চিকিৎসক-আধুনিক যন্ত্রপাতি সংকটে নরসিংদী সদর হাসপাতাল

নরসিংদী জেলায় চিকিৎসা সেবাদানে সবচেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠান জেলা সদর হাসপাতাল। জেলায় প্রতিদিন এ হাসপাতালেই সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন।
চিকিৎসক সংকট, আধুনিক চিকিৎসাযন্ত্র সংকট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, দালালদের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন সংকটে ভুগছে নরসিংদী সদর হাসপাতাল। ছবি: স্টার

নরসিংদী জেলায় চিকিৎসা সেবাদানে সবচেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠান জেলা সদর হাসপাতাল। জেলায় প্রতিদিন এ হাসপাতালেই সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন।

অথচ চিকিৎসক সংকট, আধুনিক চিকিৎসাযন্ত্র সংকট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, দালালদের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন সংকটে ভুগছে হাসপাতালটি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ হাসপাতালে কনসালট্যান্ট পদ ১১টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৭ জন। হৃদরেোগ বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, সার্জারি বিভাগ ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে কনসালট্যান্ট নেই। হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ৪ জন, ডেন্টাল সার্জন একজন, আয়ুর্বেদী চিকিৎসক একজন এবং একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার আছেন।

এই মোট ১৪ জন চিকিৎসক নিয়ে হাসপাতালটি সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

প্রতিদিন প্রায় ৫০০-৬০০ জন সেবাপ্রত্যাশীকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হলেও, হাসপাতালটিতে ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসারের কোনো পদ নেই।

রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মেডিসিন কনসালট্যান্ট এবং ইএনটি বিভাগের জন্য বেলাবো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একজন চিকিৎসক এনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালানো হচ্ছে বিভাগগুলো।

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ হাসপাতাল। বর্তমানে এ হাসপাতালের ৮টি বিভাগ আছে, বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগ, ব্লাড ব্যাংক বিভাগ, এক্স রে বিভাগ, আল্ট্রাসনোগ্রাম বিভাগ, ইসিজি বিভাগ এবং রোগীদের বহনে অ্যাম্বুলেন্স বিভাগ।

রোগীদের সেবা দিতে ৫টি ওয়ার্ডে শয্যা ১০০টি। শিশু ওয়ার্ডে রয়েছে ১৫টি, মহিলা ওয়ার্ডে ২৩টি, গাইনি ওয়ার্ডে ২০টি, পুরুষ ওয়ার্ডে ৪২টি এবং ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যা ১০টি।

অথচ হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকশ রোগীর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ভর্তি হয় ৩০-৪০ জন। এ কারণে চিকিৎসা দিতে রোগীদের বারান্দায়, মেঝেতে গাদাগাদি করে রাখা হয়।

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা দেওয়া হলেও এখানে ৭-৮টি খোলা ড্রেন আছে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, সেবাপ্রত্যাশীরা হাসপাতালে এসে ডাবের খোসা, কলার ছোলা, খাবারের প্যাকেটসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ফেলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নষ্ট করছে।
 
এ হাসপাতালটি পৌর এলাকার আওতাধীন হওয়ায় পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে ময়লা পরিষ্কার করা হয় ও ড্রেন পরিষ্কার রাখা হয়।

চিকিৎসা নিতে ভোগান্তি

গত শনিবার হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা ৮ জন সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের।

তারা বলেন, দীর্ঘ লাইনের কারণে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকেট নিতে এক ঘণ্টা লাগে, ডাক্তার দেখাতে লাগে আরও এক ঘণ্টা। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত।

সদর উপজেলার আলোকবালী থেকে সেবা নিতে আসা সোনিয়া আক্তার (২৮) ডেইলি স্টারকে জানান, পেট ব্যথা নিয়ে তিনি হাসপাতালে যান সকাল ৯টায়। ৪ ঘণ্টা পার হলেও, দুপুর ১টা পর্যন্ত তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়নি।

দালালদের দৌরাত্ম্য

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং নরসিংদীর ৬টি উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বহির্বিভাগসহ প্রায় ২ হাজার রোগী এখানে আসেন। এসব রোগীদের জন্য সীমিত জনবল দিয়ে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।

কিন্তু, প্রতিদিন ১৫-২০ জনের একটি দালালচক্র হাসপাতালের বিভিন্ন ফটকে দাঁড়িয়ে থেকে গ্রাম থেকে আসা রোগীদের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি আদায়ের মাধ্যমে হয়রানি করে।

সদর হাসপাতালের পাশে অন্তত ২০টি প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দালালরা কমিশনের বিনিময়ে সেখানে রোগী পাঠায় বলে সদর হাসপাতালে সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি, দালালদের হাসপাতালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় হাসপাতালের কর্মচারী ও চিকিৎসকদের মারধরের চেষ্টার ঘটনাও ঘটে। পুলিশ ও প্রশাসনসহ সবাই বিষয়টি জানে এবং দালাল চক্রের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।

সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মোহাম্মদ মাহামুদুল কবীর বাসার (কমল) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যারা এখানে চাকরি করতে আসি, তারা প্রায় সবাই নরসিংদীর বাইরে থেকে আসি। দালালরা স্থানীয় হওয়ায় তাদের কাছে আমরা এক ধরনের জিম্মি হয়ে পড়েছি।'

আধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এক্স-রে মেশিন, ইসিজিসহ প্রায় সবকয়টি যন্ত্রপাতি পুরোনো এবং আধুনিক সেবার জন্য নেই কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি।

শয্যা সংকট

১০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগীর জন্য সিট খালি পাওয়া অনেক কষ্টকর। পুরোনো ও অপরিকল্পিত এই হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডটি খুবই ছোট এবং সকালে বহির্বিভাগের রোগীর চাপে ভর্তি রোগীদের অস্বস্তিতে পড়তে হয়।

আবাসন সংকট

চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাসায় থেকে সেবা দিতে হচ্ছে তাদের।

প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক

নরসিংদী সদর হাসপাতালের এসব দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালের পাশে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০-২৫টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর, দালালদের মাধ্যমে রোগী এনে চলছে এসব সেন্টারগুলো।

সদর হাসপাতালের আরএমও মোহাম্মদ মাহমুদুল কবির বাসার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নানা সংকটের মধ্যেও চিকিৎসকরা এখানে খুব কষ্ট করে চিকিৎসা দিচ্ছেন। সরকারি খরচে চিকিৎসা নিতে এসে দালালদের খপ্পরে সেবার নামে প্রতারিত হচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। রোগীদের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হাসপাতালটির জন্য নতুন স্থাপনা ও লোকবল বৃদ্ধি এখন খুবই দরকার।'

জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা সিভিল সার্জন ডা. নুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কনসালট্যান্ট পদে চিকিৎসক না থাকায়, উপজেলা পর্যায়ের অন্য হাসপাতাল থেকে ডাক্তার এনে সদর হাসপাতালে দেওয়া হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে যে আমরা জনশক্তি সংকটসহ বিভিন্ন সংকটে ভুগছি।'

'ডাক্তারদের ডিউটি সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হলেও, রোগীর ভিড়ের কারণে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস করতে হয় তাদের,' যোগ করেন তিনি।

সিভিল সার্জন আরও বলেন, 'সদর হাসপাতালে নিরাপত্তা দিতে ২ জন পুলিশ থাকেন। দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং এখন ২ জন কারাগারে আছেন। আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন এমআরআই মেশিনসহ বেশকিছু জটিল পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। তারপরও যা আছে, তা দিয়ে সংকট সমাধান করা হচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

An economic corridor that quietly fuels growth

At the turn of the millennium, travelling by road between Sylhet and Dhaka felt akin to a trek across rugged terrain. One would have to awkwardly traverse bumps along narrow and winding paths for upwards of 10 hours to make the trip either way.

7h ago