কেমন আছে হুমায়ুন আজাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ

একজন মানুষের বহুবিধ পরিচিতি- কবি, লেখক, শিক্ষক ও ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন। আবার এমন পরিচিতি সবার ভাগ্যে জোটেও না। জোটেলেও সব বিষয়ে অতোটা ক্ষুরধার লেখা, দিতে পারেন না। তার জন্য থাকতে হয় নিবিষ্ট চিত্তে মানুষ, সমাজ, ও রাষ্ট্রের প্রতি ভালোবাসা; থাকতে হয় বীক্ষণ ও অধ্যয়ন এবং সর্বোপরি পরিবর্তন ও সংস্কারের তীব্র নেশা ও পিপাসা। বহুমাত্রিক ও বিষয়বস্তু নির্মাণে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ছিলো সেই সত্ত্বা, যিনি মনে ও বোধে ধারণ করেছেন।

যেদিন তাকে কুপিয়ে নির্মমভাবে জখম করা হয় সে দিনটির কথা মনে পড়লে আজও গাঁ শিউরে উঠে; মনে হয় এ কোন রাষ্ট্রে আমাদের বাস? যে কোন সভ্য রাষ্ট্রে লেখার বিরুদ্ধে জবাব হবে লেখা, মতের বিরুদ্ধে আমরা দাড় করাব মত। কিন্তু হামলা মামলা খুন কেন?- না তা কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না, এটা যে কারো জন্য। ভিন্নমতকে আলিঙ্গন না করতে পারলে কিসের মনুষ্য সমাজ? অথচ তার অগ্রসর চিন্তা এবং লেখনি অনেক মুক্তমনা পাঠককে দিয়েছে নানামাত্রিক চিন্তার রসদ এবং উৎসাহ দিয়েছে জং ধরা চিন্তার আস্তরণে। মুক্ত চিন্তা আজ মার খাচ্ছে ঘরে বাহিরে...

অনেক আলাপের মাঝে হুমায়ুন আজাদ একজন শক্তিমান কবি। যদিও তিনি কবিতার চেয়ে উপন্যাসই বেশি লিখেছেন; লিখেছেন চমৎকার সব প্রবন্ধ। মূলত, আজন্ম কবিতা লেখা মানুষটির কবিতা আমার মতো অনেকে ভীষণ টানে, একজন পাঠক হিসেবে হৃদয় তোলপাড় করে দেয়; আবার মস্তিষ্কে অনুরণন ও বোধের জন্ম দেয়। তাই অনেক কবিতাই স্মরণে গেঁথে আছে উদ্ধৃতিময় মহার্ঘ্য পঙক্তি হিসেবে। চুম্বকাংশ হয়ে বেঁচে আছে আজও।

আজন্ম প্রতিবাদী আজাদ কবিতাতেও সমুদ্রের মত গর্জন তুলেছে; এ বাঙলায় একাত্তরের সূর্য সন্তানেরা যেমন একদা  তুলেছিলেন। আক্ষেপে, মানসিক আর্তি ও ব্যাকুলতা নিয়ে রুষে উঠে কণ্ঠ উঁচিয়ে বলেন, 'আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।/নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক/সব সংঘ-পরিষদ।' এতে বুঝা যায়, সময়কে তিনি ভালোভাবে ধরতে পেরেছেন।

যে সমালোচনা করতে জানে, সেই প্রকৃত ভালোবাসতে জানে। বাংলার অপূর্ব নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা তার সেই শৈশব থেকে যেদিন থেকে মুন্সিগঞ্জের সূর্যদীঘল গ্রাম রাঢ়ীখাল চষে বেড়িয়েছেন, দেখেছেন আড়িয়াল বিলের অপার সৌন্দর্য। নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা, পল্লীর প্রতি প্রেম সেই আদিতেই আপ্ত হয়েছে তার আকাশসম বুকে। আধুনিক গদ্য কবিতায় পারঙ্গম কবি হুমায়ুন আজাদ এখানে পাঠকের মন ও মনন হরণ করেন সহজ-সরল ছন্দে ও বিষয়ের নান্দনিক পরিবেশনে- "ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,/ ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও, ভালো থেকো।/ ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।"

কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

দেখা যায়, ছেলেবেলাটা বেশ কেটেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি এক দুরন্ত ও দুর্দান্ত কৈশোর তিনি পার করেছেন। চারপাশের মনোরম প্রকৃতি, গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের চিত্রকল্প আজীবন তার হৃদয় পটে গেঁথে ছিল। শেষ বয়সে আজাদ তাই হরহামেশা ছুটে যেতেন গ্রামে, সময় কাটাতেন গ্রামের তরুণ শিক্ষার্থীদের সাথে পথে হেঁটে হেঁটে। কবিতায় আজাদের ছেলেবেলার বর্ণনা, আমাদের মত যাদের জীবনের বেশ খানিকটা সময় গ্রামে কেটেছে, স্মৃতি কাতর করে তোলে নিমিষে। মনে হয় "এই তো পাড়লাম কুল এই তো ফিরলাম মেলা থেকে/এই তো পেলাম ভয় তেঁতুলতলায় এক সাদাবউ দেখে/এই তো নবম থেকে উঠলাম দশম শ্রেণীতে/এই তো রাখলাম হাত কিশোরীর দীঘল বেণীতে।"

প্রেমের কবিতায় আজাদ বেশ চৌকস। মনকে আঁকতে গিয়ে প্রেমজ যৌনতাকে আড়াল করেননি তিনি। প্রেমের শোভা ও দুঃখ বেশ স্পষ্ট কিন্তু এক অমোঘ কাব্যিক বয়ানে সারেন তিনি তার মন্ত্র। প্রেমে যে শারীরিক, মানসিক মিলন ও দ্বন্দ্বের নিপুণ খেলা তা তিনি ভয়ঙ্কর সত্যের তুলিতে নির্মমভাবে ছোপ মারেন জীবন ক্যানভাসে- 'তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে?/ ভেবেছিলে গাড়ি, আর/ পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে, আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,/ আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই/ অনবদ্য অর্গান?' কবি এই কবিতায় তার প্রেমিকার কষ্টকে আঁকতে গিয়ে প্রকারন্তরে নিজের কষ্টকেই এঁকেছেন। প্রতিশোধ নয়, কবিতা যেন জানান দিচ্ছে এক গোপন গহীন বিরহী প্রেমের সাহসী প্রকাশ। তিনিই বলে উঠতে পারেন, 'আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো/খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে/…একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।' 

কবি প্রেমের গভীরতাকে পরাবাস্তবতা বা অতীন্দ্রিয়তা দিয়ে মাপেননি। তাই যৌনতাকেও কোথাও অস্বীকার করেননি। তবে ভালোবাসা আর প্রেমের নীরব-মুখর বন্ধনে থেকেই যেন আজাদ প্রেমজ কামনাকে ধরতে চান। তাই আরাধ্য প্রেয়সীর সমীপে বলেন "ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো/ বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।/ যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,/ জ্ব'লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।" সুন্দর এবং সাবলীল উপমায় তিনি প্রেমকে পেতে চেয়েছেন নিবিষ্টতায়; কোন নিছক খেলাচ্ছলে নয়-করতে চেয়েছেন জীবন বর্ণ, গন্ধ ও মধুময়।

হুমায়ুন আজাদের চোখ জহুরির মতো। প্রতীকী বয়ান হলেও কবিতার ভাষা বেশ স্পষ্ট, সাবলীল ও তরঙ্গময়। যাপিত জীবনের কাছের বিষয়গুলোকে গভীর মমতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কবিতায় বিস্তার ও বিন্যাসে দিয়েছেন আবেগ ও যুক্তিতে। তাইতো "গরীবের সৌন্দর্য" নামক কবিতায় উচ্চারণ করেন গরিবিয়ানার নান্দনিক এক নন্দনতত্ত্ব- 'গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।…শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।' অনেকটা যেন আমরা তাত্ত্বিক কার্ল মার্কসকে এখানে কবি হিসেবে আজাদের উপর ভর করে।

আজাদ আবারো হাজির করেন তার সত্য ভাষণ। এ যেন সত্য কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম এই মন্ত্রে দীক্ষিত। তার "আমাদের মা" কবিতাতে পাঠকের সামনে এক মলিন চিত্র এঁকে দেখান যে স্বাধীনতার এতো বছর পরও "কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত/আমাদের মা আজো টলমল করে।" পাঠকের চোখও যেন টলমল হয় গোপন জলে।

আজাদকে ঠিক প্রথাবিরোধী বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে অনেক দ্বিমত আছে। অনেক কথা তিনি প্রথার মধ্যেই করেছেন। অনেক প্রবন্ধ ও সাহিত্য যতটুকুন পড়েছি তাতে মনে হয়েছে আজাদ আধুনিক পশ্চিমা সাহিত্যের নিয়ম নীতিকে অনুসরণ করেই তার রচনা লিখার পদ্ধতি নির্বাচন করেছেন এবং অনুকরণও করেছেন। নতুন কোন লেখন রীতি বা পুরাতন কোন ধারাকেও তেমন উজ্জ্বল মহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তবে তার লেখার গতি বেশ বেগবান ও ধারালো তা বলতে আমার দ্বিধা নেই। সহজ সরল কঠিন সত্য উচ্চারণ বারংবার করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। ভাষার সুনিপুণ দক্ষতায় ও কাব্যিকতার মোড়কে আজাদের উচ্চকিত উচ্চারণ দাগ কাটে পাঠকের মনে।

অন্যদিকে ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে আজাদের যাত্রাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ তবে চমস্কিদের পথ অনুসরণ করেছেন; তেমন নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজাদ আমাদের এ অঞ্চলের অনেকের চেয়েই প্রাগ্রসর ছিলেন তা সত্য। ঘুণে ধরা এক সমাজ পেয়েছিলেন তিনি। ধর্মান্ধ বা আপোষকামি মানুষের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছিল নব্য স্বাধীন দেশ। ধীরে ধীরে যেন জেঁকে বসেছিল উগ্রবাদের বীজ। প্রসঙ্গে তার বই "পাক সার জমিন সাদ বাদ" হয় নিষিদ্ধ। কিন্তু বইকে কি নিষিদ্ধ করে আটকে রাখা যায়? তার "নারী" কেও যেমন আটকে রাখা যায়নি, তেমনি সাময়িক বন্দীদশা থেকে বের হয়ে তার সব বই, শব্দ পেয়েছে মুক্তি।

একবার হুমায়ুন আজাদ তীব্র আক্ষেপে বলেছিলেন "আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।" মৌলবাদ আসল, সত্য নিপাত গেল, ধর্মনিরপেক্ষতা আস্তাকুঁড়ে আশ্রয় পেল। এসব দেখে দেখে, হয়তো বীতশ্রদ্ধ হয়ে, আজাদ তার সমালোচনামূলক বইয়ের নাম দিলেন "আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম"। সত্যি, যা চেয়েছেন তা হয়নি। অথচ তিনি এক সময় প্রগতিবাদী বাংলাদেশ দেখে এসেছেন বলেও দাবি করেন। 

মাঝে মাঝে মনে হয় সাহসী আজাদ এই বাংলায় বুক পকেটে জোনাকি পোকা নিয়েও হাঁটতে চেয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীনতার পর প্রজন্ম বেড়ে উঠবে বুক ফুলিয়ে। এক কাতারে দাঁড়াবে সবাই, সমাজ হবে শোষণহীন, দেশ হবে বৈষম্যহীন। কিন্তু কবির সেই আশা-স্বপ্ন অধরা। এক কথায় হুমায়ূন আজাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ ভালো নেই! 
 

Comments

The Daily Star  | English

Ivy placed on 2-day remand in murder case

Senior Judicial Magistrate Md Nour Mohsin passed the order this afternoon after police produced her before the court with a seven-day remand prayer in a case filed over the killing of garment worker Minarul Islam during the anti-discrimination student movement

19m ago