যুক্তরাষ্ট্রে নবান্ন বা ‘থ্যাংকসগিভিং’ ছুটি

ফল ব্রেক বা শরৎকালীন দুদিন ছুটির পর সবাই এখানে অপেক্ষা করে থাকে থ্যাংকসগিভিং ব্রেকের। বড়দিনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ছুটির সময় হলো এই থ্যাংকসগিভিং ব্রেক। প্রতি বছর নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার খুব ঘটা করে এই ছুটি উদযাপন করা হয়। আর এই ছুটি মানেই ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, মানে তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বিশেষ ছাড়ে কেনাকাটা। 
ছবি: নাদিয়া রহমান

ফল ব্রেক বা শরৎকালীন দুদিন ছুটির পর সবাই এখানে অপেক্ষা করে থাকে থ্যাংকসগিভিং ব্রেকের। বড়দিনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ছুটির সময় হলো এই থ্যাংকসগিভিং ব্রেক। প্রতি বছর নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার খুব ঘটা করে এই ছুটি উদযাপন করা হয়। আর এই ছুটি মানেই 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে', মানে তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বিশেষ ছাড়ে কেনাকাটা। 

ভাগ্যক্রমে সিমেস্টার ফাইনালের আগে টানা ৪-৫ দিন বন্ধ পেয়ে গেলাম, যদিও থ্যাংকসগিভিংয়ের ছুটি তিন দিনই হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের বল রুমে, গির্জা কিংবা এখানকার স্থানীয়দের বাসার আপ্যায়নে এবারের থ্যাংকসগিভিং ডিনার বেশ আমুদে এবং ভিন্ন ছিল। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে আসা হলেও, এবারই এত আপ্যায়নের মাধ্যমে এই ব্রেকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য জানা হয়েছে বেশ কাছ থেকে। 

থ্যাংকসগিভিং ডিনার বা ভোজ মানেই এখানকার চিরায়ত টার্কি, পটেটো ম্যাশ, আর শীতপ্রধান এই দেশের ক্র্যানবেরি সস এবং ঐতিহ্যের পাম্পকিন পাই, যা বানানো হয় মিষ্টি কুমড়া দিয়ে। খেয়াল করলে দেখা যায়, পৃথিবীর উত্তর কিংবা দক্ষিণ, যে প্রান্তের দেশই হোক না কেন, মানব সভ্যতার আয়োজনগুলো অনেকটা একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এই থ্যাংকসগিভিংয়ের মূলে রয়েছে এখানকার আদিবাসী বা নেটিভ ইন্ডিয়ানদের 'নবান্ন উৎসব'। বাংলাদেশে আমরা যেমন হেমন্তের আগমনে নতুন ধান বা নবান্নের আয়োজন করি, এখানেও তেমন শরতের সময়ে যে নতুন শস্য, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, বিভিন্ন বেরি এবং স্কোয়াশ কৃষকের ঘরে তোলা হতো, তারই আনন্দ উদযাপনের অংশ হিসেবে বিধাতার উদ্দেশে এই ধন্যবাদ জ্ঞাপন। 

তবে সময়ের হাত ধরে এই থ্যাংকসগিভিং উদযাপনে পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন শরতের পরিবর্তে প্রতি বছরের নভেম্বরেই নির্দিষ্টভাবে পঞ্জিকার পাতায় এই ছুটির দিনক্ষণ লিপিবদ্ধ করে দেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য দেশ বা মহাদেশে, যেমন- কানাডায় ঘটা করে থ্যাংকসগিভিং পালিত হলেও সেটা এখানকার স্থানীয়দের মতো নয়। উদযাপনের সময়েও রয়েছে পার্থক্য। 

ছবি: নাদিয়া রহমান

এসব ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল আসলে স্থানীয় টড আর তার স্ত্রী আঙ্কা মার্টিনের আপ্যায়নে। এই দম্পতির সঙ্গে পরিচয় মূলত এ বছরেই গির্জার থ্যাংকসগিভিং ডিনারে। ১২টি ভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনা, ইনডোর গেমস, এমনকি বিভিন্ন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আমাদের একেকজনের বিভিন্ন স্বপ্ন, ভাবনা নিয়েও আলোচনা হচ্ছিল ফায়ার প্লেসের পাশেই। ভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতির কথা চিন্তা করেই মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল ভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, মার্কিনিরা আপ্যায়নে বিশেষভাবে অমায়িক। কারও ভিন্ন মত, বিশ্বাসে যাতে এতটুকু আঘাত না লাগে সেদিকেও তারা বেশ সচেতন। অন্তত ক্যাম্পাস বা বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় এটা মেনে চলা হয় খুব সতর্কতার সঙ্গে। 

এর দুদিন পর এ বছরের শেষ থ্যাংকসগিভিং ডিনারে যাওয়ার উদ্দেশে বের হলাম আমার ইন্টার্নশিপের সুপারভাইজার ড. অ্যানের সঙ্গে। সুবিধাবঞ্চিত প্রবাসী লাতিনদের জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে। অ্যানের বয়স ৭৭ হলেও কী দক্ষভাবে গাড়ি চালিয়ে নিলেন পুরো রাস্তাটুকু। নভেম্বরের এই শীতের সন্ধ্যায় বাইরে যখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এবং মাইনাস এক থেকে তিনের কাছে তাপমাত্রা, তখন অ্যানের বন্ধুর বাসার ফায়ার প্লেসটি ছিল চমৎকার। একজন দক্ষিণ এশীয় শিক্ষার্থী হিসেবে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলাম রাতের খাবারে টার্কির বদলে বিরিয়ানি দেখে। পরে জানলাম ড. অ্যানের এই বন্ধুর পূর্বপুরুষ ভারতের, যদিও তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ফিজির কোনো এক দ্বীপে। 

অতঃপর এ বছরের 'লাস্ট সাফার' বা শেষ ডিনার শুরুর পূর্বে হোস্ট বা আপ্যায়নকারী বিধাতার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছিলেন। প্রতিটি খাবার, সুন্দর সময় এবং জীবনে চলার পথে আমাদের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আনন্দ, সবকিছুই জগতের পরিক্রমায় নির্ধারিত। আমি ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্ম-বিশ্বাসের মানুষ। একইসঙ্গে অন্য বিশ্বাসের মানুষের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখি। 

তাই ভিনদেশের মানুষের মাঝে বসে বাংলাদেশের এই শিক্ষানবিশের উপলব্ধি, জীবনের এই ক্ষণিক যাত্রায় আমার এই মুহূর্তগুলো, নতুন মানুষদের সঙ্গে পরিচিতি, টার্কির বদলে অযাচিতভাবে বিরিয়ানি পেয়ে যাওয়ার পিছে বিধাতা, কোনো শক্তি কিংবা এই পুরো জগতের সকল পরিকল্পিত হিসাব যাই থাকুক না কেন, তার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি বা আমরা কেউই জানি না আসছে বছরের হেমন্তের নবান্নে কিংবা শীতের এই থ্যাংকসগিভিংয়ে কে কোথায় থাকব। তাই কৃতজ্ঞতাটুকু থাকুক নতুনের আশায় এবং বর্তমান উদযাপনের মাঝে।    

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।
 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh ranks 84th among 127 countries in Global Hunger Index

The level of hunger in Bangladesh this year has been categorised as "moderate"

1h ago