বিদেশে উচ্চশিক্ষা: প্রয়োজন মানসিক সুস্থতাও

বিদেশে উচ্চশিক্ষা: প্রয়োজন মানসিক সুস্থতাও
ছবি: নাদিয়া রহমান

শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর সুস্থতা, এই কথাটা যুক্তরাষ্ট্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পড়তে আসবার পর নিজের কিছু অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছি কেন গুরুত্বপূর্ণ। 

আমরা যারা একদমই ভিন্ন পরিবেশ থেকে পরিবার ছেড়ে আসি, সে সব প্রতিটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকেই একাকীত্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। হয় কারও ক্ষেত্রে কম, আর কারও জন্য বেশি, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই। 

বিশেষ করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী আসেনে, তাদের কমিউনিটি, পরিবার-পরিবেশ অনেক ভিন্ন, যা এখানে আসলেই কেবল বোঝা যায়। ব্যক্তিস্বতন্ত্র হিসেবে বেড়ে ওঠা বলতে আমরা যে বিষয়টাকে বুঝি বা জানি, তা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিস্বতন্ত্রর মতো নয়। এর ওপর থাকে ভাষাগত পার্থক্য। আপনি ইংরেজিতে যত পারদর্শীই হন না কেন, খুব কম মানুষকেই দেখেছি একেবারে মার্কিনীদের মতো সহজাত উচ্চারণে কথা বলতে। দীর্ঘদিনের অভ্যাস না থাকলে এটা হয়ও না, এমনকি যারা বহু বছর ধরে এখানে রয়েছেন। 

তা ছাড়া কোনো শব্দের অর্থ প্রয়োগ একেবারে ভিন্ন এখানে। যা হয়তো আমি এক অর্থে ব্যবহার করছি কিন্তু মার্কিনিরা আদতে ওটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, শ্রেণিকক্ষে এত দেশ, জাতির মানুষের সঙ্গে কথা বলবার পর মনে হতো, আজ সারাদিন দুটো কথা বলিনি। আবার এমনও কোনদিন গেছে সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর ঘরে যখন ফিরে এসেছি, তখন মনে হয়েছে এই বাসায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু ঘরটাই নয়, যতদূর চোখ গেছে কোনো পরিচিত মুখ নজরে আসবার মতো ছিল না। দেশের সঙ্গে দীর্ঘ একটা সময়ের পার্থক্য থাকায়, কিছু নির্দিষ্ট সময় ছাড়া যোগাযোগ করাটাও সম্ভব হতো না।
 
সব মিলিয়ে পুরো দিন অগুণতি কাজ শেষে মনে হতো, কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়েছে। এই মনোভাব থেকেই বহু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আসলে কিছু মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। মানসিক সমস্যা মানেই এই নয় যে, একেবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা। খুব ছোটখাট বিষয়েও খারাপ লাগতে পারে, যাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। 
 
ভাষাগত দূরত্ব, একাকীত্ব ছাড়াও অনেকেই অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। অন্যতম আরেকটি সমস্যা হতে পারে স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে। এখানে চিকিৎসা খরচ অনেক ব্যয়বহুল। অনেক ক্ষেত্রে ইনস্যুরেন্স থাকলেও সবকিছু এর আওতায় থাকে না। তার ওপর ভালো চিকিৎসক সম্পর্কে জানতে পারা, সময়ের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে অ্যাপয়ন্টমেন্ট নেওয়ার প্রক্রিয়া একেবারেই ভিন্ন এখানে। তখন ভিন দেশের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে অসহায় লাগাটা খুব স্বাভাবিক।
 
অনেকের থাকে অত্যধিক পড়ার চাপ। সবার প্রফেসর যে সহযোগিতার মনোভাব রাখেন এমনও নয়। তার ওপর এখানে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সহকারী গবেষক কিংবা টিচিং অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে শতাধিক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকেও পড়াতে হয়। যতই বাড়ির জন্য খারাপ লাগুক, বা নিজের খাতার নম্বর নিয়ে চিন্তা থাকুক; দক্ষভাবে প্রতিটি লেকচার, কুইজ আলোচনা করে যেতে হয়। 

তাই নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই দেখছিলাম, কেন এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন সুযোগ থাকে নিজের এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলবার। স্বাস্থ্যবিমার অধীনে 'বিহেভিওর হেলথ' বা মানসিক স্বাস্থ্যর জন্য আলাদা কোন ফি দেওয়ার প্রয়োজন না হলে, নিজের মনের কথা, চলমান বিভিন্ন দ্বন্দ্ব প্রকাশ করা যায়। এখানে পড়াশোনার কিছু অংশ থাকে যা সহপাঠীদের সঙ্গে করতে হয়, যা টিমওয়ার্ক হিসেবেই পরিচিত। ডেডলাইন এর ঝামেলা বা কোনো গবেষণা বারবার পড়েও ঠিকমত বুঝতে না পারলে সেটা সহপাঠীকে সরাসরি বলাই ভালো। অন্তত এখানে একটা জিনিস বুঝেছি, সবাই যে কোনো বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতেই পছন্দ করেন। এবং এতে কেউ আহত বোধ করেন না! কিংবা প্রফেসরের সঙ্গে ক্লাসের বাইরেও যোগাযোগ রাখবার চেষ্টা করা। এতে করে শিক্ষককে এত শিক্ষার্থীর মধ্যে একমাত্র নিজের পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলা যায়। 

তাই প্রয়োজন যোগাযোগের মাধ্যমে যতটা সম্ভব নিজের পারিপার্শ্বিক সমস্যা নিয়ে কথা বলা। এতে দিন শেষে কিছুটা হলেও নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া হয়।

 

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English

Beximco workers' protest turns violent in Gazipur

Demonstrators set fire to Grameen Fabrics factory, vehicles, vandalise property

1h ago