শিক্ষার্থীদের জীবনে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সদস্যদের হাতে নিহত হন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। এই হত্যার ঘটনায় গোটা দেশ কেঁপে উঠে। এবং তাদের অনুগামীরা। ছাত্রলীগ এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জড়িত সদস্যদের বহিষ্কার করে। এরপর থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হয় ছাত্র রাজনীতি।

শুধু আবরারই এমন হত্যার শিকার নন। ২০০২ সালে বুয়েট ছাত্রদলের ২ গ্রুপের গোলাগুলির মাঝে পরে নিহত হন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। ২০১৩ সালে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দ্বীপকে। এমন আরও উদাহরণ আছে। প্রশ্ন জাগে, যে দেশের স্বাধীনতায় ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, সেখানে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে এটি নিষিদ্ধ করাই কি একমাত্র সমাধান?

অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বলতে গেলে ছাত্র রাজনীতির অংশ না হওয়ার সুযোগই নেই। হলের সিট থেকে শুরু করে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা শুধুমাত্র ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরাই পান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী আবীর অয়ন বলেন, 'আমি শুরুর দিকে প্রায় আড়াই মাস গণরুমে ছিলাম। তারপর করোনা মহামারি শুরু হয় এবং আমি বাড়ি চলে যাই। এরপর যখন রাজনৈতিকভাবে সিট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হলো, সেখানে তালিকায় আমার নাম খুঁজে পাইনি। কারণ, আমি অনুষ্ঠানে যাইনি, গেস্টরুমের কোনো কার্যক্রমে অংশ নেইনি, এমনকি বড় ভাইদের সঙ্গে ঠিকমতো লবিংও করিনি।'

তিনি বলেন, '১ বছর পর বিজয় একাত্তর হলে নিয়মমাফিকভাবে সিট পেয়েছি। আমি চাই, মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ দেওয়া হোক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই বিষয়টি দেখুক। এরপরে যদি কোনো শিক্ষার্থী রাজনীতি করতে চায়, তাহলে করবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মহসিন হলের বাসিন্দা আরাফাত রহমান (ছদ্মনাম) বলেন, 'নিয়মমাফিক যে সিটটি আমি পেয়েছিলাম, সেখান থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। হাউস টিউটররা বলার পরও আমার সিট যারা দখল করেছিল তারা সিট ছাড়েনি।'

তিনি বলেন, 'আসলে হলগুলো চালায় রাজনৈতিক নেতারা, প্রশাসন না। রাজনৈতিক বিষয় থাকলেও ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সবার আগে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করা। কিন্তু আসলে তারা নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্ষমতার অপব্যবহারে ব্যস্ত থাকে।'

সাধারণত শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক কর্মসূচী ও সমাবেশে যোগ দিতে আগ্রহী হয় না। কিন্তু, হলের সিট বাঁচাতে এবং বড় ভাইদের চোখে ভালো থাকতে তারা বাধ্য হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের বাসিন্দা তানজিলা তাসনিম বলেন, 'হলের শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলাকালীন সময়েও অনেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য করা হয় কর্মসূচীতে অংশ নিতে। অনেক সময় মিডটার্মের আগেও এসব কর্মসূচীতে যোগ দিতে বাধ্য করে।'

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলের শিক্ষার্থী তাশফিক রুস্তম (ছদ্মনাম) বলেন, 'কলেজ থেকে যে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয় সেটা কয়েক মাসের মধ্যেই আবার বদলানো হয় এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র নেতারা সেটা করে। আপনি যদি তাদের দলের সদস্য না হন, তাহলে হলে সিট পাবেন কি না, নিশ্চিত না।'

তিনি বলেন, 'তবে, এর আরেকটি দিক আছে। ইন্টার্নশিপের পর কেউ যদি ঢাকায় ট্রেনিং পোস্টে নিয়োগ পেতে চান, তাহলে দরকার রাজনৈতিক লবিং। এ জন্য, চিকিৎসা পেশায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে বা পরে রাজনীতিতে যোগ দিলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়।'

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে ৮ জনের জন্য তৈরি এক একটি হলের রুমে ৩০ থেকে ৩৫ জন, এমনকি আরও বেশি শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে গণরুমে থাকতে হয়। আরও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যায় 'গেস্টরুম' নিয়ে, যেখানে নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ম মেনে চলা 'শেখান' সিনিয়ররা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শিক্ষার্থীরাই 'গেস্টরুম'  পরিচালনা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের শিক্ষার্থী মাহফুজ রহমান (ছদ্মনাম) বলেন, 'গণরুমের শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা শেখাতেই গেস্টরুম সংস্কৃতি। যেমন: বড় ভাইদের দেখলে সালাম দিতে হবে এবং নিজের নাম বলতে হবে। তবে সালাম দেওয়ার সময় হাত শক্ত করে ধরে রাখা বা নাড়ানো যাবে না। এ ছাড়া, নিয়ম অনুযায়ী ক্যান্টিন, ওয়াশরুম, নিউজ রুম, রিডিং রুমসহ বেশকিছু জায়গায় সালাম বলা নিষিদ্ধ। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা সালাম দেওয়া মিস করলে রাতে তাদের বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয় এবং এর জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে। গালিগালাজ ছাড়াও মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ ওঠে মাঝে মাঝে।'

র‌্যাগিং ও বুলিংয়ের মতো অভিযোগ প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যায়। হল প্রশাসন থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের সর্বত্রই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব রয়েছে।

কিছু  শিক্ষার্থীকে এই ছাত্র সংগঠনগুলো জোর করে কর্মসূচীতে নিয়ে গেলেও কিছু শিক্ষার্থী এমনও আছে, যারা ক্ষমতার অংশ হওয়ার প্রত্যাশায় নিজেরাই ছাত্র সংগঠন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আদ্রিতা কবির বলেন, 'যৌন হয়রানি সেল অনুষদের সদস্য দিয়েই ভরা। যদি রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তখন উল্টো ভুক্তোভোগীর উপরই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। অভিযোগ দাখিল করা থেকে শুরু করে বিচার পাওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ক্লান্তিকর। রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে র‌্যাগিংকেও ভিন্নভাবে দেখা হয়। আর গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতি তো আছেই।'

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এমনকি একই রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষের কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলের শিক্ষার্থী অনন্যা মাসরুর (ছদ্মনাম) বলেন, '১১টি বগির ১১টি রাজনৈতিক গ্রুপ আছে। ১১টি গ্রুপ থাকলে সেখানে আর যাই থাক, শান্তি থাকে না। এরাও নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত মারামারি করে। অনেক সময় একটি ঘটনার পর শাটল ট্রেন বন্ধ করে দেয়। সেক্ষেত্রে শহরের সঙ্গে ক্যাম্পাসের সহজ যোগাযোগ মাধ্যমটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন একমাত্র উপায় থাকে লোকাল বাসে শহরে যাওয়া। এটা খুবই ঝামেলার। এই গ্রুপগুলোর নিজেদের সমস্যার কারণে সেইসব শিক্ষার্থীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়, যারা এসব গ্রুপের সদস্য না।'

ছাত্র রাজনীতির পুরোটাই যে খারাপ, তা নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বাধন দেব বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা গণমাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে শুধু নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে দেখি। কিন্তু আমরা অনেক শিক্ষার্থী-বান্ধব কর্মকাণ্ডও করছি।'

তিনি বলেন, 'এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় আমাদের অনেকগুলো গ্রুপ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেছে। আমি এমন এক পরীক্ষার্থীর কথা জানি যিনি জানতেন না যে চ-ইউনিটের পরীক্ষায় তাকে পরিসংখ্যান আঁকতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি পেন্সিল, বোর্ড, ইরেজার ইত্যাদি আনেননি। আমরা তাকে সঙ্গে করে সায়েন্স ল্যাব নিয়ে গিয়েছি এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আবার পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিয়েছি। মানসম্মত খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রেও ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত চেতনাই তো শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করার মধ্যে নিহিত।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছি। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল সক্রিয়ভাবে ডিএসএ বাতিলের দাবি অব্যাহত রেখেছি। আমরা এ বিষয়ে আন্দোলন করেছি, এমনকি অফলাইনেও কাজ করছি। আমরা শিক্ষার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে এবং শিক্ষায় ভ্যাট যোগ না করার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছি।'

ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নানা বিষয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এবং শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা থাকে। সব রাজনৈতিক দলকে একই কাতারে ফেলা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া খুবই সহজ কাজ। কিন্তু সত্যিকারে প্রয়োজন হচ্ছে ছাত্র রাজনীতির ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও সমস্যা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা এবং এসব সমস্যার সমাধান করা। তবেই ছাত্ররাজনীতির যে চেতনায় আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই চেতনা স্বাধীন এই দেশকে এগিয়ে নিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

আজরা হুমায়রা, azrahumayra123@gmail.com

হাসিব উর রশিদ ইফতি, hasiburrashidifti@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

2h ago