আগামীর ‘ভালো’ দিনগুলোর জন্য

আগামীর ‘ভালো’ দিনগুলোর জন্য
ছবি: সংগৃহীত

পরবাসে পড়তে আসার সময় একজন শিক্ষার্থীর শ খানেক কাজ (আমার হিসেব মতে) সময়ের মধ্যে গুছিয়ে নিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই থেকে শুরু করে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার আমাকে বাছাই করা— প্রয়োজনীয় একের পর এক কাগজ গুছিয়ে রেখে টিকিট কেনা পর্যন্ত। এতসব কাজের মধ্যে আরেকটা গুরুতর কাজ হলো বছরখানেকের জন্য ব্যাগ গোছানো! 

'বাক্স-প্যাটরা' গোছানোর সময় বারবার মনে পড়ছিল '২৫ কেজি! এর কম হলে ভালো, বেশি হওয়াই যাবে না।' কোনটা রেখে কোনটা নেব, সেই তালিকাই করতে হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। সব কিছুই তো বিদেশে পাওয়া যায়, কিন্তু নিশ্চয়ই আমার পড়ার টেবিলে রাখা এত বছরের ছবির ফ্রেম, তাতে বাঁধাই করে রাখা পুরনো ছবিগুলো পাওয়া যাবে না। কত বইমেলা ঘুরে বাবার সঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে কেনা বইগুলোও নিশ্চয়ই পাওয়া যায় না। একেকটা বই কেনারও একেক ইতিহাস! কোনোটা বৃত্তির টাকা জমিয়ে, কোনটা আবার নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা। শুধু বই কেনাই নয়, নীলক্ষেত-পলাশীর রাস্তার মোড়ে যত ঘুরে বেড়ানো আর গল্প, সেগুলোও তো এই বইগুলোর সঙ্গে পুরোনো আর দামি হয়ে উঠছে। সময়ের দাম হিসাব করলে প্রতিটা জিনিসই অনেক দামি বা দাম দিয়ে কেনা বাজারে পাওয়া জিনিসের চেয়েও বেশি। কিন্তু যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিষের জন্যই বরাদ্দ সর্বোচ্চ ২৫ কেজি, সেখানে এই পুঁজিবাদের দুনিয়ায় এসব জিনিসের জায়গা কোথায় লাগেজে! 

আচ্ছা না হয় নিজের রোজকার এই পরিচিত জিনিসগুলো রেখেই গেলাম। কিন্তু এত বছর এগুলো ঠিক এমনটাই থাকবে? নিজে দেশে থাকলে না হয় যত্ন নেওয়া হতো প্রতিদিন। যত কাজই থাকুক, বইগুলোর ধুলো ঝেড়ে নেওয়া হতো অন্তত। 

এই বিষয়টা সম্ভবত প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীরই মনে হয়। মনে হয় আমার মতো প্রায় সবাইকেই এই সাময়িক দ্বিধার সম্মুখীন হতে হয়। বাসা বদলের সময়ও ঠিক এমনটাই মনে হতো ছোটবেলায়। সিঁড়িঘর বা বাসার সামনের দিকের গলিতে অনেক সুখস্মৃতি ফেলে আসতে হয় অনেক ভাড়াটেকেই। দেশ ছাড়ার সময়কার মানুষের হাহাকার আর নাই বা বললাম। সেই মর্মান্তিক ইতিহাসের তুলনায় আমাকে কেবল ঘর ছাড়তে হয়েছে, আর কিছু আরামের অভ্যাস। তাও কয়েকটা বছরের জন্যই তো! তবে পরক্ষণেই পাল্টা যুক্তিও আসে, অনেক কিছুই হয়তো এমন থাকবে না। যেমন, ঘরের জানালায় রাখা গাছগুলো সময়ের দাবিতে টিকবে না, নিজের অনেক কাছের পরিচিত মানুষের সঙ্গেও এভাবে আড্ডা দেওয়া হবে না। আমার এখানে যখন বিকেল, তাদের হয়তো তখন গভীর ঘুমের সময়। দেশে ফেরার পরেও তো একেকজনের ঠিকানা হবে একেক জায়গায়। কারও দেশে ফেরা হবে আগে, কারও হয়তো পরে। আমার বিভাগের অনেক শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসের ক্লাসরুম ছেড়ে চলে যাবে। তখন হয়তো ক্লাসে বকা দেওয়ার সময়ও ভাবিনি এই সিমেস্টারই শেষ এখানে। আর নিজের পরিবারের মানুষগুলোর চেহারাও তো পাল্টে যাবে বয়সের সঙ্গে। এসব অগুনতি জিনিস তো কোনোমতেই আমার দুতিনটা ব্যাগে নেওয়া সম্ভব নয়! 

যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসবার কিছুদিন আগে এতশত পিছুটান উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক। সব আন্তর্জাতিক বিদ্যার্থীই নাকি এমন একটা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়, যার জরিপ আছে মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায়। নিজের ক্ষেত্রে হয়তো একটু বেশি পরিমাণেই, যেগুলো দেশে থাকার দিনগুলোতে কখনোই এতটা গুরুত্বসহকারে মনে পড়েনি। 

আমিই আমার পরিবারের প্রথম সদস্য যে কিনা এই মার্কিন মুল্লুকে পড়তে এসেছি। অন্যেরা অন্যান্য মহাদেশে পাড়ি জমালেই এই অঞ্চলে আমিই প্রথম। তাই পরিবার থেকে বারবার অভয় দেওয়া হচ্ছিল, 'যদি ভালো না লাগে, চলে এসো। মন খারাপ করে পড়াশোনার দরকার নেই।' এই বাক্যটা শেষ কদিন অনেক আশ্বাস দিয়েছে। মনে হয়েছে, খারাপ লাগলে চলে আসা যাবে। পথ তো খোলাই রইল। বহুগুণে ভালো এই চেনা গণ্ডির মধ্যে থাকা। এই চেনা রাস্তা ধরে অফিস থেকে বাসায় ফেরা, সপ্তাহান্তে পরিচিত ক্যাফেতে রাত নাগাদ আড্ডা দেওয়াই মানসিকভাবে স্বস্তিদায়ক। নিজেই নিজেকে এত অবোধ শিশুর মতো যুক্তি দেখালেও শেষ মুহূর্তে আসলে এই প্রত্যেকটি পিছুটান ফেলেই সামনে যেতে হয়েছে। যখন প্লেন ছেড়ে দেবে, সেই সময়ে শেষ কদিনের এত অভয় আশ্বাস ফেলে নিজেকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছি, 'ক'টা বছরই তো! শুধু আমার আগামীর ভালো দিনগুলোর জন্য না হয় এই কয়েকটা বছর থাকলাম ঘরছাড়া!' কোনো একটা বইয়ে পড়েছিলাম (যদিও নামটা মনে নেই), 'মানুষের যাত্রা তো বীজের মতনই। পাটভাঙা নরম শাড়ির আঁচলেই থাকা আরামদায়ক। কিন্তু স্বার্থকতা তো মাটিতে।' নিজের অজানা দিনগুলোতে স্বস্তিতে থাকবার আশায় অবিরাম আমাদের ঘর ছেড়ে থাকা।

 

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

3h ago