শেখ হাসিনার পরামর্শ, তারা চাইলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীদের বাংলাদেশে পাঠাতে পারেন। তারা এসে খতিয়ে দেখতে পারেন যে, ড. ইউনূসের প্রতি আসলেই কোনো অবিচার করা হচ্ছে কি না।
বস্তুত প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যক্তি, সংগঠন ও দলের তরফে কোনো না কোনো ইস্যুতে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। বিবৃতি দেওয়া হয় নানা কারণে। কখনো কোনো ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে, কখনো কোনো আইন সংশোধন বা বাতিলের দাবিতে। এই ধরনের বিবৃতি বা স্টেটমেন্ট দেওয়া হয় সাধারণত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। আবার দীর্ঘদিন ধরে চলমান কোনো বিষয়েও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার তরফে নিয়মিত বিরতিতে বিবৃতি আসে। যেমন: বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন ইস্যুতে মাঝেমধ্যেই বিবৃতি আসে।
ড. ইউনূসের সবশেষ ইস্যুর আগে এরকম বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি এসেছিল গত মার্চে স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদ ও ফটোকার্ডকে কেন্দ্র করে। তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংগঠনের তরফে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি আসে। কিন্তু এসব বিবৃতি নিয়ে নানারকম সংশয়ও তৈরি হয়। বিশেষ করে যাদের নামে বিবৃতি আসে, তাদের সবাই বিবৃতিতে আদৌ সই করেছেন কি না, সবাই ওই বিবৃতির বিষয়ে জানেন কি না, সবাই স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে দেশের মঙ্গল বিবেচনায় বিবৃতিতে সই করেছেন নাকি সেখানে ব্যক্তিগত নানাবিধ চাওয়া-পাওয়াই মুখ্য—সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। শুধু তাই নয়, একবার এক বিবৃতিতে একজন মৃত শিল্পীর নাম উল্লেখেরও অভিযোগ উঠেছিল।
প্রশ্ন হলো এসব বিবৃতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব কতখানি? অর্থাৎ এসব বিবৃতির প্রভাব বা ফলাফল কী? যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসব বিবৃতি দেওয়া হয়, বিশেষ করে সরকার কি আদৌ এসব বিবৃতিকে গুরুত্ব দেয়? যদি এসব বিবৃতিকে সরকার পাত্তা না দেয়, তাতেই বা কী হয়? বিবৃতি দিয়ে কি কোনো পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব?
একটি পক্ষ কোনো বিষয়ে বিবৃতি দিলে তাদের প্রতিপক্ষ যে পাল্টা বিবৃতি দেয়, সেটিরই বা গুরুত্ব কতখানি? এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক কোনো সংকটের সমাধান হয়, নাকি মৌলিক সংকট ইস্যুতে দেশের বিশিষ্টজনদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়? কেননা বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে এবং সবশেষ ড. ইউনূস ইস্যুতেও যেসব বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি এসেছে, সেখানেও দেখা গেছে যে, দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজ এবং শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা প্রকাশ্যে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন।
যে কারণে যারা ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন বা যারা মনে করছেন যে ড. ইউনূসকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হয়রানি করা হচ্ছে বা তাকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তারা এখন সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। আর এ কারণেই যারা সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত, তারা হয়তো ভাবছেন যে, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল যেহেতু ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে এবং দলের সিনিয়র নেতারা প্রতিনিয়তই ড. ইউনূসের সমালোচনা করছেন, অতএব তার পক্ষে যারা বিবৃতি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা বিবৃতি দেওয়া উচিত।
যেমন: ২৭ আগস্ট দেশের যে ৩৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে অন্যান্যের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, হাফিজউদ্দিন খান, হামিদা হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বদিউল আলম মজুমদার, শাহদীন মালিক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক আলী রীয়াজ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শহিদুল আলমের মতো ব্যক্তিরা রয়েছেন—যারা সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত নন।
অন্যদিকে যে ১৭১ জন এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে অধ্যাপক অনুপম সেন, ড. আতিউর রহমান, অধ্যাপক আবুল বারকাত, হাসান ইমাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তারানা হালিম, ফাল্গুনী হামিদসহ আরও যাদের নাম রয়েছে, তারা বর্তমান সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী বা অনেকে সরকারপন্থি হিসেবেই পরিচিত।
কিন্তু এই বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ৫০ জন সম্পাদকের বিবৃতি নিয়ে। কারণ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ শ্রম আইন লঙ্ঘন। অতএব সই করা সম্পাদকদের মধ্যে কতজন তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন মেনে চলেন; কতজন সম্পাদক তাদের কর্মীদের নিয়মিত বেতন-বোনাস দেন; কতজন সম্পাদকের পত্রিকা সরকারের ওয়েজবোর্ড মেনে চলে, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন। তারা এমন প্রশ্ন করেছেন যে, চাকরি ছাড়লে বা ছাড়তে বাধ্য হলে কতজন সম্পাদক তাদের কর্মীদের ঠিকমতো পাওনা পরিশোধ করেন। কতজন পত্রিকা ছাপা ও প্রকাশের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন ও কাগজ সংগ্রহ করেন ইত্যাদি।
উপরন্তু এই ৫০ জন সম্পাদকের মধ্যে এমনও অনেকের নাম দেখা যাচ্ছে, সম্পাদক হিসেবে তো বটেই, ওইসব পত্রিকার নামও হয়তো দেশের মানুষ এর আগে খুব একটা শোনেনি। এর মধ্যে অনেক পত্রিকা হয়তো ২০০ কপিও বিক্রি হয় না। অথচ তারাও নোবেলজয়ীদের চিঠির পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন। ফলে যে প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসে তা হলো, এই বিবৃতির আসলে উদ্দেশ্য কী?
উদ্দেশ্যটা দেশবাসী জানে ও বোঝে। কিন্তু এই ধরনের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক এমনকি লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরাও যেভাবে স্পষ্টত দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন—সেটি আখেরে দেশের জন্য যে কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না, বরং দেশকে আরও বেশি রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত ও বিভক্ত করে ফেলবে—সেটি উপলব্ধি করা জরুরি।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে রাজনৈতিক বিভাজন এত তীব্র হয়েছে যে, এখন শুধু বিশিষ্টজনরাই নন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমসাময়িক নানা বিষয়ে কোনো স্ট্যাটাস বা কমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষও এখন সতর্ক থাকেন যে, তিনি কী লিখলে কোন পন্থি হিসেবে চিহ্নিত বা বিবেচিত হবেন। বিশেষ করে যারা কোনো পন্থি হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না। যারা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে চান, তাদের জন্য পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে কঠিন। কারণ যিনি সরকারের পক্ষের লোক, তিনি স্পষ্টতই যেকোনো বিষয়ে সরকারের পক্ষে দাঁড়াতে পারছেন। বিবৃতি দিচ্ছেন। টেলিভিশনের টকশোতে সরকারের সব কাজের প্রশংসা করছেন। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কোনো ভুল তাদের চোখে পড়ছে না। পক্ষান্তরে যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত বা যারা নিজেদেরকে সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কিংবা এই পরিচয়ে যারা ভীত নন, তারাও সরকারের সব কাজের সমালোচনা করছেন। সেটা হোক টেলিভিশন চ্যানেলে, হোক পত্রিকার লেখালেখিতে কিংবা বিবৃতিতে।
মাঝখানের যে অংশটি, অর্থাৎ যারা সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে না থেকে বস্তুনিষ্ঠ কথা বলতে চান, তারা এই তীব্র রাজনৈতিক বিভেদের কালে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। সেই ঝুঁকিটা যতটা না আইনি ও রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। অর্থাৎ একজন মানুষ হয়তো আওয়ামী লীগেরই সমর্থক এবং সুযোগ পেলে নৌকায় ভোট দেন; তিনিও যদি ফেসবুকে এরকম একটি স্ট্যাটাস দেন যে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে বিমানবন্দর থেকে ১০ মিনিটে ফার্মগেট এসে জ্যামে বসে আছি—তাহলে এই স্ট্যাটাসটিও হয়তো উন্নয়নবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করে তাকে সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
বিপরীতে কোনো একজন মানুষ হয়তো বিএনপির সমর্থক এবং সুযোগ পেলে ধানের শীষে ভোট দেন—তিনিও যদি বিএনপির চলমান আন্দোলনের কৌশল এবং তাদের নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন; তিনি যদি এই কথা বলেন যে, নির্বাচনি ব্যবস্থাটি বিতর্কিত করলেও আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদে দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে, তাহলে তাকেও হয়তো সরকার বা আওয়ামী লীগের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। অর্থাৎ বিষয়টা এমন হয়েছে যে, এখন আপনি সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকলে সেখানে নিঃশর্ত আনুগত্য থাকতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ বলে কোনো অপশন নেই। বিবৃতির ক্ষেত্রেও তা-ই। যেহেতু একটি পক্ষ ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে, অতএব তার পাল্টা একটি বিবৃতি দিতে হবে।
যে কারণে একটি পক্ষ যখন দাবি করছে যে ড. ইউনূসকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হয়রানি করা হচ্ছে, তখন এটিকে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং বিচারব্যবস্থাকে হেয়প্রতিপন্ন করার শামিল বলে মনে করছে অন্য পক্ষ। এই পক্ষ-বিপক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোনো কিছুর নির্মোহ বিশ্লেষণ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments