ইমো প্রতারকদের প্রথম টার্গেট প্রবাসীরা

মধ্যপ্রাচ্যে যারা থাকেন তাদের দেশে থাকা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ইমো। ফলে, প্রবাসী ও তাদের পরিবারের কাছে ইমো খুবই পরিচিত একটি নাম। আবার এই ইমোই অনেক সময় হয়ে ওঠে প্রতারণার হাতিয়ার। এই অ্যাপটি ব্যবহার করে প্রতারকরা প্রবাসীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

কুয়েতপ্রবাসী রাসেল আহমেদ গত অক্টোবরে তার পরিচিত একজনের কাজের জন্য বাংলাদেশভিত্তিক একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেন। সেখানে তিনি তার ইমো নম্বর দিয়ে দেন। পোস্ট দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একজন নিজেকে কুয়েতপ্রবাসী দাবি করে রাসেলকে কল দেন এবং কাজ দেওয়ার আশ্বাস দেন।

এর ২ দিন পর রাসেল জানতে পারেন, তার ইমো হ্যাক হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমার ইমোর মাধ্যমে প্রায় ২০০ নম্বরে যোগাযোগ ছিল। সেগুলোর মধ্যে আমার পরিচিত অনেকের কাছে মেসেজ দেয় হ্যাকার। আমার পরিচিত একজনকে কাজ দেওয়ার আশ্বাস দিতে কল করে কথার ফাঁকে কীভাবে যে আমার ইমো তিনি নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলেন, বুঝতেও পারিনি।'

তিনি আরও বলেন, 'তখন আমার বাবা অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেটা আমি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। ওই প্রতারক বাবার হাসপাতালে থাকা একটি ছবি আমার পরিচিতজনদের কাছে পাঠিয়ে বলেছে যে বাবা মারা গেছেন। টাকা লাগবে ২৫ হাজার, সঙ্গে বিকাশ নম্বর দেয়।'

'অনেকে বুঝতে পারলেও সবাই বুঝতে পারেনি যে আমার ইমো হ্যাক হয়েছে। ফলে, একজন ২০ হাজার এবং আরেকজন ১৫ হাজার টাকা পাঠায় ওই বিকাশ নম্বরে। ২ দিন পর যখন আমি এসব শুনলাম তখন আমার সেই ইমো অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেই', যোগ করেন তিনি।

প্রতারণায় শিকার হয়েছেন কুয়েতপ্রবাসী মাসুম খাঁ। ২ বার তার ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে হয়েছে।

মাসুম খাঁ বলেন, 'একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ইমো আপডেট চাইছে। ভালো করে না দেখেই আপডেট দিয়ে দেই। আপডেট দিয়ে ফ্রেশ হতে যাই এবং ঘণ্টাখানেক পরে ফোন হাতে নিয়ে দেখি আমার ইমো অ্যাকাউন্টটি হ্যাক হয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'এই ১ ঘণ্টার মধ্যে হ্যাকার আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মেসেজ দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে ২০ হাজার টাকা দিতে বলে। সঙ্গে একটা বিকাশ নম্বরও দেয়। আমি যার মাধ্যমে বিকাশে টাকা লেনদেন করি তার কাছেও মেসেজ দিয়েছিল। তিনি তো এমন মেসেজ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওই প্রতারকের নম্বরে ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে আমি আমার সিমটাও পরিবর্তন করে ফেলি।'

এই ঘটনার কয়েকমাস পর দ্বিতীয়বার প্রতারণার শিকার হন মাসুম। লটারিতে ৫ হাজার দিনার আয়ের লোভ দেখিয়ে হ্যাক করা হয় তার মোবাইল নম্বর।

মাসুম বলেন, 'আমাকে হ্যাকার বলে, আমি নাকি লটারিতে ৫ হাজার দিনার জিতেছি। তখন জানতে চাই, কীভাবে এত টাকা পেলাম। প্রতারক বলে, শপিংমলের ভাউচারের মাধ্যমে পেয়েছি।'

তিনি বলেন, 'এরপর প্রতারক জানান, লটারির অর্থ পেতে ব্যাংক কার্ড লাগবে। আমি বলেছি, আমার ব্যাংক কার্ড নেই। এরপর তিনি আমার আকামার ছবি চান। সেটাও দেইনি। পরে তিনি বলেন, আপনার মোবাইলে একটা পিন কোড যাবে, সেটা দিলেই হবে। আমি ভুল পিন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভুলে সঠিকটা দিয়ে দেই। সঙ্গে সঙ্গে আমার ইমো অ্যাকাউন্টটি হ্যাক হয়ে যায়।'

'আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে ইমো হ্যাকের বিষয়টি জানান। আগে একবার হ্যাক হওয়ায় আমি সবাইকে সাবধান করে দিছিলাম, আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলা ছাড়া কাউকে টাকা না দিতে। তাই ওই হ্যাকার আর কারো কাছ থেকে টাকা নিতে পারেনি', যোগ করেন তিনি।

আরেক কুয়েতপ্রবাসী ফেরদৌস আলম বলেন, 'আমি কাজের জন্য একটা গ্রুপে পোস্ট করছিলাম। সেখান থেকে একজন কাজ দেওয়ার কথা বলে কল করে এবং ১ মিনিটের মধ্যে আমার ইমো হ্যাক করে ফেলে। আমার মোবাইলে ইমোতে ঢুকতে গিয়ে দেখি ইমো ওপেন হচ্ছে না। হ্যাক করার সঙ্গে সঙ্গে আমার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মেসেজ দিয়ে বলেছে যে আমার মা হাসপাতালে, টাকা লাগবে। এমনকি তিনি আমার কণ্ঠ নকল করে কল করেছেন, যাতে কেউ বুঝতেই না পারে।'

এই চিত্র শুধু কুয়েতের নয়। মধ্যপ্রাচ্যে জুড়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য প্রবাসী ইমো প্রতারকদের কবলে পড়ছেন। প্রবাসীদের টার্গেট করে দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় রয়েছে ইমো প্রতারক চক্র। তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা জানান, বাংলাদেশ ও প্রবাসে কয়েকটি চক্র প্রবাসীদের নম্বর সংগ্রহ করে একটি বিশেষ কোড ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। এরপর ওই অ্যাকাউন্টধারীর পরিচিতদের কল বা মেসেজ পাঠিয়ে বিপদে থাকার কথা বলে জরুরিভিত্তিতে টাকা চায়। এ ছাড়া, তারা ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে প্রবাসীদের স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি ও ভিডিও চুরি করে। এরপর সেগুলো ব্যবহার করে প্রবাসীদের ব্ল্যাকমেইল করে এবং অর্থ হাতিয়ে নেয়।

তারা বলেন, ইমো প্রতারণা থেকে পরিত্রাণ পেতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সন্দেহজনক কোনো কোড আসলে কাউকে দেওয়া যাবে না, কিংবা কোনো লিংক পেলে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না। সেইসঙ্গে পরিবার ও পরিচিতদের জানিয়ে রাখতে হবে যে সন্দেহজনক মেসেজ বা কল পেলেও তারা যেন প্রকৃত ব্যক্তির সঙ্গে অন্য কোনো উপায়ে কথা বলে নিশ্চিত না হওয়ার আগে টাকা না পাঠান।

লেখক: কুয়েতপ্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Cops get whole set of new uniforms

The Inspector General of Police (IGP) has issued a comprehensive new dress code titled Police Dress Rules, 2025, detailing rank-wise uniforms and accessories for all Bangladesh Police members.

6h ago